30 April 2020

আনন্দময়ী মা আধ্যাত্মিক সাধিকার জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আনন্দময়ী মা ছিলেন একজন  আধ্যাত্মিক সাধিকা ১৮৯৬ সালের ৩০ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার খেওড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল একই জেলার  বিদ্যাকুট গ্রামে। পিতা বিপিনবিহারী ভট্টাচার্য মুক্তানন্দ গিরি নামে সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করেন।

আনন্দময়ী মায়ের প্রথম জীবনে নাম ছিল নির্মলা। তাঁর জন্মের আগে চার ছেলে জন্মেছিল তাঁর মায়ের। কিন্তু একজনও বাঁছেনি। এরপরেই নাতি চেয়ে  জাগ্রত কালী বাড়ির দোর ধরেন নির্মলার ঠাকুমা। কিন্তু দেবী তাঁকে জানান, ছেলে নয়, মেয়ে আসবে তাঁর পরিবারে। মা অন্নপূর্ণা রূপে। একই সঙ্গে নির্মলার মা স্বপ্নে নির্দেশ পান বিষ্ণুর অবতার জন্ম নেবে তাঁর গর্ভে। জন্মের দিন প্রবল ঝড়-বৃষ্টি সকাল থেকে। কিন্তু মায়ের জন্মের ঠিক আগে মেঘ কেটে আলোয় আলো চারিদিক। তারপরেই মায়ের কোল আলো করে জন্ম নেয় নির্মলা। নবজাতকের রূপ দেখে পরিবার  নাম রেখেছিলেন নির্মলা।

ছোট থেকেই যাঁর জীবন ঈশ্বরের লীলাক্ষেত্র। আনন্দময়ী মা শিশু অবস্থা থেকেই ঈশ্বরের নানা রূপ দেখতে পেতেন। শোনা যায়, তাঁর জন্মলগ্নে গ্রহনক্ষত্রের অবস্থানই ঠিক করে দিয়েছিল যে তিনি সাধারণ নন। তাঁর মধ্যে ঈশ্বরচেতনার বিকাশ হয় শৈশব থেকেই। তিনি বলতেন, ”খণ্ড আনন্দে প্রাণ তৃপ্ত হইতেছে না, তাই মানুষ অখণ্ড আনন্দ পাইবার জন্য অখণ্ডের সন্ধান করিতেছে।’ এই আনন্দের জন্যই তাঁর জীবন কেটেছে সাধনায়। কৈশোরে এবং পরবর্তীকালে বিবাহিত জীবনেও তিনি ভাবজগতে বেশিরভাগ সময় ডুবে থাকতেন বলে জানা যায়। তিনি বলতেন 'সংসারটা ভগবানের; যে যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় থেকে কর্তব্যকর্ম করে যাওয়া মানুষের কর্তব্য।’ সংসারীদের জন্য আনন্দময়ী মা বলতেন ভগবানের নাম নেবার জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করতে। সারাদিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে, মাত্র ১ ঘন্টার ৪ ভাগের এক ভাগ সময় অর্থাৎ নির্দিষ্ট ১৫ মিনিট সময় নির্ধারণ করে ভগবানের নাম নিতে। সে সময় যেখানেই থাকো সেখানেই ঈশ্বরের নাম নেবে বা স্মরণ বা ধ্যান করবে। সেই সময়টা শুধু মাত্র ঈশ্বরের জন্য, সে সময় মুখে কথা বলবে না। মৌন থাকবে।

আন্দময়ীর প্রকৃত নাম নির্মলা সুন্দরী; দাক্ষায়ণী, কমলা ও বিমলা নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না বললেই চলে। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে বিক্রমপুরের রমণীমোহন চক্রবর্তীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। স্বামীও পরবর্তীকালে সন্ন্যাস গ্রহণ করে ভোলানাথ নামে পরিচিত হন। রমণীমোহন ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার নবাবের বাগানের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হলে নির্মলা তার সঙ্গে শাহবাগে চলে আসেন এবং সিদ্ধেশ্বরীতে কালীমন্দির (১৯২৬) প্রতিষ্ঠা করে ধর্মকর্মে আত্মনিয়োগ করেন।এই মন্দিরেই একদিন দিব্যভাবে মাতোয়ারা নির্মলা আনন্দময়ী মূর্তিতে প্রকাশিত হন এবং তখন থেকেই তাঁর নাম হয় আনন্দময়ী মা। প্রথম প্রথম তাঁর ভাবসমাধির কারণ বুঝতে পারতেন না কাছের লোকজন। কিন্তু আস্তে আস্তে তাঁর স্বামীও আনন্দময়ী মায়ের মধ্যে ঈশ্বরচেতনাকে উপলব্ধি করেন। শোনা যায় তাঁর স্বামী বাবা ভোলানাথ, কালীপুজোর সময়ে আনন্দময়ীকেও একই রূপে দেখতেন এবং তখন তিনিও আনন্দময়ীকে মা রূপে পুজো করতেন।

ঢাকার রমনায় তাঁর আশ্রম গড়ে ওঠে। তাঁর আধ্যাত্মিক ভাবধারায় অনেক গুণিজন আকৃষ্ট হন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুজন হলেন মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ এবং ডাক্তার ত্রিগুণা সেন। মা আনন্দময়ীনৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করও নৃত্য সম্পর্কে আনন্দময়ীর বিশ্লেষণ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আনন্দময়ীর মতে জগৎটাই নৃত্যময়; জীবের মধ্যে যে প্রাণের স্কন্দন, এমনকি বীজ থেকে যখন অঙ্কুরোদগম হয় তখন সেখানেও এক ধরনের তরঙ্গময় নৃত্যের সৃষ্টি হয়। এই তরঙ্গরূপ নৃত্য যে মূল থেকে উদ্ভূত হয়, একসময় স্তিমিত হয়ে আবার সেই মূলেই মিলিয়ে যায়। এই রূপকের মধ্য দিয়ে তিনি মূলত জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ককেই নির্দেশ করেছেন
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দময়ী স্বামীর সঙ্গে উত্তর ভারতের দেরাদুনে চলে যান এবং সেখানে তাঁর লীলাক্ষেত্র ক্রমশ সম্প্রসারিত হয়। তিনি মানুষকে আধ্যাত্মিক ভাবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন। তাঁর একটি বিশেষ কীর্তি হলো প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান নৈমিষারণ্যের পুনর্জাগরণ ঘটানো। সেখানে গিয়ে তিনি নতুন করে মন্দির স্থাপন এবং যজ্ঞ, কীর্তন, নাচ-গান ইত্যাদির মাধ্যমে ভগবৎসাধনার ক্ষেত্র তৈরি করেন। এভাবে মানুষকে সুন্দর জীবনযাপনে অভ্যস্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে পুরাতন তীর্থসমূহের সংস্কার সাধন এবং নতুন নতুন তীর্থস্থান প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের রমনা ও খেওড়াসহ ভারতের বারাণসী, কনখল প্রভৃতি স্থানে তার নামে আশ্রম, বিদ্যাপীঠ, কন্যাপীঠ, হাসপাতাল ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। তাঁর নামে এরূপ মোট ২৫টি আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছ।  ১৯৮২ সালের ২৭ আগস্ট ৮৭ বছর বয়সে   তিনি দেহত্যাগ করেন। তাঁর মরদেহ উত্তর ভারতের হরিদ্বারে কনখল আশ্রমে গঙ্গার তীরে সমাধিস্থ হয়।শোনা যায় আনন্দময়ী মা-কে তাঁর ভক্তরা কখনও ছিন্নমস্তার মূর্তিতে, কখনও ভুবনেশ্বরী মূর্তিতে আবার কখনও বা সরস্বতী রূপে দেখেছিলেন।

 ১৯৮২ সালে মহাসমাধিতে বিলীন হওয়ার পরে ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন, ”আমার জীবনে মা আনন্দময়ীর আশীর্বাদ ছিল প্রধান শক্তি ও ভরসা। আজ আমার মর্মবেদনা জানাবার ভাষা নেই।”

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।




23 April 2020

২৩শে এপ্রিল, ভারতের তথা বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ে ২৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী।

২৩শে এপ্রিল, ২০২০ সাল কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ২৮ তম  মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি। ২৩শে এপ্রিল, ভারতের তথা বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ে ২৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, প্রকাশক,অনুবাদক, কাহিনীকার, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক।

১৯২১ সালের ২রা মে কলকাতা শহরের ১০০ নম্বর গড়পার রোডের এক খ্যাতনামা বাঙালি পরিবারে জন্মেছিলেন সত্যজিৎ রায়।  এই বাড়ির একতলাতেইছিল ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছাপাখানা। সত্যজিতের পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ ছিলেন বহুমুখী এবং তাঁর কাজের পরিমাণ বিপুল। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সত্যজিৎ চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ন, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, চিত্রগ্রহণ, শিল্প নির্দেশনা, সম্পাদনা, শিল্পী-কুশলীদের নামের তালিকা ও প্রচারণাপত্র নকশা করা সহ নানা কাজ করেছেন।

মানিক

সত্যজিৎ রায়ের জন্মের ছ বছর আগে মারা যান ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়। আর সত্যজিৎ রায়ের বয়স যখন  তিন  বছর তিনি তাঁর পিতা সুকুমার  রায়কে হারান। তাঁরা রেখে গিয়েছিলেন পারিবারিক ঐতিহ্যের সার্থক উত্তরাধিকারী বিশ্বসেরা  সত্যজিৎ রায়েকে। তবে তারা কেউই সত্যজিৎ রায়ের সাফল্য দেখে যেতে পারেননি।

বিধবা সুপ্রভবা দেবী ও পারিবারের  অন্যান্যদের সহচর্যে ছোট্ট সত্যজিৎ বড় হতে থাকলেন।

সত্যজিৎ রায়ের ডাক নাম ছিল মানিক। ' যখন ছোট ছিলাম ' গ্রন্থে  সত্যজিৎ  লিখেছিলেন- 'আমি যখন ইস্কুলে ভর্তি হই তখন আমার বয়স সাড়ে আট'। ফিফথ ক্লাসে (পরে নাম হয়েছিল ক্লাস সিক্স) ভর্তি হবার জন্য সত্যজিৎ লেবুমামার সাথে হাজির হন বালিগঞ্জ গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলে।সেখানে ক্লাসের একটি ছেলে সত্যজিতের নাম জানতে চায়। সত্যজিৎ তখন তাকে তাঁর ডাক নাম বলেন ' মানিক'। সত্যজিতের তখন ধারণা ছিল না চট করে ইস্কুলে নিজের ডাক নাম বলতে নেই। তখন থেকে ইস্কুলে ছেলেরা তাঁকে ভালো নাম ধরে ডাকেনি সেই থেকেই সত্যজিৎ হয়ে গেল মানিক বা আমাদের  সকলের প্রিয় মানিকদা।

পিতা সুকুমার রায় ও ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

সত্যজিৎ রায়ের বাবা সুকুমার রায় ছিলেন বাংলা কবিতা ও শিশুসাহিত্যের সেরা লেখকদের একজন। সত্যজিৎ রায়ের দাদামশাই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও ছিলেন একজন নামকরা লেখক, চিত্রকর, দার্শনিক ও প্রকাশক।উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী দ্বিতীয় স্ত্রী কাদম্বিনী দেবী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৮২ সালে প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট। এর পরে কাদম্বিনী বসু ডাক্তার হয়ে ছিলেন।  সত্যজিতের মা এবং রায় বংসের অন্য নারীদের জীবনেও সুগভীর প্রভাব ছিল এই নারীর। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তার সমবয়সী রবীন্দ্রনাথের তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং প্রায়সই তিনি ঠাকুর বাড়িতে যাতায়াত  করতেন।

মাত্র তিন বছর বয়সে বাবাকে হারান সত্যজিৎ। মা সুপ্রভা দেবী বহু কষ্টে তাঁকে বড় করেন। বিশ্বখ্যাত রত্ন সত্যজিৎ বড় হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি পড়তে যান। ১৯৪০ সালের দিকে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকবছর পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৪৩ সালে শান্তিনিকেতন ছেড়ে তিনি কলকাতায় এসে ৮০ টাকা বেতনে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ শুরু করেন।

তাঁর কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু হলেও পরে লণ্ডন শহরে সফরকালে ইতালীয় চলচ্চিত্র দেখার পরই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হন।

সত্যজিৎ রায় প্রায় ৩৭ টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। এরমধ্যে রয়েছে কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। তিনি ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক, প্রকাশক এবং চলচ্চিত্র সমালোচকও।

'পথের পাঁচালি'

১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালি নির্মানের কাজ শেষ করেন। সেই ছবি এখনও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা দেয়। ১৯৪৯ সালে মার্চ মাসে জাঁ রেনেয়োঁর কলকাতায় আসেন তার 'দি রিভার' ছবির শুটিং করতে। এর পর থেকেই সত্যজিৎ তাঁর সাথে দেখা করতে যেতেন। তাঁদের সাথে আলোচনা হত। রেনেয়োঁর সংস্পর্শে এসে সত্যজিতের মনে গভীর ভাবে চলচ্চিত্র পরিচালনা করার একটা ইচ্ছা সযত্নে বাড়তে থাকে। ১৯৫০ সালে সত্যজিৎ সস্ত্রীক ইংল্যান্ডে যান।। সেখানে তিনি দেখেন 'বাই সাইকেল থীভস'। এর পর চার মাসে তিনি ৯৯ টি বই দেখেন। চলচ্চিত্র পরিচালনা করার একটা ইচ্ছা তীব্রতা বাড়তে থাকে 'বাই সাইকেল থীভস' দেখার পর।

১৯৫১ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পথে পথের পাঁচালির চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন সত্যজিৎ। সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়ের কাছ থেকে জানা যায় পথের পাঁচালি যে কত কষ্ট করতে হয়েছে তা ভাবলে এখন গল্পের মতন লাগে। প্রযোজকের বাড়ি গিয়ে চিত্রনাট্য পড়ে শোনাতে হত। অনেকে ঠাট্টা তামাশাও করতেন। এখানে নাচ নেই, গান নেই, প্রেমিক প্রেমিকা নেই, এ ছবি চলবে কি করে? এর মধ্যে একজন প্রযোজকের পছন্দ হল। কিন্তু বাজারে ভদ্রলোকের ছবি সবে মাত্র মুক্তি পেয়েছে। তার ছবি চললে তিনি মানিকের ছবি নিয়ে ভাববেন। দুর্ভাগ্যবশত ছবিটা বাজারে চলেনি, ফলে তিনি আর মানিকের ছবিটা করতে রাজি হলেন না। তাই শুরু হল নিজের টাকায় শুটিং। এর পর তার প্রথম ছবি পথের পাঁচালির শুটিং শুরু করেন ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাস থেকে। বিজয়া রায়ের জন্ম দিন ২৭শে অক্টোবর  অপু দুর্গাকে নিয়ে কাশফুলের ক্ষেতে শুরু হয় শুটিং। টাকা ফুরিয়ে এলে বিজয়া রায়ের গয়না বন্ধক দিয়ে অর্থের জোগার হয়। মাঝে শুটিং বন্ধ হয়ে গেলে সত্যজিৎ রায় মহা চিন্তায় পড়লেন।চুনিবালা দেবী  বৃদ্ধা।  তার কিছু হলে পথের পাঁচালি বন্ধ করে দিতে হবে। অপু দুর্গার যা বয়স ছিল দেরী হয়ে বয়স বেড়ে গেলে তাদের আর চরিত্রে মানাবেনা। প্রায় তিন মাস শুটিং বন্ধ থাকার পর পশ্চিম্বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর বিধান চন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় টাকার যোগান হয়।

‘পথের পাঁচালি’ সিনেমা নির্মাণের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের যাত্রা শুরু। তাঁর নির্মিত পথের পাঁচালি ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। এর মধ্যে অন্যতম ১৯৫৬ কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” পুরস্কার।

পথের পাঁচালি, অপরাজিত এবং অপুর সংসার এই তিনটি একত্রে অপু ত্রয়ী নামে পরিচিত। এই ত্রয়ী সত্যজিতের জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্মজীবন হিসেবে স্বীকৃত। অপুর ট্রিলজি গোটা পৃথিবীর মানুষ কে একটা চিরন্তন সত্যের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জীবনে দুঃখ, কষ্ট,মৃত্যু, যন্ত্রণা থাকলেও জীবন থেমে থাকে না। এই ছবিতে তারই ইতি বাচক সন্ধান আমরা পাই। অনেকে মনে করেন পথের পাঁচালি কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পাওয়ার পরে আমাদের দেশে সন্মান পেয়েছে। ছ সপ্তাহ বসুশ্রী হলে  ভিড় উপচে পড়ে পরে ছবিটি ইন্দিরা হলে নিয়ে যাওয়া  হয়। সেখানেও ভিড় উপচে পড়ে। ১৯৪৯ সালে দীর্ঘদিনের পরিচিত বিজয়া দাসকে তিনি বিয়ে করেন। সত্যজিৎ-বিজয়ার ছেলে সন্দীপ রায়ও বর্তমানে একজন নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালক।

সত্যজিৎ রায় সমাজের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতাথেকেই একের পর এক ছবি করে গেছেন। এরপর একে একে নির্মাণ করেন, পরশ পাথর , জলসা ঘর(জমিদারি প্রথার অবক্ষয় নিয়ে নির্মিত ‘জলসাঘর’)।  অপুর সংসার, অভিযান, মহানগর, কাপুরুষ ও মহাপুরুষ , নায়ক, গুপি গাইন বাঘা বাইন , অরণ্যের দিন রাত্রি, সীমাবদ্ধ, অশনি সংকেত সোনার কেল্লা জন অরণ্য, শতরঞ্জ কি খিলাড়ী, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, ঘরে বাইরে, গণশত্রু, শাখা প্রশাখা এবং সর্বশেষ বানানো সত্যজিতের সিনেমার নাম আগুন্তুক। সত্যজিতের অমর সৃষ্টি ‘ফেলুদা’ তাঁর সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর বয়ে চলছে যুগ থেকে যুগান্তরে।

জলসা ঘর, দেবী ও কাঞ্চনজঙঘা সমাজ চেতনার তিনটি আসামান্য সৃষ্টি। ১৯৬২ সালে সত্যজিৎ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নামে প্রথম মৌলিক চিত্রনাট্যনির্ভর রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। দার্জিলিংয়ের এক পাহাড়ি এলাকায় একটি উচ্চবিত্ত পরিবারে কাটানো এক বিকেলের কাহিনি নিয়ে জটিল ও সংগীতনির্ভর এই ছবিটি বানিয়েছিলেন তিনি।

পরস পাথর- এ তিনি হাসি-মজাও কারুণ্যের মধ্যেদিয়ে মধ্যবিত্তের অর্থলোভ, বড়োলোক হবার বাসনাকে সুন্দর ভাবে ব্যঙগ করেছেন।‘পরশপাথর’ নামের হাস্যরসাত্মক একটি ছবি। আর পরেরটি ছিল এর বাইরে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলো হচ্ছে ‘দেবী’ (১৯৬০), ‘তিন কন্যা’ (১৯৬১) ও ‘অভিযান’ (১৯৬২)।

শতরঞ্জ কি খিলাড়ীতে তিনি বিদেশি শক্তির সাথে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর ও রাজতন্ত্রের সহযোগীতা এবং এই শ্রেণীর সুবিধাবাদী চরিত্র।বাংলা চলচ্চিত্রের বাইরে সত্যজিৎ রায় ১৯৭৭ সালে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ নামের হিন্দি ও উর্দু সংলাপনির্ভর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এটিই ছিল বাংলা ভাষার বাইরে অন্য ভাষায় নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র। শুধু তা-ই নয়, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ হচ্ছে সত্যজিৎ রায় নির্মিত সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও তারকাসমৃদ্ধ ছবি। ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন সঞ্জীব কুমার, সাইদ জাফরি, আমজাদ খান, শাবানা আজমি, ভিক্টর ব্যানার্জি ও রিচার্ড অ্যাটেনবরোর মতো তারকা অভিনয়শিল্পীরা।

গুপি গাইন বাঘা বাইনে বিরোধী শক্তির কথা বলেছেন। আর পরবর্তী ছবি হীরক রাজার দেশেতে দেখিয়েছেন মানুষের কাছে ফিরে আসার কথা বলেছেন সত্যজিৎ।

১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ নির্মাণ করেন ‘চারুলতা’। যেটি ছিল তাঁর কর্মজীবনের সফল ছবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে নির্মিত ছবিটিতে উনিশ শতকের এক নিঃসঙ্গ বাঙালি বধূ চারু ও ঠাকুরপো অমলের প্রতি তার অনুভূতির কাহিনি বাস্তব জীবনের নিরিখে নির্মাণ করা হয়েছে। ‘

'ঘরে বাইরে'

পথের পাঁচালির আগে সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে বাইরে (১৯১৬ সালের) উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র করতে চেয়েছিলেন। সে জন্য সত্যজিৎ ঘরে বাইরে' র প্রথম চিত্রনাট্য লিখে ফেলেন। নানা কারণে তখন ছবিটি করা হয়ে ওঠেনি।সত্যজিতের তরুণ  বয়সের ভাবনা নিয়ে ঘরে বাইরে' বাস্তবে রূপ পেয়েছিল ৩৯ বছর পর। এর ফলে ঘরে বাইরে' নিয়ে ভাবনার অনেক গর্বেষণা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এর ফল স্বরূপ একটি নিখুঁত ছবি ১৯৮৪ সালে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে।১৯৮৩ সালে ছবির কাজ করার সময় সত্যজিৎ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত। এরপর তাঁর কাজের গতি একেবারে কমে আসে। স্বাস্থ্যের অবনতির ফলে ছেলে সন্দীপ রায়ের সহায়তায় ১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’ ছবিটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন।

সত্যজিতের ৩৬ বছর চলচ্চিত্র জীবনে মোট ২৭টি ফিচার ফ্লিম ও ৫ টি তথ্যচ্চিত্র করে ছিলেন। ১৯৬১ সালে প্রথম তথ্যচ্চিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা নতুন দিগন্তের আলো দেখিয়েছিল।

সন্দেশ  ও লেখক সত্যজিৎ

উপেন্দ্রকিশোরের অন্যতম শ্রেষ্ঠকীর্তি হল ১৩২০ সালের ছোটদের "সন্দেশ" পত্রিকার প্রকাশ। সেই সময় ঐ রকম একটা সুন্দর ছোটদের মাসিক পত্রিকার কথা কেউ কল্পনা করতে পারত না। ১৯৬১ সালের মে মাসে সত্যজিৎ রায় বন্ধু কবিসুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সত্যজিৎ 'সন্দেশ' পত্রিকার প্রকাশ পুনরায় করেন। তিনি নিজের বাড়িতে বসেই নিয়মিত 'সন্দেশ' এর লেখা, ছাপা, মলাট, ছবি আর লে আউট যত্নের সাথে তৌরী করে দিতেন।

সন্দেশের প্রয়োজনেই সত্যজিৎ চল্লিশ বছর বয়সে তার লেখক জীবন শুরু করেন।

নতুন ম লাট,  ছবি আর হেড পিস তিনি আকতে লাগলেন। ১৯৬৫ সালে তিনিতার লেখা শঙকুর কয়েকটি গল্প নিয়ে প্রথম প্রকাশিত হ ল 'প্রফেসর শঙকু' নামের বইটি। এই বইটি কিশোর গ্রন্থ রূপে একাডেমি পুরস্কার পান। সন্দেশের প্রয়োজনে 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি' নামে আর একটি উপন্যাস লেখেন।

১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ চিদানন্দ দাসগুপ্ত ও অন্যান্যদের সঙ্গে মিলে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।সত্যজিতকে অন্যতম সাংস্কৃতিক আইকন হিসেবেও গণ্য করা হয়।

ফ্রান্সের সরকার ১৯৮৭ সালে তাঁকে সেদেশের বিশেষ সম্মনসূচক পুরস্কার ‘লেজিওঁ দনরে’ প্রদান করেন। ১৯৮৫ সালে অর্জন করেন ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে। ১৯৯২ সালে ভারত সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার ভারত রত্ন সম্মাননা প্রদান করে। এছাড়াও তিনি পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।

১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস (অস্কার) তাঁকে আজীবন সম্মান পুরস্কার প্রদান করে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভারত সরকার তাঁকে ভারতরত্ন প্রদান করে। মৃত্যুর পর তাঁকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়।

সেবছর প্রখ্যাত ফরাসি পরিচালক জ্যঁ রেনোয়া তার ‘দ্য রিভার’ চলচ্চিত্রটির শুটিং করতে কলকাতায় এসেছিলেন। ‘দ্য রিভার’ ছবিতে রেনোয়ার সহকারীর কাজ করেন তিনি। এই সময় থেকে চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার স্বপ্ন বোনেন সত্যজিৎ। জানা যায়, ‘দ্য বাই সাইকেল থিফ’ ছবিটি দেখার পর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।

১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায় তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করেন। প্রথম চলচ্চিত্র তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। ‘পথের পাঁচালী’ মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। এটি কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরস্কারও অর্জন করে।

এই নির্মাতার বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে অপুর সংসার, মহানগর, চারুলতা, সোনার কেল্লা, হীরক রাজার দেশে, নায়ক অন্যতম।
চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের সৃজনশীলতা ছিল বহুমুখী। তার কাজের পরিধি ছিল অনেক। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’—এই তিনটি চলচ্চিত্রকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত।

সত্যজিৎ রায়  জীবদ্দশায় বহু পুরস্কার পেয়েছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।  ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার সত্যজিৎ রায়কে বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার লেজিওঁ দনরে ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন। ভারত সরকারের ভারতরত্নসহ বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

২০০৪ সালে, বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তালিকায় সত্যজিৎ ১৩তম স্থান লাভ করেছিলেন।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন সত্যজিৎ। বিশ্বভারতীতে পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও এর আগেই ১৯৪৩ সালে শান্তিনিকেতন ছেড়ে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। এখানে এসেই একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় মাত্র ৮০ টাকা বেতনে চাকরি নেন। ঘটনাচক্রে একই বছর প্রখ্যাত ফরাসি পরিচালক জ্যঁ রেনোয়া তাঁর ‘দ্য রিভার’ চলচ্চিত্রটির শুটিং করতে কলকাতায় আসেন। ‘দ্য রিভার’ ছবিতে রেনোয়ার সহকারীর কাজ করতে গিয়েই সম্ভবত পুরোপুরিভাবে এক চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা শুরু করেন সত্যজিৎ। তবে ‘দ্য বাই সাইকেল থিফ’ ছবিটি দেখার পরই বোধহয় তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।

হৃদযন্ত্রের জটিলতার কারণে সত্যজিৎ ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল  মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।সত্যজিৎ রায় বেঁচে আছেন তাঁর ছবির মধ্যে, বেঁচে আছেন তাঁর লেখনির মধ্যে দিয়ে।শুধুমাত্র ভারতে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় চলচ্চিত্র জগতে সুনাম অর্জন করেছেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়।ভারতের চলচ্চিত্র জগত বিশ্বের দরবারে  যাত্রা শুরু করে সত্যজিতের হাত ধরেই।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

14 April 2020

আজ ১৪ই এপ্রিল, ২০২০ জ্যুরিস্ট, রাজনৈতিক নেতা, বৌদ্ধ আন্দোলনকারী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, বাগ্মী, বিশিষ্ট লেখক, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত, সম্পাদক, রাষ্ট্রবিপ্লবী ও বৌদ্ধ পুনর্জাগরণবাদী ডক্টর ভীমরাও রামজি আম্বেডকর ১২৯ তমজন্মবার্ষিকী। তিনি বাবাসাহেব নামেও পরিচিত ছিলেন। বাবা সাহেব ছিলেন ভারতের সংবিধানের খসড়া কার্যনির্বাহক সমিতির সভাপতি ও মুখ্য স্থাপক ছিলেন। তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী এবং ভারতের দলিত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ভারতের গরীব মহারাষ্ট্রের রত্ন গিরি জেলার “মহর” পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ১৮৯১সালের ১৪ই এপ্রিল। “মহর” পরিবার তখন  অস্পৃশ্য জাতি হিসেবে গণ্য হত। দরিদ্র পিতা রামজী মালোজী সঙকপল ও মাতাভীম বাঈ এর চতুর্দশতম সন্তান ভীম রাওয়ের বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সে।প্রথম স্ত্রী মারা যাবার প র ১৯৪৮ সালে বিয়ে করেন ডঃ সারদা কবীরকে। আম্বেদকর সারাটা জীবন সামাজিক বৈষম্যতার (Social Discrimination), “চতুর্বর্ণ পদ্ধতি”-হিন্দু সমাজের চারটি বর্ণ এবং ভারতবর্ষের অস্পৃশ্য (Untouchables or Untouchables community) প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন। বর্ণ হিন্দু ও অস্পৃশ্যদের মধ্যে সামাজিক অসাম্য দূর করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন "সমাজ সমতা সঙ্গ", এই সঙ্গের মুখপত্রের নাম ছিল সমতা। কোলাবা জেলার ' মহাদেপবতার তালেন' নামে এক সর্বসাধারণের পুকুর থেকে অস্পৃশ্যদের জল নেবার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ১৯২৭সালে এক সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেন। বর্ণ হিন্দুরা পুকুরটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে দাবি করে। হাইকোর্টের রায় আম্বেদকরের পক্ষে যায়। এছাড়াও নাসিকের প্রসিদ্ধ কালারাম ম ন্দিরেঅস্পৃশ্যদের প্রবেশের অধিকার অর্জন করান। এরপর ১৯৩৫ সালে তিনি ঘোষণা করেন অস্পৃশ্যরাহিদু ধর্ম পরিত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করবে। কারণ হিন্দু সমাজে কখনোই তারা সমানাধিকার পাবে না। প্রথমে তিনি শিখ ধর্মেরদিকে আকৃষ্ঠ হলেও শিখদের সাথে সম্পর্ক টেকেনি। ১৯৫৬ সালে তিনি নাগপুরে লক্ষ লক্ষ অনুগামীসহ বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং হাজারো অস্পৃশ্যদের থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম (Theravada Buddhism) স্ফুলিঙ্গের মতো রূপান্তরিত করে সম্মানিত হয়েছিলেন। আম্বেদকরছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি বিদেশে ইকোনোমিকস- এ ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের প্রথম ইকোনোমিক এ পিএইচডি ডিগ্রি, এবং প্রথম দুবার ইকোনোমিক্স এ ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন ভারত বর্ষের প্রথম আইন মন্ত্রী। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় পৃথিবীর ১০০ পন্ডিতের মধ্যে ইনি আছেন। সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে প্রথম এবং সুদু মাত্র ইনিই যে অর্জন করেছে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস থেকে সমস্ত বিজ্ঞান বিষয়ের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি।১৯৯০ সালে মরণোত্তর (Posthumous) “ভারতরত্ন” - ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় উপাধি'তে ভূষিত করা হয়। প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে। ডক্টর ভীমরাও রামজি আম্বেডকর ১২৯ তম জন্মবার্ষীকি - ৬ই ডিসেম্বর ১৯৫৬)

আজ ১৪ই এপ্রিল২০২০,জ্যুরিস্ট, রাজনৈতিক নেতা, বৌদ্ধ আন্দোলনকারী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, বাগ্মী, বিশিষ্ট লেখক, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত, সম্পাদক, রাষ্ট্রবিপ্লবী ও বৌদ্ধ পুনর্জাগরণবাদী ডক্টর ভীমরাও রামজি আম্বেডকর ১২৯ তমজন্মবার্ষিকী। তিনি বাবাসাহেব নামেও পরিচিত ছিলেন।

বাবা সাহেব ছিলেন  ভারতের সংবিধানের খসড়া কার্যনির্বাহক সমিতির সভাপতি ও মুখ্য স্থাপক। তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী এবং ভারতের দলিত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা।

ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ভারতের মহারাষ্ট্রের  রত্নগিরি জেলার “মহর” গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯১সালের ১৪ই এপ্রিল। “মহর” পরিবার তখন  অস্পৃশ্য জাতি হিসেবে গণ্য হত। দরিদ্র পিতা রামজী মালোজী সঙকপল ও মাতাভীম বাঈ এর চতুর্দশতম  সন্তান ভীম রাওয়ের বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সে।প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর ১৯৪৮ সালে বিয়ে করেন ডঃ সারদা কবীরকে। আম্বেদকর সারাটা জীবন সামাজিক বৈষম্যতার (Social Discrimination), “চতুর্বর্ণ পদ্ধতি”-হিন্দু সমাজের চারটি বর্ণ এবং ভারতবর্ষের অস্পৃশ্য (Untouchables or Untouchables community) প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন। বর্ণ হিন্দু ও অস্পৃশ্যদের মধ্যে সামাজিক অসাম্য দূর করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন "সমাজ সমতা সঙ্গ", এই সঙ্গের মুখপত্রের নাম ছিল সমতা।
কোলাবা জেলার ' মহাদেপবতার তালেন' নামে এক সর্বসাধারণের পুকুর থেকে অস্পৃশ্যদের জল নেবার অধিকার প্রতিষ্ঠা  করতে ১৯২৭সালে এক সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেন। বর্ণ হিন্দুরা পুকুরটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে দাবি করে। হাইকোর্টের রায় আম্বেদকরের পক্ষে যায়। এছাড়াও নাসিকের প্রসিদ্ধ কালারাম মন্দিরে অস্পৃশ্যদের প্রবেশের অধিকার অর্জন করান। এরপর ১৯৩৫ সালে তিনি ঘোষণা করেন অস্পৃশ্যরাহিদু ধর্ম পরিত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করবে। কারণ হিন্দু সমাজে কখনোই তারা সমানাধিকার পাবে না। প্রথমে তিনি শিখ ধর্মেরদিকে আকৃষ্ঠ হলেও শিখদের সাথে সম্পর্ক টেকেনি। ১৯৫৬ সালে তিনি নাগপুরে লক্ষ লক্ষ অনুগামীসহ বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং হাজারো অস্পৃশ্যদের থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম (Theravada Buddhism) স্ফুলিঙ্গের মতো রূপান্তরিত করে সম্মানিত হয়েছিলেন।


আম্বেদকরছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি বিদেশে ইকোনোমিকস- এ ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের প্রথম ইকোনোমিক এ পিএইচডি ডিগ্রি, এবং প্রথম দুবার ইকোনোমিক্স এ ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন ভারত বর্ষের প্রথম আইন মন্ত্রী। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় পৃথিবীর ১০০ পন্ডিতের মধ্যে ইনি আছেন। সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে প্রথম এবং সুদু মাত্র ইনিই যে অর্জন করেছে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস থেকে সমস্ত বিজ্ঞান বিষয়ের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি।১৯৯০ সালে মরণোত্তর (Posthumous) “ভারতরত্ন” - ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় উপাধি'তে ভূষিত করা হয়।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

13 April 2020

জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড ও রবীন্দ্রনাথ এবং সর্দার উধম সিং

আজ থেকে ১০১ বছর আগের সেই আভিশপ্ত দিন।ইংরেজ শাসকের দখল করে বসে থাকা ভারতীয় উপমহাদেশের সাম্রাজ্য হারানোর ভয়, উপমহাদেশের শোষিত জনতার শক্তি কবে একত্রিত হয়ে তাঁদের গদিছাড়া করে, সেই ভয়। যথারীতি এই ভয় কমাতে সে সময় মরিয়া হয়ে উঠল ইংরেজ প্রশাসন। এ সময় ইংরেজদের সুবিধা করে দিতে জনতার ওপর অত্যাচার ও ভয়ানক নির্মমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়ে ১৯১৯ সালের ১০ মার্চ বলবৎ করা হয় কুখ্যাত ‘রাওলাট অ্যাক্ট’। এমনই এক সময়ে নানা ঘটনা পরিক্রমায় পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে ওই বছরের ১৩ এপ্রিল ডাকা হলো এক প্রতিবাদসভা। স্থান নগরীর বিরাট জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যান। সেদিন আবার ছিল পাঞ্জাবের অন্যতম বৃহৎ উৎসব বৈশাখীরও দিন। আইনের ছলাকলা দেখিয়ে তখন পাঞ্জাবে জনসমাবেশ নিষিদ্ধ হলেও সাতসকালেই উদ্যান ভরে গেল উৎসাহী  মানুষে। ইংরেজ সেনাবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত জেনারেল রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে মুহূর্তেই গুলি ছুটল  জনসমষ্টির দিকে। সরকারি হিসাবে মারা গেল ৩৭৯ জন কিন্তু ধারণা করা হয়, আসল সংখ্যা এর থেকেও ঢের ঢের বেশি।এর পেছনে পাঞ্জাবের দুঃশাসক গর্ভনর মাইকেল ও’ডায়ারের ভূমিকাও ছিল নৃশংস।উৎসব-আনন্দের বৈশাখী মুহূর্তেই পরিণত হলো ‘খুনি বৈশাখীতে’।

পাঞ্জাবজুড়ে জারি করা হয়েছিল জরুরি অবস্থা।  এমন এক বর্বর হত্যাযজ্ঞের খবর উপমহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে তখনই পারল না।আর সংবাদপত্রের ওপর ইংরেজ সরকারের নানা সেন্সরশিপ তো বহাল ছিলই। পাঞ্জাব থেকে বহু দূরের বঙ্গদেশে জালিয়ানওয়ালাবাগের খবর এল তাই দেরিতে। হত্যালীলার কিছুদিন পর নানা ছায়া-আবছায়াময় বাস্তব ও গুজবে মেশানো ছিন্নভিন্ন আকারে প্রকাশ্য হতে শুরু করল। কিন্তু তা থেকে তখনো পরিস্থিতির ভয়াবহতা পুরোটা আঁচ করা সম্ভব ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কানেও যথারীতি এ খবর সম্পূর্ণ আকারে আসছিল না। ব্রিটিশ ধর্মযাজক ও শান্তিনিকেতনের শিক্ষক সি এফ অ্যান্ডরুজ তখন শান্তিনিকেতন থেকে দিল্লি গিয়েছিলেন। তিনি একাধারে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহযোগীও ছিলেন বটে। দিল্লি ছাড়াও সিমলা ঘুরে এসে তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগের ন্যক্কারজনক ঘটনা সম্পর্কে কিছু খবর পেয়েছিলেন। ১৯১৯ সালের পয়লা মে লেখা এক চিঠিতে তিনি রবীন্দ্রনাথকে জানান, ‘অসহায় গ্রামবাসীর ওপর এয়ারপ্লেন বোমা ফেলছে আর কেবল লাঠি হাতে থাকা জনসমাবেশে মেশিনগান গুলি ছোটাচ্ছে।’ চিঠি গোয়েন্দাদের হাতে পড়তে পারে, এমন শঙ্কায় অ্যান্ডরুজ আর বেশি কিছু লিখতে পারেননি। অ্যান্ডরুজ এরপর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য অমৃতসর যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাঁকে ট্রেনেই গ্রেপ্তার করে দিল্লি পাঠিয়ে দেয়। এ ঘটনা পরে জেনে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত মর্মাহত হন, ওই সময়ের দুশ্চিন্তা ও রাগের প্রকাশ দেখা যায় ২২ মে ১৯১৯ সালে কিশোরী রানু অধিকারীকে লেখা এক চিঠিতে: ‘তোমরা তো পাঞ্জাবে আছ, পাঞ্জাবের দুঃখের খবর বোধ হয় পাও। এই দুঃখের তাপ আমার বুকের পাঁজর পুড়িয়ে দিলে।...’ ২২ মে তারিখেই রবীন্দ্রনাথ আসেন কলকাতায়। মনের মধ্যে ক্ষোভ আগুনের মতো জ্বলছে, তা সত্ত্বেও বহিরঙ্গে নিজের কাজকর্ম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা তিনি করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একটা সময়ের পর আর পারলেন না। কথাবার্তা কমে যায় ও লেখালেখি বন্ধ করে দেন। মুখে হাসি নেই। শরীরও ক্ষোভে-রাগে খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এমন সময় তাঁর মাথায় একটি প্রতিবাদের পরিকল্পনা আসে। তখন পাঞ্জাবে অন্য এলাকার বাসিন্দাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে ব্রিটিশ সরকার। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়, মহাত্মা গান্ধী আর তিনি মিলে প্রথমে দিল্লি গিয়ে তারপর যদি পাঞ্জাবে প্রবেশের চেষ্টা করেন, তাহলে একটা বড় প্রতিবাদ হয়। যদি তাঁদের ইংরেজ প্রশাসন গ্রেপ্তার করেও, তাতে প্রতিবাদের ও জনমনের প্রতিক্রিয়ার স্ফুলিঙ্গ আরও শক্তিশালী হবে। অতঃপর এই প্রস্তাবে গান্ধী রাজি হবেন কি না, তা জানতে তাঁর কাছে পাঠালেন সি এফ অ্যান্ডরুজকে। অ্যান্ডরুজকে গান্ধী ‘না’ বলে দেন এই বলে, ‘আমি এখনই সরকারকে বিব্রত করতে চাইছি না।’ ফিরে এসে অ্যান্ডরুজ যখন এ কথা রবীন্দ্রনাথকে জানালেন, কবি স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তবে হতোদ্যম হননি। গান্ধীকে যখন সঙ্গে পেলেন না, তখন স্বভাষী রাজনীতিবিদ চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর পাশে দাঁড়াবেন—এমনটা তিনি ভেবেছিলেন। তাই ২৯ মে বিকেলবেলা নিজেই যান তাঁর কাছে। কিন্তু গান্ধীর মতো তিনিও কবিকে হতাশ করেন। চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে কী আলাপ হয়েছিল, সেই বয়ান তিনি পরে জানান প্রশান্তকুমার মহলানবিশকে এভাবে: ‘মহাত্মাজী রাজি হলেন না পাঞ্জাবে যেতে। কাল তাই নিজেই গিয়েছিলুম চিত্তরঞ্জনের কাছে। বললুম যে, এই সময় সমস্ত দেশ মুখ বন্ধ করে থাকবে তা অসহ্য। তোমরা প্রতিবাদসভা ডাকো।’ এ কথা শুনে চিত্তরঞ্জন দাশ সভা করার দায় ঘাড়ে নিতে চাননি। উল্টো রবীন্দ্রনাথ একাই একটা সভায় প্রতিবাদী বক্তব্য রাখবেন—এমন প্রস্তাব দেন তিনি। এ কথা স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের মনঃপূত হয়নি। তাঁর মনে হয়েছিল, যদি একাই কিছু করতে হয়, তবে লোক ডেকে জড়ো করা কেন? অন্তরে বিপুল বেদনা ও রাগ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ওই দিনই সিদ্ধান্ত নেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করে বড়লাটকে চিঠি লিখলেন।  প্রশান্তকুমার মহলানবিশ সে সময় ছিলেন কবির কাছেই। ওই সময় কবি তাঁকে বলেছিলেন, ‘এই সম্মানটা ওরা আমাকে দিয়েছিল। কাজে লেগে গেল। এটা ফিরিয়ে দেওয়ার উপলক্ষ করে আমার কথাটা বলবার সুযোগ পেলুম।’ ভোর শেষে সকাল হলে অ্যান্ডরুজ এলেন চিঠিটা নিতে। সেই সময় ঘটেছিল আরেক কাণ্ড। রবীন্দ্রনাথের ক্রোধতপ্ত চিঠির ভাষা খানিক নরমসরম করা যায় নাকি, এমন প্রস্তাব ছিল অ্যান্ডরুজের। এ কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা ইংরেজ সেনাবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত জেনারেল রেগিনাল্ড ডায়ারনাইটহুড পরিত্যাগের এ চিঠি গোটা বাংলা তো বটেই, দেশজুড়েই আলোড়ন তুলল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এই, ওই রকম একক ও সাহসী প্রতিবাদের পরও রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে নানা নিন্দা-মন্দ প্রচার হতে শুরু করে। যেমন, ৩ জুন তারিখে নায়ক নামের এক পত্রিকা সম্পাদকীয়তে লেখে, ‘রবীন্দ্রনাথ উপাধী বর্জ্জন করিয়া নিজের সুবিধা কি করিয়াছেন তাহা জানি না, দেশের ও জাতির যে কোন সুবিধা করতে পারেন নাই, তাহা বলিবই। আমরা তাঁহার কার্য্যরে সমর্থন করিতে পারিলাম না।’ স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীও একটি ব্যক্তিগত পত্রে রবীন্দ্রনাথের এই ‘জ্বলন্ত’ চিঠিকে ‘অকালপক্ক’ বলে অভিহিত করেন। অন্যদিকে চলতে থাকে আরেক খেলা, ইংরেজ কর্তৃপক্ষের তরফে কয়েকজন রবীন্দ্রনাথের উপাধি ফেরত নিতে অক্ষম বলে নিজেদের দাবি করে কিছু চিঠিপত্র কবির কাছে চালাচালি করেন। সম্ভবত এই ছলচাতুরির উদ্দেশ্য ছিল কবিকে বিভ্রান্ত করা। কিন্তু কবি নিজের অবস্থানে ঠিকই অটুট থাকেন। বস্তুত নামের সামনে থেকে ইংরেজি ‘স্যার’-এর লেজুড়টুকু মুছে ফেলতে পেরে তিনি অনেকটা শান্ত হতে পেরেছিলেন। মনের বোঝা নামিয়ে লেখালেখিতেও তিনি দ্রুত ফিরে আসতে পারেন নাইটহুড উপাধি ত্যাগের পরই।

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাযজ্ঞের পর পরাধীন ভারতবর্ষের রাজনীতিবিদেরা যখন চুপচাপ থাকার পথ বেছে নিয়েছিলেন, সেখানে নাইটহুড বর্জনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের একক প্রতিবাদ এই বর্বরতার দিকে বিশ্ববাসীর চোখ ফেরাতে পেরেছিল। তবে রবীন্দ্রনাথ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পাল্টা সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার সপক্ষে ছিলেন না। তাই
মনে হয় জালিয়ানওয়ালাবাগের ২১ বছর পর ১৯৪০ সালের ১৩ মার্চ লন্ডনে হত্যাকাণ্ডের মূল দুই হোতার একজন মাইকেল ও’ডায়ারকে হত্যা করেছিলেন যে বিপ্লবী উধম সিং (পরে ইংরেজ সরকার দ্রুত তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলায়), তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথ সহানুভূতি নিশ্চয়ই রাখতেন, কিন্তু প্রশংসা করতে পারতেন না।


৩১শে জুলাই ১৯৪০ সালে উধম সিং-এর ফাঁসি হয়।

বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর উধম সিং যিনি রাম মহম্মদ সিং আজাদ নামেও পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর দাদাকে অমৃতসরের সেন্ট্রাল খালসা অনাথআলয় পুটলিগড় তাদের কাছে নিয়ে আসেন। এখান থেকেই তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯১৮ সালে। ১৩ই এপ্রিল ১৯১৯ সাল, জালিয়নওয়ালা বাগে যখন জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ব্রিটিশ পুলিশ নির্বিচারে নিরীহ মানুষের উপর গুলি বর্ষণ করেন তখন উধম সিং এবং তাঁর অনাথআলয়ের বন্ধুরা সেখানে আগত মানুষদের জল দিচ্ছিলেন। উদম সিং দেখেন যে শুধু গুলি চালিয়ে চলে যায়নি ব্রিটিশ পুলিশ, ফেরার পথে যে যে ভারতীয় তাদের নজরে এসেছে তাদের টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় ফেলে খুন করেছিল তারা। অসংখ ভারতীয়ের মৃত্যু হয়। এ সবই উদম সিং নিজের চোখে দেখেছিলেন এবং সেখানে দাড়িয়ে তিনি এই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। পাঞ্জাবের রাজ্যপাল মাইকেল ও'ডায়ার এই হত্যাকে সমর্থন করেন। উদম সিং মাইকেল ও'ডায়ারকে ভারতীয়দের মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন এবং সেই মুহূর্ত থেকে তাঁর জীবনের এক মাত্র উদ্দেশ্য হয় মাইকেল ও'ডায়ার মৃত্যু। জানিয়নওয়ালা বাগের হত্যালীলা চালাবার পর ব্রিটিশ সরকার ডায়ারের পদোন্নতি করে তাঁকে ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এর ফলে উধম সিং-কে ইংল্যান্ডে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে হয়।

উধম সিং, ভগত সিং-এর বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন।  দেশে থেকে তাঁর প্রতিজ্ঞা পূরণ করা সম্ভব হবে না দেখে কাশ্মীর থেকে জার্মানি হয়ে ইংল্যান্ডে পৌঁছে যান।

ইংল্যান্ডে পৌঁছে দিন মজুরের কাজ করে অল্প অল্প করে অর্থ যোগার করতে থাকেন বন্দুক এবং গুলি কেনার জন্য। ১০বছর আরও লেগে যায় এই অর্থ যোগার করতে। এবং অবশেষে সেই দিনটি চলে আসে যার জন্য উধম সিং ২০বছর ধরে অপেক্ষা করছিলেন। ১৩ই মার্চ ১৯৪০ সালে, ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশান এবং সেন্ট্রাল এশিয়ান সোসাইটির একটি যৌথ সভা হয় কাক্সটন হলে। মাইকেল ও'ডায়ার তা যোগ দিতে আসেন। উধম সিংও সেখানে পৌঁছে যান এবং মাইকেল ও'ডায়ারকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দেন। ও'ডায়ারকে বাঁচাতে এলে কিছু ব্রিটিশ আহত হন। কিন্তু উধম সিং পর পর দুটি গুলি করে মাইকেল ও'ডায়ারকে সেখানেই ইহলোক থেকে পরলোকে পাঠিয়ে দেন। গুলি করার পর উধম সিং পালিয়ে না গিয়ে নিজেই পুলিশের হাতে ধরা দেন। আহতদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এবং বলেন যে তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে জালিয়নওয়ালা বাগে করা অত্যাচারের শাস্তি  হিসাবে।

১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল রাওলাট আইন নামক কালাকানুনে পাঞ্জাবের দুই জনপ্রিয় জননেতা ডঃ সত্যপাল ও ডঃ সইফুদ্দিন কিচলুকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতারের প্রতিবাদে জালিয়ানওয়ালাবাগে জনগন এক শান্তিপূর্ন সমাবেশে সমবেত হলে বৃটিশ সেনাপতি জেনারেল ও ডায়ার শুধুমাত্র নরহত্যার বিকৃত বাসনায় সম্মিলিত জনগণকে কোনো রকম সতর্ক না করেই গুলিবর্ষনের আদেশ দেন ৷ সরকারি হিসাব অনুসারে ৩৭৯ জন নিহত ও ১৫২৬ জন আহত হয়েছিল সেই হত্যাকাণ্ডে ৷ বেসরকারি হিসাবে হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী ৷ এই ঘটনায় জেনারেল ও ডায়ার প্রকাশ্যেই অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন এবং যাঁরা কোনোভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদের কোনোভাবে হত্যা করতে না পারার জন্য আক্ষেপও প্রকাশ করেন তিনি ৷
এই ঘটনা ভারতে বৃটিশ শাসনের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল, সন্দেহ নেই ৷ মুক্তিকামী জনগনের স্বাধীনতা আন্দোলন এক নতুন গতি পেয়েছিল এবং জাতীয় রাজনীতিতে বহু পট পরিবর্তনও ঘটে গিয়েছিল ৷ ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য জেনারেল ও ডায়ার কে ভারত থেকে ইংল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বরাবরের মতো ৷
দূর থেকে সেই বীভৎস হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছিলেন ২০ বছর বয়সী পাঞ্জাবি যুবক উধম সিং ৷ সেই সময় তাঁর কোনো ক্ষমতাই ছিল না সেই হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ করার ৷ ব্যক্তিগত জীবনে মার্ক্সবাদী কমিউনিজমের আদর্শে বিশ্বাসী সেই যুবকটি সেদিন থেকেই মানবতার ঘৃণ্য শত্রু জেনারেল ও ডায়ার কে অনুরূপভাবে হত্যা করে দেশবাসীর রক্তঋণ শোধ করার তীব্র বাসনা পোষন করতে থাকেন ৷ সেই বাসনা থেকেই ১৯৩৪ সালে পাড়ি জমান ইংল্যাণ্ডে এবং এই ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৪০ সালের ১৩ই মার্চ লণ্ডনের ক্যাক্সটন হলে এক প্রকাশ্য জনসভায় গুলির পর গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেন মানবতার ঘৃণ্য শত্রু জেনারেল ও ডায়ারের দেহ ৷ উধম সিং এই মহৎ কর্মে ব্যবহার করেছিলেন সেই ধরনের রিভলবার ও কার্তুজ, যা জালিয়ানওলাবাগ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছিল ৷ এইভাবেই দেশবাসীর রক্তঋণ শোধ করেছিলেন ৪১ বছরের বীর সর্দার উধম সিং ৷ পরিনামে ৩১শে জুলাই ১৯৪০ সালে লণ্ডনের পেন্টনভেলি জেলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় এই মহান বিপ্লবীকে ৷

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।


11 April 2020

আগামী কাল রবিবার, ২৯শে চৈত্র ১৪২৬, ১২ই এপ্রিল, ২০২০, বারো নীল পুজো বা নীলের উপবাস

আগামী কাল রবিবার, ২৯শে চৈত্র ১৪২৬, ১২ই এপ্রিল, ২০২০, বারো নীল পুজো বা নীলের উপবাস।বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ । একটা পুজো শেষ হতে না হতেই আরও একটা পুজো চলে আসে । তবে বাঙালির এমন অনেক উ‍ৎসব রয়েছে, যেগুলির হয়তো নাম ডাক নেই তেমন ৷ যেমন অশোক ষষ্ঠী ব্রত, আদর সিংহাসন ব্রত, আদা-হলুদ ব্রত, ইতু ব্রত, কালকুমারি পূজা ব্রত, কুলুই পূজা ব্রত, তুষ তুলসী ব্রত, দশ পুতুল ব্রত, পুন্যিপুকুর ব্রত, বানব্রতের উৎসব ব্রত, মাঘ মন্ডল ব্রত, মেছেনী ব্রত, মেঘারানীর ব্রত, যমপুকুর ব্রত, ষষ্ঠী ব্রত, সবুজ পাতার ব্রত, সাবিত্রী ব্রত, সেঁজুতি ব্রত, হরিচরণ ব্রত, হেলেনা ব্রত, অরন্য ষষ্ঠী ব্রত, নীল ষষ্ঠী ব্রত, পাটাই ষষ্ঠী ব্রত, দুর্গা ষষ্ঠী ব্রত, রাধাষ্ঠমী ব্রত, জন্মাষ্ঠমী ব্রত, অক্ষয় তৃতীয়া ব্রত, জিতাষ্টমী ব্রত, পৃথিবী ব্রত, চাঁপাচন্দন ব্রত, নখ ছুটের ব্রত, সুবচনী ব্রত, বসন্তবুড়ী ব্রত, মাকাল ব্রত, ওলাই চন্ডী ব্রত, মঙ্গল চন্ডী ব্রত, নাগপঞ্চমী ব্রত, মধুসংক্রান্তি ব্রত, বিবিঞ্চি ব্রত ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে বাঙালির বারোমাস্যা এই সব পুজো কিংবা ব্রত ছাড়া কিন্তু অসম্পূর্ণ ৷ গ্রাম বাংলায় বহুল প্রচলনে থাকলেও কালের নিয়মে শহরের বুকে কৌলীন্য হারিয়েছে তারা ৷ এমনই এক উৎসব হল-‘নীল পুজো’ বা ‘নীল ষষ্ঠী’ ৷

চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন পালন করা হয় নীল ষষ্ঠী। এই সময় মাটি দিয়ে শোয়ানো অবস্থায় একটি দেব মূর্তি তৈরী করা হয়। যে মূর্তিকে শিবের মূর্তি বলা হয়। এটি অনেকটাই অমসৃণ থাকে। ঠিক শিবের আদল বোঝা যায় না। নরম মাটি দিয়ে তৈরী এই মূর্তির গায়ে খেজুর দিয়ে আবরণ দেওয়া হয়। চারি পাশে খেজুর পাতা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। কোথাও কোথাও মাটির মূর্তির বদলে একটি মাটির ঢিবি তৈরী করা হয়। এর পর ফুল-বেল পাতা দিয়ে শুরু হয় নীল পুজো। একই সঙ্গে চলে বালা গান। এই দিন বাড়ির মহিলারা সারাদিন ধরে উপোস করে থাকেন। বিকেলে পুজো দিয়ে তবেই কিছু মুখে দেন তাঁরা। সাধারণত পরিবারের সকলের স্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনার্থে নীলের উপবাস করে থাকেন।

পুজোর রীতি

চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন সারা দিন উপোস করার পর সন্ধ্যাবেলা শিবের মাথায় জল ঢেলে শিবকে প্রণাম করে গর্ভবতী মহিলারা বা মায়েরা। অনেকে নির্জলা থেকেও ব্রত পালন করেন। সন্ধেয় প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবের মাথায় জল ঢালার পরেই ব্রত ভঙ্গ হয়। কথায় বলে, নীলের ব্রত নিষ্ঠামতো পালন করলে কোনওদিন সন্তানের অমঙ্গল হয় না। সন্তান দীর্ঘজীবন লাভ করে।
লকডাউনের নিয়ম বা নির্দেশ মেনে পুজো করুন। সবাই ভালো থাকুন।

নীল পুজোর ব্রত কথা
-----------------
এক বামুন আর বামনীর পাঁচছেলে আর দুটি মেয়ে। তারা খুব পুজোআচ্চা করত। কিন্তু এত পুজো, বারব্রত করেও তাদের সব ছেলেমেয়েগুলো একে একে মারা গেল। তখন বামনীর ঠাকুরদেবতায় বিশ্বাস চলে গেল। তাদের আর সেই জায়গায় থাকতেও ভালো লাগল না। বামুন-বামনী ঠিক করল সব ছেড়েছুড়ে তারা মনের দুঃখে কাশীবাসী হবে। দশাশ্বমেধ ঘাটে স্নান করে অন্নপূর্ণার পুজো করে মণিকর্ণিকার ঘাটে বসে আছে, এমন সময় মা-ষষ্ঠী এক বুড়ি বামনীর বেশে এসে বললে "কি ভাবছ গো মা?"
বামনী বললে "আমার সব ছেলেমেয়েদের হারিয়েছি। এত পুজোআচ্চা সব বিফলে গেল আমাদের। সব অদৃষ্ট। ঠাকুর দেবতা বলে কিছ্ছু নেই।"
ষষ্ঠীবুড়ি বললেন "বারব্রত নিষ্ফল হয়না মা, ধর্মকর্ম যাই কর ঈশ্বরে বিশ্বাস চাই। তুমি মা-ষষ্ঠীকে মানো? তাঁর পুজো করেছ কখনো? তিনি সন্তানদের পালন করেন।
বামনী বললে "আমি এযাবতকাল সব ষষ্ঠী করে আসছি কিন্তু তবুও আমার ছেলেরা র‌ইল না।
ষষ্ঠীবুড়ি বললেন, "তুমি নীলষষ্ঠীর পুজো করেছ কখনো? চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন উপোস করে শিবের পুজো করবে। শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে জল খাবে। সন্তানদের মঙ্গলকামনা করবে" -- বামনী সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে পুনরায় মাতৃত্ব লাভ করল।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

10 April 2020

আজ ১০ই এপ্রিল গুড ফ্রাইডে। গুড ফ্রাইডে মূলত খ্রিষ্টানদের দ্বারা পালিত একটি ধর্মীয় উৎসবের ছুটির দিন। এই উৎসবের অন্য নাম হোলি ফ্রাইডে বা গ্রেট ফ্রাইডে।

আজ ১০ই এপ্রিল গুড ফ্রাইডে। গুড ফ্রাইডে মূলত খ্রিষ্টানদের দ্বারা পালিত একটি ধর্মীয় উৎসবের ছুটির দিন। এই উৎসবের অন্য নাম হোলি ফ্রাইডে বা গ্রেট ফ্রাইডে। কেউ কেউ একে ব্ল্যাক ফ্রাইডেও বলে থাকেন। আজ সারা বিশ্ব করোনার ত্রাসে জর্জরিত। গত একমাস ধরে মারণ ভাইরাসের কারণে বিশ্বের বহু দেশে চলছে লকডাউন। ফলে করোনার জন্য এ বছর অনেক জায়গায় গুড ফ্রাইডের অনুষ্ঠান বন্ধ। চার্চ সর্বত্র খোলা থাকলেও ভক্তদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বহু দেশে ভিডিয়ো কনফার্নেসর মাধ্যমে পালিত হবে এই গুড ফ্রাইডের অনুষ্ঠান। তবে কেন পালিত হয় গুড ফ্রাইডে, জেনে নিন এখানে...............

যিশুর বিচারের শাস্ত্রীয় বিবরণীগুলি থেকে জানা যায় যে তাঁকে সম্ভবত শুক্রবারে ক্র‌ুসবিদ্ধ করা হয়েছিল। দুটি ভিন্ন গোষ্ঠীর মতে গুড ফ্রাইডের বছরটি হল ৩৩ খ্রিস্টাব্দ। আইজ্যাক নিউটন বাইবেলীয় ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এবং অমাবস্যার তিথি বিচার করে গুড ফ্রাইডের যে প্রকৃত সালটি নিরুপণ করেছেন, সেটি হল ৩৪ খ্রিস্টাব্দ। ক্র‌ুসিফিকেশন ডার্কনেস অ্যান্ড একলিপস পদ্ধতি নামে একটি তৃতীয় পদ্ধতি হিসেব করে গুড ফ্রাইডের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ এপ্রিল, ৩৩ খ্রিস্টাব্দ।
যিশুর শিষ্য যিহুদা ইসকারিয়োতের সাহায্যে মন্দিরের রক্ষীদল গেৎশিমানি উদ্যানে যিশুকে গ্রেফতার করে। যিশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার পুরস্কার স্বরূপ যিহুদাকে ৩০টি রৌপ্যমুদ্রা দেওয়া হয়েছিল। যিহুদা রক্ষীদলকে বলে রেখেছিলেন যে তিনি যাঁকে চুম্বন করবেন তিনিই হবেন যিশু। যিশুর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ, সিজারকে রাজস্বদানে বাধা ও নিজেকে রাজা ঘোষণা করার অভিযোগ আনা হয়। পিলাত ইহুদি সমাজপতিদের নিজস্ব আইন অনুযায়ী যিশুর বিচার ও শাস্তিদানের অনুমতি দিলেন। যিশুকে ক্র‌ুশবিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। "নাজারেথের যিশু, ইহুদিদের রাজা" লেখা একটি ক্র‌ুস যিশু বয়ে নিয়ে চলেন গলগথা নামক স্থানে। তাঁকে ক্র‌ুস বহনে সাহায্য করেছিলেন সাইরিনের সিমন।

ছয় ঘণ্টা যিশু ক্র‌ুসে যন্ত্রণাভোগ করেন। শেষ তিন ঘণ্টায় (দুপুর তিনটে থেকে) অন্ধকারে সমগ্র অঞ্চলটি ঢেকে যায়। যিশু প্রাণত্যাগ করেন। ভূমিকম্প হয়, সমাধিপ্রস্তরগুলি ভেঙে যায় এবং প্রধান মন্দিরের পর্দা উপর থেকে নিচ অবধি ছিঁড়ে যায়। যে সেঞ্চুরিয়ন ক্র‌ুসবিদ্ধকরণের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন, "ইনি সত্য সত্যই ঈশ্বরপুত্র ছিলেন।"

আরিমাথিয়ার যোসেফ যিশুর দেহ পরিষ্কার ক্ষৌমবস্ত্রে মুড়ে ক্র‌ুসবিদ্ধকরণক্ষেত্রের অদূরে একটি বাগানে তাঁর নিজের জন্য নির্মাণ করা প্রস্তরখোদিত সমাধিমন্দিরে রেখে দিলেন। নিকদিম এলেন সোয়া মণ গন্ধরস মেশানো অগুরু নিয়ে। ইহুদি সৎকার প্রথা অনুযায়ী সেগুলি রেখে দিলেন আচ্ছাদন বস্ত্রে যিশুর দেহের সঙ্গে। একটি বড় পাথর দিয়ে তাঁরা সমাধির মুখ রুদ্ধ করে দিলেন। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সাব্বাথ শুরু হয়ে যাবে বলে তাঁরা শীঘ্র ঘরে ফিরে আসেন। তৃতীয় দিন, রবিবার, যিশু পুনরুজ্জীবিত হন।

খৃষ্টীয় ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী যিশু খ্রিষ্টের ক্র‌ুসবিদ্ধকরণ, মৃত্যু ও সমাধিমন্দির থেকে তাঁর পুনরুজ্জীবনের স্মরণে এই উৎসবটি পালিত হয়। পবিত্র সপ্তাহে ইস্টার রবিবারের আগের শুক্রবারে প্যাস্কাল ট্রিডামের অংশ হিসেবে এই উৎসব পালিত হয়। অনেক সময়ই গুড ফ্রাইডে ইহুদিদের উৎসব পাসওভারের সঙ্গে একই দিনে উদযাপিত হয়ে থাকে।