শৈশব হতেই বিশ্বের দুঃখী, আর্ত, অসহায় মানুষের কান্না তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠত।গৃহের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য পরিহার করে আর্তের সেবা করাই তিনি জীবনের মন্ত্ররূপে গ্রহন করেন। সুযোগও তাঁর এসে যায়। ১৯২৮ সালে ১৮ বছরের অ্যাগনেসকে যুগোশ্লোভিয়ার জেনুইট সঃস্থা আয়ারল্যান্ডের লরেটো সংঘে পাঠায়। স্কেপেজের পাবলিক স্কুলে পড়বার সময়েই সোডালিটি সংঘের মিশনারীদের কাজকর্মের প্রতি অ্যাগনেসের উৎসাহ ছিল। ক্লাসে যুগোশ্লোভিয়ার জেসুইটদের চিঠি পড়ে শোনানো হত। সেখানে কলকাতার কথাও থাকত। সে সব শুনে কলকাতার প্রতি এক বিশেষ টান তৈরী হয়েছিল অ্যাগনেসের মনে।
খ ব র নিয়ে জানলেন আয়ারল্যান্ডের লরেটো সংঘ ভারতে কাজ করছে। তাদের প্রধান কার্যালয় ছিল ডাবলিনে। অ্যাগনেস তাদের সাথে যোগাযোগ করে মায়ের অনুমতি নিয়ে যোগ দিলেন লরেটো সংঘে।আয়ারল্যান্ডের বাথার্নহামে গেলেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে।
১৯২৮ সালে অ্যাগনেস জাহাজে ভেসে চলে এলেন কলকাতায়। যোগ দিলেন আইরিস সন্নাসিনীদের প্রতিষ্ঠান সিস্টারস অব লরেটোতে। সেই থেকেই তিনি মনে প্রাণে বাংলার মানুষ হয়ে গেলেন। দু বছর দার্জিলিং এ থেকে সন্নাসিনী ব্রত নিয়ে সিস্টার অ্যাগনেস কলকাতায় আসেন। কলকাতার এন্টালির সেন্ট মেরিজ স্কুলে বাংলা বিভাগের শিক্ষয়িত্রী হিসাবে যোগ দেন। ভুগোল ও ইতিহাস ছিল তাঁর পড়াবার বিষয়। প্রায় কুড়ি বছর তিনি ঐ স্কুলের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। স্কুলে থাকাকালীন পাশে মতিঝিল বস্তির বাসিন্দাদের দুঃখ- কষ্ট, দারিদ্র, শিশুদের কষ্ট তাঁকে গভীর ভাবে পীড়া দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানুষ সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ কলকাতার অবস্থা খুবই দুর্বিসহ হয়ে ওঠে।একটু ভাতের আশায়, এক বাটি ফ্যানের আশায় দলে দলে গ্রামের মানুষ ভিড় করে কলকাতায়। মানুষ কুখাদ্য খেয়ে মারা যাচ্ছে। তিনি বুঝেছিলেন চার দেওয়ালের গন্ডীর মধ্যে থেকে দরিদ্রের, আর্তের সেবা হয় না। এর বাইরে তাঁকে বের হতে হবে। ওই বস্তিতে গিয়ে তিনি আর্ত মানুষের সেবা শুরু করেন। ১৯৩১সালে তিনি সন্নাসব্রত গ্রহন করেন। তখন তাঁর নাম করণ হয় মাদার টেরেসা নামে। মাদার লরেটোর সন্নাসিনীদের বেশ ত্যাগ করে পরলেন মোটা নীল পাড় শাড়ী। সেদিন তাঁর সম্বল বলতে ছিল ৫ টাকা, একটি বাইবেল, ক্রুস সম্বলিত জপের মালা। আর সাথে ছিল ঈশ্বরের নির্ভরতা, মনোবল আর বিশ্বাস।
একান্ত নিঃস্ব অবস্থায় ১৯৫০ সালে তাঁর সেবার জন্য কলকাতায় স্থাপিত করেন 'মিশনারি অব চ্যারিটি'। ওই বছরেই তিনি কালিঘাটে নির্মল হৃদয় আশ্রম প্রতিষ্টা করেন।
![]() |
নির্মল হৃদয় আশ্রম |
তাঁরই প্রচেষ্টায় হাওরায় স্থাপন করলেন কুষ্টরোগীদের আশ্রম। এর পরেও তিনি বিভিন্ন জায়গায় বহু স্কুল, দাতব্য চিকিৎসালয়, উদ্ধারাশ্রম প্রতিষ্টা করেন। ১৯৭৮ সালে রোমের কর্তৃপক্ষর অনুমতি নিয়ে আশ্রমের বাইরে থেকেও আর্ত মানুষের সেবায় লেগে পরলেন। সারা বিশ্বে তাঁর কর্মকান্ড ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৫-৬৯ সালের মধ্যে ভেনেজুয়েলা, কলম্বো, তানজানিয়া, রোম, অস্ট্রেলিয়া, জর্ডন, নিউ ইয়র্ক প্রভৃতি জায়গায় গড়ে ওঠে 'মিশনারি অব চ্যারিটি'।চিরন্তনী জননীর রূপ প্রত্যক্ষ করে সারা বিশ্বের মানুষ ধন্য হয়। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে করুণাময়ী জননী মাদার টেরেসার নাম।ভারতের বাইরে তাঁর প্রথম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে ভেনিজুয়েলায়। মাত্র ৫ জন সন্ন্যাসিনীকে নিয়ে সে কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তাঁর মহৎ কীর্তির বিভিন্ন স্বীকৃতিএল দেশ দেশান্তর হতে। ১৯৯৭ সালে ৫ই সেপ্টেম্বর এই বিশ্ব জননী চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হলেও আমাদের কাছে তিনি অমর হয়েই থাকবেন।
২০১৬ সালে পোপ ফ্রান্সিস তাকে 'সন্ত' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং ক্যাথলিক গির্জায় তিনি ভারতের 'কলকাতার সন্ত টেরিজা' হিসেবে আখ্যায়িত হন।
No comments:
Post a Comment