![]() |
রামকৃষ্ণ পরমহংস |
ভক্তিমতী রাণী রাসমণিও নেই, অনুগত সেবক মথুর বাবুও নেই। এখনকার কর্তাদের জমিদারি মেজাজ, দক্ষিণেশ্বর মন্দির নিয়ে তারা বিশেষ মাথা ঘামান না। রামকৃষ্ণ অসুস্থ হয়ে পড়লেও খোঁজখবর নিলেন না কর্তারা। দিন দিন ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে, সারাদিন ধরে মানুষ আসে,তারা দর্শন চায়, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। কথা বলতে বলতে গান আসে, এক সময় ভাবাবেশে মূর্ছা যান। ইদানীং রামকৃষ্ণ পরমহংসের শরীর কৃশ হয়ে আসছে, মাঝেমধ্যে কাশির দমক আসে, তখন খুবই দুর্বলতা ও যন্ত্রণা বোধ করেন।
রামকৃষ্ণ পরমহংসের অবস্থাপন্ন ভক্তরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু ডাক্তারদের ওষুধে কাজ হয় না। ব্যাথা ক্রমশই বাড়ছে। একদিন পরমহংসকে গাড়িতে করে তালতলায় এনে বিখ্যাত ডাক্তার দূর্গাচরণ বন্ধ্যোপাধ্যায়কে দেখানো হয়। এই দুর্বল শরীরে তাঁকে বারবার কলকাতায় আনা যায় না, আর ব্যস্ত ডাক্তারও দক্ষিণেশ্বরে যেতে চাইবেন না।দক্ষিণেশ্বরের ঘরটিও স্বাস্থ্যকর নয়।স্যাঁতসেঁতে। অবিরাম গঙ্গার জলো হাওয়া আসে।প্রাতঃকৃত্য সারবার জন্য তাঁকে অনেকটা দূরে যেতে হয়, তাতে তাঁর এখন কষ্ট হয়।
রামকৃষ্ণের উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য ভক্তরা তাঁকে কলকাতায় এনে রাখবেন ঠিক করলেন। বাগবাজারে গঙ্গার ধারে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল। এক সকালবেলায় দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে বাগবাজারের ভাড়া বাড়িতে গেলেন। গঙ্গার ধারেই বেশ নিরিবিলি পরিবেশে বাড়ি রামকৃষ্ণের বাড়ি পছন্দ হল না। পরিশেষে রামকান্ত বসু স্ট্রিটে রামকৃষ্ণের সংসারী ভক্তদের অগ্রগণ্য বলরাম বসুর বাড়ি রামকৃষ্ণের থাকার ব্যবস্থা হল। এলোপ্যাথিক ওষুধ তাঁর সহ্য হয় না, তাই নাম করা হোমিওপ্যাথ প্রতাপচন্দ্র মজুমদারকে ডাকা হয়েছে। তাঁর ওষুধে সাময়িক ভাবে ব্যাথার নিবৃতি হয় কিন্তু মূল রোগ বেড়েই চলেছে। এখন কাশির সাথে রক্ত পড়ে, শক্ত কিছুই খেতে পারেন না রামকৃষ্ণ। নানান চিকিৎসকেরঅভিমত শুনে বোঝা যাচ্ছে সহজ রোগ এটা না।প্রখ্যাত কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদ সহ একদল কবিরাজ রামকৃষ্ণকে দেখলেন। রোগের উপসর্গ শুনে ও রামকৃষ্ণের গলা পরীক্ষা করে গঙ্গাপ্রসাদ ভক্তদের বললেন এ রোগের নাম রোহিণী, ইংরেজ ডাক্তাররা যাকে বলে ক্যান্সার যার চিকিৎসা তাদের সাধ্যের অতীত। এই শ্যাম পুকুরের বাড়িতেই রামকৃষ্ণের শিষ্য মন্ডলি আস্তে আস্তে জমা হতে থাকল। অনেক ডাক্তারই তো দেখানো হচ্ছে, একবার মহেন্দ্রলাল সরকারকে ডাকার কথা ওঠে। ধন্বন্তরি বলে তাঁর নাম রটেছে। প্রতাপ মজুমদারেরও সেই মত। সেই মত মহেন্দ্রলাল সরকারকে ডাকা হল। শ্রী রামকৃষ্ণের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে দিন দিন। একনাগারে কাশি ও রক্তপাত। কোন খাবারই গলা দিয়ে নামতে চায় না।
ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার পরামর্শ দিলেন যে কলকাতার দূষিত আবহাওয়ায় রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে। রামকৃষ্ণ চিরদিন খোলা মেলা জায়গায় থেকেছেন। সেই জন্য রামকৃষ্ণকে স্বাস্থ্যকর খোলা মেলা জায়গায় রাখা দরকার।রামকৃষ্ণের দক্ষিণেশ্বরের সে ঘরটির প্রতি এখন আর কোনো টান নেই। ভক্তরা ঠিক করল কলকাতার বাইরে কোথাও একটা বাড়ি ভাড়া নিতে হবে।অনেক অনুসন্ধানের পর কাছাকাছির মধ্যে বাগবাজারের খাল পেরিয়ে বরানগরের পথে কাশীপুরে একটি উদ্যান বাটি মাসিক আশি টাকায় ভাড়া পাওয়া গেল । এগারো বিঘার বেশী জমির মাঝখানে দোতলা বাড়ি, চারিদিক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, ভেতরে দুটি পুকুর ও নানারকম ফুল ফলের বাগান। কাশীপুরের বাড়িতে যেতে রামকৃষ্ণ সন্মত হয়েছেন। অঘ্রান মাসের শুক্লাপঞ্চমীর দিনে দুটো ঘোড়ার গাড়িতে কাশীপুরের দিকে যাত্রা শুরু হল। একটা গাড়িতে রামকৃষ্ণ ও সারদামণি আর নরেন। অন্য গাড়িতে কয়েক জন ভক্ত।বাড়িটির দোতালার ঘরে রামকৃষ্ণর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। নিচের বড় হল ঘরটা বসার জায়গা। তার পাশের ঘরে থাকবে ভক্তরা। উত্তর দিকে কোনের ঘরটাতে থাকবেন সারদামণি।
ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার জানতেন যে রামকৃষ্ণের ভক্তরা তাঁর ওষুধের ওপরে পুরোটা ভরসা না করে এলোপ্যাথিক. বায়োকেমিক, কবিরাজি ইত্যাদি কোনো কিছুই বাকি রাখেনি। সারদামণি তারকেশ্বরে হত্যে দিয়েও এসেছেন। মহেন্দ্রলাল আপত্তি করেননি। এ রকম হলে সাধারণত বড় ডাক্তাররা রুগির দায়িত্ব নিতে চান না। কিন্তু মহেন্দ্রলালের অহংবোধ বাধার সৃষ্টি করেননি।
না ডাক পেলেও মহেন্দ্রলাল নিজে থেকেই কাশীপুরে চলে যেতেন।অবশেষে সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে ১৮৮৬ সালের ১৬ই অগষ্ট বেলা সাড়ে এগারোটায় তাঁর প্রাণবায়ু বহির্গত হয়। বিকালে কাশীপুরের শ্মশানে তাঁর শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়।
No comments:
Post a Comment