29 July 2021

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ১৩০ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ১৩০ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি। বিদ্যাসাগরের কর্মজীবনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলন, দ্বিতীয়ত শিক্ষাসংস্কার ও শিক্ষাপ্রসারে ভৃমিকা,তৃতীয়ত ভাষা ও সাহিত্যে ঐতিহাসিক ভূমিকা। কঠোরতা ও কোমলতার অপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত বিদ্যাসাগরের চরিত্র আমাদের একদিকে যেমন অভিভূত করে অপরদিকে যোগ্যতার সহিত তিন পর্যায়ের কর্মধারাকে বাস্তবে পরিণত করার প্রচেষ্টাকে আমরা প্রশংসা না করে পারি না। বিদ্যাসাগরের মতো মানুষ সত্যিই বিরল আমাদের অনেক কিছু করার আছে ঊনবিংশ শতাব্দীর মহাপ্রাণ মানুষ টির প্রতি যোগ্য সন্মান আর একনিষ্ঠ শ্রদ্ধা জানাবার। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলকাতা বিশ্যবিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠিতা সদস্য ছিলেন। মাতৃভক্তির জন্য তাঁর নাম কিংবদন্তী হয়ে আছে। চিরদিন তিনি গোঁড়ামি, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। রামমোহনের সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ হবার ফলে কৌলিন্য প্রথা ও বহু বিবাহ রদ হওয়ায় সমাজে বিধবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হয় তাঁরই প্রচেষ্টায়। তাঁকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। স্কুল বিভাগের শিক্ষার জন্য তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন। বর্ণপরিচয়, কথামালা, চরিতাবলী, শকুন্তলা, সীতার বনবাস প্রভৃতি রচনা করে বাংলা ভাষার বল সঞ্চয় করে ছিলেন। এছাড়া তিনি সম্পাদনা করেছিলেন উত্তররামচরিত, রঘুবংশ সন্দর্ভ সংগ্রহ, কুমারসম্ভব, কাদ্ম্বরী, মেঘদূত প্রভৃতি গ্রন্থ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আর মা ভগবতী দেবী। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে সুপন্ডিত ব্যক্তি। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় স্বল্প বেতনের চাকরি করতেন। সেই কারণে ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশব তাঁর মা ও ঠাকুরমার সাথে কাটে। ঈশ্বরচন্দ্র ছেলেবেলায় খুব দুরন্ত হলেও খুব বুদ্ধিমান ছিলেন। গ্রামের পাঠশালায় মন দিয়ে পড়াশোনা করে অল্প দিনেই সব শিখে ফেলেন। ছেলে লেখাপড়া শিখুক এটাই ঠাকুরদাসের ইচ্ছা। অল্প মাইনের চাকরি করলেও সাহস করে ছেলেকে উচ্চ শিক্ষা দেবার জন্য নিয়ে চললেন কলকাতায়। সেই সময় রেল গাড়ি ছিল না। বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলকাতা অনেক দূর। ছেলের হাত ধরে ঠাকুরদাস হাঁটা পথেই কলকাতা রওনা দিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র পথের ধারে মাইল পোস্ট দেখে ইংরাজি সংখ্যা গুলো শিখে নেন কলকাতা পৌঁছনোর আগেই। কলকাতায় ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। খুব কষ্টকরে ঈশ্বরচন্দ্র পড়াশোনা শুরু করেন। বাড়ির সব কাজ তাঁকে করতে হত। রান্না করা, বাসন মাজা সব কিছুর মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে যান। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি সাহিত্য, অলঙ্কার, ব্যাকরণ, সংস্কৃত সহ আরও কিছু বিষয় আয়ত্ত করে ফেললেন। পরীক্ষায় সকলের চেয়ে বেশি নম্বর নিয়ে বৃত্তি পেলেন। তাঁর পান্ডিত্য দেখে দেশের পন্ডিতবর্গ তাঁকে বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন বিদ্যাসাগরের বয়স মাত্র কুড়ি। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র তখন চাকরিতে যোগ দেন।১৮৪১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেডপন্ডিতের পদ পান ঈশ্বরচন্দ্র। ঈশ্বরচন্দ্র দানশীলতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁকে 'দয়ার সাগর' বলা হত।গভীর মানবতাবোধ ও পরদুঃখ কাতরতা তাঁকে দয়ার সাগরে পরিণত করে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্যারিসে থাকাকালীনবেহিসেবী খরচের ফলে অর্থসঙ্কটে পড়লে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর টাকা পাঠিয়ে মাইকেলকে সাহায্য করেছিলেন। বাঙালি জাতি প্রথম বড় হবার, যোগ্য, মানবিক, আধুনিক, প্রগতিশীল ও বিশ্বজনীন হবার দৃষ্টান্ত খুঁজে পেয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্রের মধ্যে।তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি-"তিনি হিন্দু বা বাঙালি ব্রাহ্মণ ছিলেন না। তাঁর মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয় বট তিনি বঙ্গভুমিতে রোপণ করে গেছেন, তার তলদেশ জাতির তীর্থস্থান হয়েছে"। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন-"আমি যে দরিদ্র বাঙালি ব্রাহ্মণকে শ্রদ্ধা করি তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।" এই মহাপুরুষ ৭১ বছর বয়সে ১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই আমাদের ছেড়ে চলে যান।

23 July 2021

২০২১ সালের ২৩শে জুলাই বাল গঙ্গাধর তিলকের ১৬৫তম জন্ম বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

 


সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের জনক, শিবাজির আদর্শে অনুপ্রাণিত ও কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতারূপে বাল গঙ্গাধর তিলক ঊনবিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশক হতে বিংশ শতাব্দীর প্রথম  দুইশতক পর্যন্ত সুনাম অর্জন করে ছিলেন। 

তিনি পুনা কলেজ হতে বি, এ পাশ করে  আইন  পরীক্ষায় উত্তীর্ণ  হয়ে পুনার বিখ্যাত নিউ ইন্ডিয়ান  ইস্কুলের শিক্ষক হন।

এ সম য় তিনি সরকারের দোষ ত্রুটি তুলে ধরার জন্য  কেশরী ও মারাঠা নামক দুটি  সংবাদপত্র চালু করেন।

তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম নেতা ছিলেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ভারতীয় অস্থিরতার পিতা বলতেন। তাঁকে আরও সন্মানসুচক লোকমান্য বলা হত, যার অর্থ "জনগণ দ্বারা গৃহীত" (নেতা হিসাবে)। 

ভারতের জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের জনক বালগঙ্গাধর তিলক। এককথায় তাঁকে বিশেষিত করা দুঃসাধ্য। তিনি ছিলেন একাধারে সমাজসংস্কারক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, জাতীয় নেতা আবার অন্যদিকে ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃত, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও হিন্দুদর্শনে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী।  স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘স্বরাজ আমাদের জন্মগত অধিকার এবং আমরা তা অর্জন করবই’। তিলকের এই উক্তি উদ্বুদ্ধ করেছিল লক্ষ লক্ষ মানুষকে।

১৮৫৬ সালের ২৩শে জুলাই মহারাষ্ট্রের রত্নগিরিতে চিৎপাবন ব্রাহ্মণ বংশে তিলকের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং গণিতে তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তিনি অন্যায় অবিচার একেবারেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। সত্যের প্রতি ছিলেন অবিচল। তিলক ছিলেন ভারতের যুবকদের মধ্যে প্রথম প্রজন্ম যাঁরা আধুনিক কলেজ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। তিলক গণিতে প্রথম শ্রেণির স্নাতক হন এবং তারপর আইন পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন । তিলকের কর্মজীবন শুরু হয় গণিতের শিক্ষকতার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে তিনি সাংবাদিকতার কাজ গ্রহণ করেন। পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থায় ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি অশ্রদ্ধার ভাব তাঁকে পীড়া দিত এবং এ কারণেই তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবল সমালোচনা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন ‘ডেকান এডুকেশন সোসাইটি’ ভারতীয় যুবকদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য। এর পরের বছরই তিনি দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতে শুরু করলেন – ‘কেশরী’ যেটি মারাঠি ভাষায় মুদ্রিত হত এবং ‘মারাঠা’ যার ভাষা ছিল ইংরেজী। তাঁর পত্রিকায় তিনি দেশের মানুষের প্রকৃত দুরবস্থার স্পষ্ট চিত্র এঁকেছিলেন। জ্বালাময়ী ভাষায় তিনি ঘুমন্ত ভারতবাসীদের জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দুটি পত্রিকাই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।বালগঙ্গাধর তিলকের রাজনৈতিক জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন ১৮৯০ সালে। এছাড়াও তিনি পুণে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এবং বম্বে বিধানমণ্ডলের সদস্য ছিলেন এবং তিনি বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ নির্বাচিত হন। সমাজসংস্কারমূলক কাজেও তাঁর মহৎ ভূমিকা ছিল। তিনি বাল্যবিবাহের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন এবং বিধবা বিবাহের পক্ষে ছিলেন। গণপতি উৎসব এবং শিবাজীর জন্মোৎসব পালনের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষকে একত্র করতে চেয়েছিলেন। 

১৮৯৭ সালে তিলকের বিরুদ্ধে বৃটিশ সরকার অভিযোগ আনে যে তিনি জনগণের মধ্যে বৃটিশ সরকারের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব জাগিয়ে তুলছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এবং আইন ও শান্তি ভঙ্গ করছেন। এই অভিযোগে তিনি জেলবন্দী হন দেড় বছরের জন্য। ১৮৯৮ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিলক স্বদেশী আন্দোলন শুরু করেন। সংবাদপত্র এবং বক্তৃতার মাধ্যমে তিলক মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে স্বদেশী আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন এমনকি তাঁর বাড়ির সামনে স্বদেশী জিনিসের বাজারও খোলা হয়।

ভারতের জাতীয় রাজনীতিও এই সময় থেকেই অন্য দিকে বাঁক নেয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় – নরমপন্থী এবং চরমপন্থী এই দুই মতবাদে। এতদিন যেখানে নরমপন্থী নেতৃত্বগণ ইংরেজ সরকারের প্রতি আবেদন-নিবেদন নীতিতেই বিশ্বাসী ছিলেন, সেখানে চরমপন্থীদের দাবী হল স্ব-শাসন। বলা বাহুল্য, চরমপন্থীদের নেতৃত্ব দেন বাল গঙ্গাধর তিলক। ১৯০৬ সালে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অপরাধে তিনি গ্রেফতার হন। ছয় বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর বার্মার মান্দালয় জেলে। এই দীর্ঘ সময় তিনি জেলের ভেতর লেখাপড়াতেই অতিবাহিত করেন। ‘গীতা-রহস্য’ তাঁর এই সময়ের রচিত গ্রন্থ। ১৯১৪ সালের ৮ই জুন তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। তিলক কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী মতবাদকে একত্রীভূত করতে চেষ্টা করলেও সে চেষ্টা সফল হয় নি। অবশেষে তিনি একটি পৃথক সংগঠন স্থাপন করেন – ‘হোমরুল লীগ’। এর উদ্দেশ্য ছিল স্বরাজ। বালগঙ্গাধর তিলক গ্রামে গ্রামে ঘুরে স্বরাজের অর্থ আপামর ভারতবাসীর মনে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে শরিক করতে চেয়েছিলেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে। ‘হোমরুল লীগ’ এর কার্যপদ্ধতি গ্রামে গ্রামে ঘুরে সকলকে বুঝিয়ে তাদের হৃদয়ে স্বাধীন ভারতের চিত্র অঙ্কন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি জীবদ্দশায় ক্রমাগত ভ্রমণ করে গেছেন মানুষকে সংঘটিত করার জন্য। মানুষের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য বাল গঙ্গাধর তিলকের এই আত্মত্যাগ তাঁকে মহীয়ান করে তুলেছে। 

১৮৯০ সালে তিনি  শিবাজি উৎসবের ব্যবস্থা করেন। এই উৎসব সারা ভারতে  ছড়িয়ে  পড়লে ভারতবাসীর  মনে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয়। 

১৯০২ এবং ১৯০৪ সালে কলকাতায় শিবাজি উৎসব পালিত হয়। কবিগুরু  রবীন্দ্রনাথ ১৯০৪ সালে শিবাজি উৎসব কবিতাটি  সভায়  পাঠ করেন। চরমপন্থীরা ১৯০৫ সালে কলকাতায় শিবাজি উৎসবের ব্যবস্থা করলে তাতে  বাল গঙ্গাধর তিলক যোগ দেন।

১৮৯৭ সাল। মহারাষ্ট্রে প্লেগ মহামারীরূপে দেখা দিল। এক বৃটীশ অফিসার – পুণে শহরে মানুষের উপর নির্দয় ব্যবহারের জন্য যিনি কুখ্যাত ছিলেন – সেই অফিসার র‍্যাণ্ড প্লেগ কমিশনার নিযুক্ত হলেন। প্লেগ দমনে র‍্যাণ্ড অত্যন্ত অশোভন আচরণ শুরু করলেন। জোর করে শহর খালি করে দিতে লাগলেন এবং গোরা সৈন্যদের নিযুক্ত করা হল প্লেগ নিবারণের জন্য। তারা বাড়ি বাড়ি ঢুকে যুবতী মেয়েদের গা টিপে দেখতে লাগল প্লেগ হয়েছে কি না। প্লেগ রোগ নির্ণয় করা এবং তার চিকিৎসা করা গোরা সৈন্যদের কাজ নয় এবং প্লেগ বেছে বেছে যুবতী মেয়েদের দেহেই বাসা বাঁধে না। গোরা সৈন্যদের বদ মতলব সম্বন্ধে মারাঠা মানুষদের মনে আর কোন সংশয় রইল না। এই ঘটনায় সমগ্র মারাঠা সমাজে প্রচণ্ড অসন্তোষ দেখা দিল ও মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। লোকমান্য তিলক তাঁর ‘কেশরী’ পত্রিকায় লিখলেন, ‘এর চেয়ে প্লেগ অনেক ভাল’। কিন্তু কিছুতেই বৃটীশ সরকার র‍্যাণ্ডকে অপসারিত করল না প্লেগ কমিশনারের পদ থেকে। অবশেষে দামোদর চাপেকার এবং তার বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে সরিয়ে দিতে হবে এই ঘৃণ্য অফিসারটিকে। ১৮৯৭ সালের ২২শে জুন রাতে এল সুযোগ। রানী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যাভিষেকের ষাট বছর পূর্তির উৎসব শেষে র‍্যাণ্ড এবং আর এক অফিসার লেফটেন্যান্ট আয়ার্স্ট যখন পুণে সরকারী ভবন থেকে ফিরছেন তখন একটি নির্জন স্থানে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে দামোদর এবং তাঁর ভাই বালকৃষ্ণ চাপেকার গুলি করে হত্যা করে তাদের। লেফটেন্যান্ট আয়ার্স্ট সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। গুরুতর আহত অবস্থায় র‌্যান্ডকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েকদিন পর র‌্যান্ডের মৃত্যু হয়।

ভারতে বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য স্যার রাউলাটের অধীনে একটি কমিশন গঠিত হয়। রাউলাট কমিটি এই হত্যাকে ভারতের প্রথম বৈপ্লবিক হত্যা বলে অভিহিত করে। এ সময়ে তিলককে এই হত্যার  প্ররোচনার দায়ে গ্রেপ্তার  করা হয়। দোষ প্রমানিত  না হলেও  তিলককে ১৮ মাস কারাদন্ড দেওয়া হয়। ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরামের মজফ্ফরপুরে বোমা ফেলার ঘটনাকে সমর্থন করে কেশরী  পত্রিকায় জোরালো বক্তব্য  লেখার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে  রাজদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হলে ৬ বছর কারাদন্ড হয়।তাঁকে মান্দালয়ে পাঠানো হয়।

বাল গঙ্গাধর তিলক ছিলেন  ধার্মিক  মানুষ। ভারতের প্রধান ধর্মশাস্ত্র - গীতা, বেদ প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁর গভীর  জ্ঞান ছিল। তিনি বেদের কাল নির্ণয় করেন এবং  হিন্দু  ধর্মের প্রাচীনত্ব নিয়ে 'আর্কটিক হোম ইন দি বেদস' নামক গ্রন্থ প্রকাশ করে পাশ্চাত্য দেশে সুনাম  অর্জন করেন। 'উত্তর মেরুতে  আর্যনিবাস' নামক গ্রন্থ তাঁর বিরাট অবদান।মান্দালয়ে নির্বাসনকালেই তিনি গীতা সম্বন্ধীয় পুস্তক  রচনা  করেন।

বলা বাহুল্য, বিচারে দামোদর চাপেকারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়। জেলে থাকাকালীন বালগঙ্গাধর তিলক দামোদরকে শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। ১৮৯৮ সালের ১৮ই এপ্রিল পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে দামোদর চাপেকারের ফাঁসি হয়। সেই সময় তাঁর হাতে ছিল গীতা এবং তিনি আবৃত্তি করছিলেন গীতার শ্লোক।

বাল গঙ্গাধর তিলক ছিলেন  কর্মযোগী পুরুষ এবং তাঁর জীবন  কর্মবহুল ছিল। একদিকে তিনি বিশাল  জাতির শিক্ষক, নেতা, কর্মযোগী, নিষ্ঠাবান  ব্রাহ্মণ, চিন্তাশীল ব্যক্তি, দৃঢ়চেতা সাংবাদিক, অপরদিকে তিনি সমাজসেবক, দেশসেবকও রাজনীতিবিদ। ১৯২০সালের ১লা আগস্ট  তাঁর দেহাবসান ঘটে। 


 





 









21 July 2021

যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি


স্বাধীনতার দাবিতে বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন শতকে ভারতের আকাশ বাতাস মুুখরিত হয়ে ওঠে।ভারতের শ্রেষ্ঠ  সন্তান
 দের যৌথ প্রচেষ্টায় শৃঙ্খলিত ভারতের মুক্তি  ও স্বাধীনতা আন্দোলন সে যুগে তীব্র  আকার ধারণ করেছিল। ওই সমস্ত শ্রেষ্ঠ  সন্তানদের একজন হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। ১৮৮৫ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ধরবা গ্রামে জন্মগ্রহণ  করেন।

দক্ষিণ কলকাতার একটি খেলার  মাঠ দেশপ্রিয় পার্ক বা উদ্যানটির নামকরণ হয় জাতীয়তাবাদী ব্যারিস্টার  যতীন্দ্রমোহন  সেনগুপ্তর নামে।

দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ১৯০২ সালে হেয়ার স্কুল হতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৪ সালে বিলেতে যান উচ্চশিক্ষার্থে। ১৯০৮ এ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে বি.এ. এবং ১৯০৯ সালে ব্যারিস্টারি পাশ করেন। ওখানে তার আলাপ ও প্রনয় হয় ইংরেজ মহিলা নেলী গ্রে'র সাথে। যিনি যতীন্দ্রমোহনকে ১৯০৯ সালে বিবাহ করে নেলী সেনগুপ্তা হন। নেলী সেনগুপ্তা নিজেও অসামান্য সমাজকর্মী ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে ভারতে সমুজ্জ্বল হয়েছেন।যতীন্দ্রমোহন ব্যারিস্টারি পাশ করে কলকাতায় আইন ব্যবসা শুরু  করেন।

যতীন্দ্রমোহন ১৯১০ সালে কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন এবং আইনজীবী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। মাঝে কিছুদিন রিপন কলেজে (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজ) আইনের শিক্ষকতা করেন।অগ্নিযুগের বহু বিপ্লবীকে নিশ্চিত ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন তার অসামান্য দক্ষতায়। ১৯২৩ সালে দ্বিতীয় আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় তার কৃতিত্বপূর্ণ সওয়ালে সাতজন বিপ্লবী মুক্ত হন। স্বেচ্ছায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পক্ষ নিয়ে আদালতে লড়াই করতেন। ভারতবর্ষ থেকে বার্মাকে বিচ্ছিন্ন করার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে যোগ দিতে যতীন্দ্রমোহন রেঙ্গুন যান। সেখানে জনসমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। যতীন্দ্রমোহন ১৯২২ সালে জাতীয় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হন। পরবর্তী সময়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বরাজ পার্টি প্রতিষ্ঠা করলে যতীন্দ্রমোহন স্বরাজ পার্টিতে যোগ দেন। ১৯২৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর (১৯২৫) যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত স্বরাজ পার্টির বিশেষ অধিবেশনে দলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি মোট ৫ বার কলকাতার মেয়র হন।

১৯৩০ সালে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের আস্থায়ী  সভাপতি  ছিলেন। ওই বছর  ২৫শে অক্টোবর   জালিয়ানওয়ালাবাগে রাজদ্রোহমূলক বক্তৃতা দেওয়ার পরে গ্রেপ্তার  হন এবং মুক্তি পেয়ে বিলেতে যান। চট্টগ্রামে পুলিশি অত্যাচার ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিলেতে গিয়ে জোরালো প্রতিবাদ করেন। তার দেওয়া তথ্য, ছবি ইত্যাদির ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার নেলসন অপসারিত হন। এছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ক্রেগ অবসর পুলিশ সুপার স্যুটার আত্মহত্যা করেন। ফলত সরকারের রোষানল তার ওপর পড়ে। কমিশনার টেগার্ট তখন বিলেতে ছিলেন। তিনি সরকারকে জানান যতীন্দ্রমোহন অহিংসবাদী নন। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবীদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগকারী ও মদতদাতা। পুলিশ দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বোম্বাই বন্দরে তাকে গ্রেপ্তার করে যারবেদা জেল ও পরে দার্জিলিং এ অন্তরীণ করে পাঠায়। অসুস্থ হয়ে পড়লেও উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে দেয়নি পুলিশ।১৯৩৩ সালের ২২শে জূলাই কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।