23 April 2020

২৩শে এপ্রিল, ভারতের তথা বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ে ২৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী।

২৩শে এপ্রিল, ২০২০ সাল কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ২৮ তম  মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি। ২৩শে এপ্রিল, ভারতের তথা বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ে ২৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, প্রকাশক,অনুবাদক, কাহিনীকার, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক।

১৯২১ সালের ২রা মে কলকাতা শহরের ১০০ নম্বর গড়পার রোডের এক খ্যাতনামা বাঙালি পরিবারে জন্মেছিলেন সত্যজিৎ রায়।  এই বাড়ির একতলাতেইছিল ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছাপাখানা। সত্যজিতের পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ ছিলেন বহুমুখী এবং তাঁর কাজের পরিমাণ বিপুল। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সত্যজিৎ চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ন, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, চিত্রগ্রহণ, শিল্প নির্দেশনা, সম্পাদনা, শিল্পী-কুশলীদের নামের তালিকা ও প্রচারণাপত্র নকশা করা সহ নানা কাজ করেছেন।

মানিক

সত্যজিৎ রায়ের জন্মের ছ বছর আগে মারা যান ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়। আর সত্যজিৎ রায়ের বয়স যখন  তিন  বছর তিনি তাঁর পিতা সুকুমার  রায়কে হারান। তাঁরা রেখে গিয়েছিলেন পারিবারিক ঐতিহ্যের সার্থক উত্তরাধিকারী বিশ্বসেরা  সত্যজিৎ রায়েকে। তবে তারা কেউই সত্যজিৎ রায়ের সাফল্য দেখে যেতে পারেননি।

বিধবা সুপ্রভবা দেবী ও পারিবারের  অন্যান্যদের সহচর্যে ছোট্ট সত্যজিৎ বড় হতে থাকলেন।

সত্যজিৎ রায়ের ডাক নাম ছিল মানিক। ' যখন ছোট ছিলাম ' গ্রন্থে  সত্যজিৎ  লিখেছিলেন- 'আমি যখন ইস্কুলে ভর্তি হই তখন আমার বয়স সাড়ে আট'। ফিফথ ক্লাসে (পরে নাম হয়েছিল ক্লাস সিক্স) ভর্তি হবার জন্য সত্যজিৎ লেবুমামার সাথে হাজির হন বালিগঞ্জ গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলে।সেখানে ক্লাসের একটি ছেলে সত্যজিতের নাম জানতে চায়। সত্যজিৎ তখন তাকে তাঁর ডাক নাম বলেন ' মানিক'। সত্যজিতের তখন ধারণা ছিল না চট করে ইস্কুলে নিজের ডাক নাম বলতে নেই। তখন থেকে ইস্কুলে ছেলেরা তাঁকে ভালো নাম ধরে ডাকেনি সেই থেকেই সত্যজিৎ হয়ে গেল মানিক বা আমাদের  সকলের প্রিয় মানিকদা।

পিতা সুকুমার রায় ও ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

সত্যজিৎ রায়ের বাবা সুকুমার রায় ছিলেন বাংলা কবিতা ও শিশুসাহিত্যের সেরা লেখকদের একজন। সত্যজিৎ রায়ের দাদামশাই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও ছিলেন একজন নামকরা লেখক, চিত্রকর, দার্শনিক ও প্রকাশক।উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী দ্বিতীয় স্ত্রী কাদম্বিনী দেবী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৮২ সালে প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট। এর পরে কাদম্বিনী বসু ডাক্তার হয়ে ছিলেন।  সত্যজিতের মা এবং রায় বংসের অন্য নারীদের জীবনেও সুগভীর প্রভাব ছিল এই নারীর। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তার সমবয়সী রবীন্দ্রনাথের তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং প্রায়সই তিনি ঠাকুর বাড়িতে যাতায়াত  করতেন।

মাত্র তিন বছর বয়সে বাবাকে হারান সত্যজিৎ। মা সুপ্রভা দেবী বহু কষ্টে তাঁকে বড় করেন। বিশ্বখ্যাত রত্ন সত্যজিৎ বড় হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি পড়তে যান। ১৯৪০ সালের দিকে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকবছর পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৪৩ সালে শান্তিনিকেতন ছেড়ে তিনি কলকাতায় এসে ৮০ টাকা বেতনে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ শুরু করেন।

তাঁর কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু হলেও পরে লণ্ডন শহরে সফরকালে ইতালীয় চলচ্চিত্র দেখার পরই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হন।

সত্যজিৎ রায় প্রায় ৩৭ টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। এরমধ্যে রয়েছে কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। তিনি ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক, প্রকাশক এবং চলচ্চিত্র সমালোচকও।

'পথের পাঁচালি'

১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালি নির্মানের কাজ শেষ করেন। সেই ছবি এখনও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা দেয়। ১৯৪৯ সালে মার্চ মাসে জাঁ রেনেয়োঁর কলকাতায় আসেন তার 'দি রিভার' ছবির শুটিং করতে। এর পর থেকেই সত্যজিৎ তাঁর সাথে দেখা করতে যেতেন। তাঁদের সাথে আলোচনা হত। রেনেয়োঁর সংস্পর্শে এসে সত্যজিতের মনে গভীর ভাবে চলচ্চিত্র পরিচালনা করার একটা ইচ্ছা সযত্নে বাড়তে থাকে। ১৯৫০ সালে সত্যজিৎ সস্ত্রীক ইংল্যান্ডে যান।। সেখানে তিনি দেখেন 'বাই সাইকেল থীভস'। এর পর চার মাসে তিনি ৯৯ টি বই দেখেন। চলচ্চিত্র পরিচালনা করার একটা ইচ্ছা তীব্রতা বাড়তে থাকে 'বাই সাইকেল থীভস' দেখার পর।

১৯৫১ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পথে পথের পাঁচালির চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন সত্যজিৎ। সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়ের কাছ থেকে জানা যায় পথের পাঁচালি যে কত কষ্ট করতে হয়েছে তা ভাবলে এখন গল্পের মতন লাগে। প্রযোজকের বাড়ি গিয়ে চিত্রনাট্য পড়ে শোনাতে হত। অনেকে ঠাট্টা তামাশাও করতেন। এখানে নাচ নেই, গান নেই, প্রেমিক প্রেমিকা নেই, এ ছবি চলবে কি করে? এর মধ্যে একজন প্রযোজকের পছন্দ হল। কিন্তু বাজারে ভদ্রলোকের ছবি সবে মাত্র মুক্তি পেয়েছে। তার ছবি চললে তিনি মানিকের ছবি নিয়ে ভাববেন। দুর্ভাগ্যবশত ছবিটা বাজারে চলেনি, ফলে তিনি আর মানিকের ছবিটা করতে রাজি হলেন না। তাই শুরু হল নিজের টাকায় শুটিং। এর পর তার প্রথম ছবি পথের পাঁচালির শুটিং শুরু করেন ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাস থেকে। বিজয়া রায়ের জন্ম দিন ২৭শে অক্টোবর  অপু দুর্গাকে নিয়ে কাশফুলের ক্ষেতে শুরু হয় শুটিং। টাকা ফুরিয়ে এলে বিজয়া রায়ের গয়না বন্ধক দিয়ে অর্থের জোগার হয়। মাঝে শুটিং বন্ধ হয়ে গেলে সত্যজিৎ রায় মহা চিন্তায় পড়লেন।চুনিবালা দেবী  বৃদ্ধা।  তার কিছু হলে পথের পাঁচালি বন্ধ করে দিতে হবে। অপু দুর্গার যা বয়স ছিল দেরী হয়ে বয়স বেড়ে গেলে তাদের আর চরিত্রে মানাবেনা। প্রায় তিন মাস শুটিং বন্ধ থাকার পর পশ্চিম্বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর বিধান চন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় টাকার যোগান হয়।

‘পথের পাঁচালি’ সিনেমা নির্মাণের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের যাত্রা শুরু। তাঁর নির্মিত পথের পাঁচালি ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। এর মধ্যে অন্যতম ১৯৫৬ কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” পুরস্কার।

পথের পাঁচালি, অপরাজিত এবং অপুর সংসার এই তিনটি একত্রে অপু ত্রয়ী নামে পরিচিত। এই ত্রয়ী সত্যজিতের জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্মজীবন হিসেবে স্বীকৃত। অপুর ট্রিলজি গোটা পৃথিবীর মানুষ কে একটা চিরন্তন সত্যের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জীবনে দুঃখ, কষ্ট,মৃত্যু, যন্ত্রণা থাকলেও জীবন থেমে থাকে না। এই ছবিতে তারই ইতি বাচক সন্ধান আমরা পাই। অনেকে মনে করেন পথের পাঁচালি কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পাওয়ার পরে আমাদের দেশে সন্মান পেয়েছে। ছ সপ্তাহ বসুশ্রী হলে  ভিড় উপচে পড়ে পরে ছবিটি ইন্দিরা হলে নিয়ে যাওয়া  হয়। সেখানেও ভিড় উপচে পড়ে। ১৯৪৯ সালে দীর্ঘদিনের পরিচিত বিজয়া দাসকে তিনি বিয়ে করেন। সত্যজিৎ-বিজয়ার ছেলে সন্দীপ রায়ও বর্তমানে একজন নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালক।

সত্যজিৎ রায় সমাজের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতাথেকেই একের পর এক ছবি করে গেছেন। এরপর একে একে নির্মাণ করেন, পরশ পাথর , জলসা ঘর(জমিদারি প্রথার অবক্ষয় নিয়ে নির্মিত ‘জলসাঘর’)।  অপুর সংসার, অভিযান, মহানগর, কাপুরুষ ও মহাপুরুষ , নায়ক, গুপি গাইন বাঘা বাইন , অরণ্যের দিন রাত্রি, সীমাবদ্ধ, অশনি সংকেত সোনার কেল্লা জন অরণ্য, শতরঞ্জ কি খিলাড়ী, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, ঘরে বাইরে, গণশত্রু, শাখা প্রশাখা এবং সর্বশেষ বানানো সত্যজিতের সিনেমার নাম আগুন্তুক। সত্যজিতের অমর সৃষ্টি ‘ফেলুদা’ তাঁর সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর বয়ে চলছে যুগ থেকে যুগান্তরে।

জলসা ঘর, দেবী ও কাঞ্চনজঙঘা সমাজ চেতনার তিনটি আসামান্য সৃষ্টি। ১৯৬২ সালে সত্যজিৎ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নামে প্রথম মৌলিক চিত্রনাট্যনির্ভর রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। দার্জিলিংয়ের এক পাহাড়ি এলাকায় একটি উচ্চবিত্ত পরিবারে কাটানো এক বিকেলের কাহিনি নিয়ে জটিল ও সংগীতনির্ভর এই ছবিটি বানিয়েছিলেন তিনি।

পরস পাথর- এ তিনি হাসি-মজাও কারুণ্যের মধ্যেদিয়ে মধ্যবিত্তের অর্থলোভ, বড়োলোক হবার বাসনাকে সুন্দর ভাবে ব্যঙগ করেছেন।‘পরশপাথর’ নামের হাস্যরসাত্মক একটি ছবি। আর পরেরটি ছিল এর বাইরে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলো হচ্ছে ‘দেবী’ (১৯৬০), ‘তিন কন্যা’ (১৯৬১) ও ‘অভিযান’ (১৯৬২)।

শতরঞ্জ কি খিলাড়ীতে তিনি বিদেশি শক্তির সাথে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর ও রাজতন্ত্রের সহযোগীতা এবং এই শ্রেণীর সুবিধাবাদী চরিত্র।বাংলা চলচ্চিত্রের বাইরে সত্যজিৎ রায় ১৯৭৭ সালে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ নামের হিন্দি ও উর্দু সংলাপনির্ভর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এটিই ছিল বাংলা ভাষার বাইরে অন্য ভাষায় নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র। শুধু তা-ই নয়, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ হচ্ছে সত্যজিৎ রায় নির্মিত সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও তারকাসমৃদ্ধ ছবি। ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন সঞ্জীব কুমার, সাইদ জাফরি, আমজাদ খান, শাবানা আজমি, ভিক্টর ব্যানার্জি ও রিচার্ড অ্যাটেনবরোর মতো তারকা অভিনয়শিল্পীরা।

গুপি গাইন বাঘা বাইনে বিরোধী শক্তির কথা বলেছেন। আর পরবর্তী ছবি হীরক রাজার দেশেতে দেখিয়েছেন মানুষের কাছে ফিরে আসার কথা বলেছেন সত্যজিৎ।

১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ নির্মাণ করেন ‘চারুলতা’। যেটি ছিল তাঁর কর্মজীবনের সফল ছবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে নির্মিত ছবিটিতে উনিশ শতকের এক নিঃসঙ্গ বাঙালি বধূ চারু ও ঠাকুরপো অমলের প্রতি তার অনুভূতির কাহিনি বাস্তব জীবনের নিরিখে নির্মাণ করা হয়েছে। ‘

'ঘরে বাইরে'

পথের পাঁচালির আগে সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে বাইরে (১৯১৬ সালের) উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র করতে চেয়েছিলেন। সে জন্য সত্যজিৎ ঘরে বাইরে' র প্রথম চিত্রনাট্য লিখে ফেলেন। নানা কারণে তখন ছবিটি করা হয়ে ওঠেনি।সত্যজিতের তরুণ  বয়সের ভাবনা নিয়ে ঘরে বাইরে' বাস্তবে রূপ পেয়েছিল ৩৯ বছর পর। এর ফলে ঘরে বাইরে' নিয়ে ভাবনার অনেক গর্বেষণা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এর ফল স্বরূপ একটি নিখুঁত ছবি ১৯৮৪ সালে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে।১৯৮৩ সালে ছবির কাজ করার সময় সত্যজিৎ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত। এরপর তাঁর কাজের গতি একেবারে কমে আসে। স্বাস্থ্যের অবনতির ফলে ছেলে সন্দীপ রায়ের সহায়তায় ১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’ ছবিটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন।

সত্যজিতের ৩৬ বছর চলচ্চিত্র জীবনে মোট ২৭টি ফিচার ফ্লিম ও ৫ টি তথ্যচ্চিত্র করে ছিলেন। ১৯৬১ সালে প্রথম তথ্যচ্চিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা নতুন দিগন্তের আলো দেখিয়েছিল।

সন্দেশ  ও লেখক সত্যজিৎ

উপেন্দ্রকিশোরের অন্যতম শ্রেষ্ঠকীর্তি হল ১৩২০ সালের ছোটদের "সন্দেশ" পত্রিকার প্রকাশ। সেই সময় ঐ রকম একটা সুন্দর ছোটদের মাসিক পত্রিকার কথা কেউ কল্পনা করতে পারত না। ১৯৬১ সালের মে মাসে সত্যজিৎ রায় বন্ধু কবিসুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সত্যজিৎ 'সন্দেশ' পত্রিকার প্রকাশ পুনরায় করেন। তিনি নিজের বাড়িতে বসেই নিয়মিত 'সন্দেশ' এর লেখা, ছাপা, মলাট, ছবি আর লে আউট যত্নের সাথে তৌরী করে দিতেন।

সন্দেশের প্রয়োজনেই সত্যজিৎ চল্লিশ বছর বয়সে তার লেখক জীবন শুরু করেন।

নতুন ম লাট,  ছবি আর হেড পিস তিনি আকতে লাগলেন। ১৯৬৫ সালে তিনিতার লেখা শঙকুর কয়েকটি গল্প নিয়ে প্রথম প্রকাশিত হ ল 'প্রফেসর শঙকু' নামের বইটি। এই বইটি কিশোর গ্রন্থ রূপে একাডেমি পুরস্কার পান। সন্দেশের প্রয়োজনে 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি' নামে আর একটি উপন্যাস লেখেন।

১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ চিদানন্দ দাসগুপ্ত ও অন্যান্যদের সঙ্গে মিলে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।সত্যজিতকে অন্যতম সাংস্কৃতিক আইকন হিসেবেও গণ্য করা হয়।

ফ্রান্সের সরকার ১৯৮৭ সালে তাঁকে সেদেশের বিশেষ সম্মনসূচক পুরস্কার ‘লেজিওঁ দনরে’ প্রদান করেন। ১৯৮৫ সালে অর্জন করেন ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে। ১৯৯২ সালে ভারত সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার ভারত রত্ন সম্মাননা প্রদান করে। এছাড়াও তিনি পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।

১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস (অস্কার) তাঁকে আজীবন সম্মান পুরস্কার প্রদান করে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভারত সরকার তাঁকে ভারতরত্ন প্রদান করে। মৃত্যুর পর তাঁকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়।

সেবছর প্রখ্যাত ফরাসি পরিচালক জ্যঁ রেনোয়া তার ‘দ্য রিভার’ চলচ্চিত্রটির শুটিং করতে কলকাতায় এসেছিলেন। ‘দ্য রিভার’ ছবিতে রেনোয়ার সহকারীর কাজ করেন তিনি। এই সময় থেকে চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার স্বপ্ন বোনেন সত্যজিৎ। জানা যায়, ‘দ্য বাই সাইকেল থিফ’ ছবিটি দেখার পর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।

১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায় তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করেন। প্রথম চলচ্চিত্র তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। ‘পথের পাঁচালী’ মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। এটি কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরস্কারও অর্জন করে।

এই নির্মাতার বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে অপুর সংসার, মহানগর, চারুলতা, সোনার কেল্লা, হীরক রাজার দেশে, নায়ক অন্যতম।
চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের সৃজনশীলতা ছিল বহুমুখী। তার কাজের পরিধি ছিল অনেক। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’—এই তিনটি চলচ্চিত্রকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত।

সত্যজিৎ রায়  জীবদ্দশায় বহু পুরস্কার পেয়েছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।  ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার সত্যজিৎ রায়কে বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার লেজিওঁ দনরে ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন। ভারত সরকারের ভারতরত্নসহ বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

২০০৪ সালে, বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তালিকায় সত্যজিৎ ১৩তম স্থান লাভ করেছিলেন।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন সত্যজিৎ। বিশ্বভারতীতে পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও এর আগেই ১৯৪৩ সালে শান্তিনিকেতন ছেড়ে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। এখানে এসেই একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় মাত্র ৮০ টাকা বেতনে চাকরি নেন। ঘটনাচক্রে একই বছর প্রখ্যাত ফরাসি পরিচালক জ্যঁ রেনোয়া তাঁর ‘দ্য রিভার’ চলচ্চিত্রটির শুটিং করতে কলকাতায় আসেন। ‘দ্য রিভার’ ছবিতে রেনোয়ার সহকারীর কাজ করতে গিয়েই সম্ভবত পুরোপুরিভাবে এক চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা শুরু করেন সত্যজিৎ। তবে ‘দ্য বাই সাইকেল থিফ’ ছবিটি দেখার পরই বোধহয় তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।

হৃদযন্ত্রের জটিলতার কারণে সত্যজিৎ ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল  মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।সত্যজিৎ রায় বেঁচে আছেন তাঁর ছবির মধ্যে, বেঁচে আছেন তাঁর লেখনির মধ্যে দিয়ে।শুধুমাত্র ভারতে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় চলচ্চিত্র জগতে সুনাম অর্জন করেছেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়।ভারতের চলচ্চিত্র জগত বিশ্বের দরবারে  যাত্রা শুরু করে সত্যজিতের হাত ধরেই।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

No comments:

Post a Comment