30 March 2019

আজ ৩০শে মার্চ, লেখক ও চিত্রনাট্যকার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১২০তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করলেই তাঁর সৃষ্টি গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর কথা মনে পড়ে যায়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় 'পথের কাঁটা' গল্পে প্রথম ব্যোমকেশের আত্মপ্রকাশ ঘটান। তখন তাঁর বয়স ৩৩ বছর। এর পরের গল্প 'সীমান্তহীরা'। এই দুটি গল্প লেখার পর তিনি ব্যোমকেশকে নিয়ে একটি সিরিজ লেখার পরিকল্পনা করেন। ব্যোমকেশ বক্সী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র। ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ নিজেকে 'সত্যান্বেষী' বলে পরিচয় দেয়৷ পাঠকরা  'সত্যান্বেষী' গল্পটাকেই ব্যোমকেশের প্রথম গল্প হিসাবে ধরে। এই ডিটেকটিভ ব্যোমকেশকে নিয়ে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মোট ৩২টি গল্প -উপন্যাস লেখেন। ব্যোমকেশ চরিত্রটি নিয়ে বাংলা এবং হিন্দী দুটি ভাষাতেই অনেক সিনেমা তৈরী হয়েছে।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর শহরে মামার বাড়িতে। তাঁর আদি নিবাস ছিল উত্তর কলকতার বরানগরে। ১৯২৬ সালে পটনা থেকে আইন পাশ করে তিনি বাবার জুনিয়র হিসাবে ওকালতি শুরু করেন। ১৯২৯ সালে ওকালতি ছেড়ে তিনি সাহিত্য চর্চাতে মন দেন।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত প্রথম সাহিত্য প্রকাশিত হয় তাঁর ২০ বছর বয়সে, যখন তিনি কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে  পড়াশুনো করছিলেন। সেটা ছিল বাইশটি কবিতার সংকলন 'যৌবন স্মৃতি'। পড়াশুনোর সাথেই তিনি সাহিত্য চর্চা করতে থাকেন। তাঁর রচনার মধ্যে আছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপন্যাস। যেমন 'কালের মন্দিরা', 'গৌর মল্লার', 'তুমি সন্ধ্যার মেঘ', 'তুঙ্গভদ্রার তীরে', ইত্যাদি। সামাজিক উপন্যাস যেমন 'জাতিস্মর', 'বিষের ধোঁয়া' বা অতিপ্রাকৃত নিয়ে তার 'বরদা সিরিজ' ও অন্যান্য গল্প এখনো বেস্টসেলার। শরদিন্দু ছোটগল্প ও শিশুসাহিত্য রচনাতেও পারদর্শী ছিলেন।

শরদিন্দু ১৯৩৮ সালে বম্বের বম্বে টকিজ এ চিত্রনাট্যকাররুপে কাজ শুরু করেন। ১৯৫২ সালে সিনেমার কাজ ছেড়ে স্থায়ীভাবে পূনায় বসবাস করতে শুরু করেন। পরবর্তী ১৮ বছর তিনি সাহিত্য চর্চায় অতিবাহিত করেন।

তাঁর অনান্য উপন্যাস- গল্প থেকেও সিনেমা তৈরি হয়েছে, যেমন উত্তম কুমারকে নিয়ে সত্যজিত রায়ের চিড়িয়াখানা। তপন সিংহের 'ঝিন্দের বন্দী', তরুণ মজুমদারের 'দাদার কীর্তি' ইত্যাদি সিনেমা বাঙালি দর্শকের মন জয় করেছিল। সত্যজিত রায়ের ছেলে সন্দীপ রায় শরদিন্দুর 'মনচোরা' উপন্যাস নিয়েও সিনেমা করেন।

১৯৭০ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার, শরৎস্মৃতি পুরস্কার, মতিলাল পুরস্কার সহ অন্যান্য পুরস্কার লাভ করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

23 March 2019

২৩ মার্চ, ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ শাসনকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীনতার জন্য হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন ভগৎ সিং, সুখদেব থাপার ও শিভারাম রাজগুরু।

২৩ মার্চ, ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ শাসনকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীনতার জন্য হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন ভগৎ সিং, সুখদেব থাপার ও শিভারাম রাজগুরু। তাঁদের আত্মবলিদানের  ৮৮তম বার্ষিকীতে আমরা শ্রদ্ধা জানাই।

পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সরাসরি সশস্ত্র পথে বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন ভগৎ সিং, সুখদেব থাপার ও শিভারাম রাজগুরু৷ লাহোরে আন্দোলনকারী লালা লাজপত রায়ের উপর চড়াও হয়েছিল ব্রিটিশ পুলিশ৷ লাঠির আঘাতে মৃত্যু হয় লালা লাজপত রায়ের৷ প্রত্যাঘাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদের নেতৃত্বে হিন্দুস্তান সোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোশিয়েসন৷ গুলি করা হয় লাহোরের অ্যাসিস্টেন্স পুলিশ কমিশনার জন স্যান্ডার্সকে এবং মৃত্যু হয় তার৷ ঘটনায় প্রত্যক্ষ যোগ ছিল ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুর৷

ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদেরকে দমনের জন্য পুলিশকে অধিক ক্ষমতা প্রদান করে ভারত প্রতিরক্ষা আইন পাশ করার সমস্ত প্রক্রিয়া চুড়ান্ত করে। ১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে আইনটির অধ্যাদেশ পাশ হবার সিদ্ধান্ত হয়। এই আইনকে রুখে দেওয়ার জন্য সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর বোমা নিক্ষেপ করে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগান দেন, যে-আওয়াজ ওইভাবে এর আগে কখনো শোনা যায়নি। পলায়নের চেষ্টা না-করে তাঁরা নির্ভয়ে ইস্তাহার বিলি করতে থাকেন। এসময় পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করে। লাহোড় ষড়যন্ত্র মামলায় সুখদেব ও রাজগুরুও ধরা পড়ে যান।

তিন ব্রিটিশ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল লাহোড় ষড়যন্ত্র মামলায় ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে অপরাধী সাব্যস্ত করে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় প্রদান করে। তখন বিপ্লবীদের বয়স মাত্র ২৩-২৪ বছর। ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ সন্ধ্যা ৭ টায় এই তিন বিপ্লবীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

22 March 2019

ভারতের বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্য সেনের ১২৫তম জন্ম বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে মাষ্টারদা সূর্য সেনের নাম ভারতবাসীরা চিরদিন মনে রাখবে। ব্রিটিশ ভারতের এই বিপ্লবী ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন-সহ অনেক  বিপ্লবের কান্ডারী ছিলেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বেই কিছুকালের জন্য বাংলার এক নিভৃত স্থানে বাঙালির স্বাধীনতার পতাকা উড়েছিল। পুরো নাম সূর্যকুমার সেন। তবে মাষ্টারদা নামে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। ওঁনার স্মরণে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারের পাশ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটির নাম হয়েছে সূর্য সেন স্ট্রীট। তাছাড়া বাঁশদ্রোনী এলাকার মেট্রো স্টেশনের নাম হয়েছে মাস্টারদা সূর্য সেন। 
মাস্টারদা সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২শে মার্চে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নোওয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বহরমপুর কলেজে পড়ার সময় তিনি বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। চট্টগ্রামে ফিরে তিনি গণিতের শিক্ষক হিসেবে ওরিয়েন্টাল স্কুলে শিক্ষকতা গ্রহণ করেন এবং সেখানে ছাত্রসমাজ ও যুবসমাজের মধ্যে বিপ্লবী অন্দোলনের প্রচারের মাধ্যমে শক্তিশালী বিপ্লবী সংগঠন তৈরী করেন। সকলের প্রতি তাঁর দরদ ছিল অপরিসীম এবং খুব শীঘ্রই তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠে মাস্টারদা নামে পরিচিতি হন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ১৯২১ সালে  গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অহিংস আন্দোলন এক বৎসরের ভিতর ভারতের স্বারজ আনতে ব্যর্থ হলে, বিপ্লবীরা আবার সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেন।  
১৯২৩ সালে ২৪ই ডিসেম্বর চট্টগ্রাম শহরে একপ্রান্তে  পাহাড়ী এলাকায় পুলিশের সাথে খন্ডযুদ্ধে  মৃতপ্রায় মাস্টারদা ও অম্বিকা চক্রবর্তী পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। পরে পুলিশ হাসপাতালে তাঁদের চিকিৎসা করার পর তাঁরা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডাকাতির মামলা রুজু করেছিল হয়েছিল। যতীন্দ্র মোহন এই মামলা পরিচালিত করেন এবং প্রায় ৯ মাস কারাবন্দি থাকার পর প্রমাণাভাবে তাঁরা মামলা থেকে তাঁরা খালাস পান।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় একটি অস্ত্রলুটের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় মাস্টারদার নাম শোনা যায়। বিপ্লব আন্দোলন সংগঠিত করতে পুলিশের চোখ এড়িয়ে তাঁকে প্রায়ই কলকাতায় এসে শোভাবাজারে বিপ্লবীদের আস্তানায় উঠতেন। ১৯২৫ সালের ১০ই নভেম্বর সেখানে পুলিশ হানা দেয়। পুলিশ শোভাবাজারে মাস্টারদাকে ধরতে গেলে তিনি গামছা পরে চাকরের বেশে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান। 
এর প্রায় একবছর পর ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক মেস থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় 'মুরারিপুকুর ষড়যন্ত্র মামলা'। এ মামলায় ১৯২৮ সাল পর্যন্ত  তাঁকে মেদিনীপুর প্রেসিডেন্সি জেল, পুনার রায়েরোড়া জেল ও বম্বের রত্নগিরি জেলে কারাবাস করতে হয়।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে ফিরে এসে তিনি চট্টগ্রামের বিপ্লবী সংগঠনে তাঁদের গোপন বৈঠকে চূড়ান্ত সংগ্রামের এক পরিকল্পনা করেন। মাস্টারদা স্বীয় কর্মপন্থাকে কার্যকরী করার জন্য ছক তৈরী করে ফেলেন। এর চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল গুডফ্রাইদের দিনে যখন ইংরেজরা বিভিন্ন আনন্দ উৎসবে মত্ত থাকে। মোট ৬৫ জন বিপ্লবী যোদ্ধা নিয়ে পাঁচ প্রকার কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন। ১) পুলিশ ঘাঁটি দখল করে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া ২) চট্টগামের সৈন্যবাহিনীর অস্ত্রাগার ঘাঁটি ধ্বংস করে অস্ত্র লুট করা ৩) কলকাতা ও ঢাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা ৪) চট্টগ্রামের সাথে  রেল ও টেলিগ্রাফ সংযোগ বন্ধ করা ৫) ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলো আক্রমণ করে ইংরেজদের বন্দি করা। সিন্ধান্ত অনুযায়ী কাজও চলল। রাত ১০টা নাগাদ চট্টগাম অস্ত্রাগারে বেশ কিছুক্ষণ খন্ডযুদ্ধ চলে এবং অস্ত্র লুট করে গাড়ী বোঝাই করে বিপ্লবীরা পুলিশ ব্যারাক ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আক্রমণ চালায়। এই অতর্কিত আক্রমণে মোট ১১ জন পুলিশ নিহত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে সব বিপ্লবীরা পুলিশ ব্যারাকে সমবেত হন। মাস্টারদাকে অধিনায়ক করে এক অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয় যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। 
এই সময় শহরের অপর প্রান্ত থেকে কিছু ব্রিটিশ সৈন্য বিভ্রান্তি অবস্থার মধ্য থেকেও ডবল মুরিং জেটিতে রক্ষিত স্বয়ংক্রিয় ম্যাশিনগান থেকে গুলি বর্ষণ শুরু করেছিল। বিপ্লবীরা জানতো স্বয়ংক্রিয় ম্যাশিনগানের বিরুদ্ধে তাঁরা যুদ্ধে পারবেন না। এই আক্রমণের সময় রাত্রের অন্ধকারে অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ, আনন্দগুপ্ত, জীবন ঘোষাল মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। বাকি সদস্যদের নিয়ে  মাস্টারদা সূর্যসেন  পাহাড়ে আশ্রয় নিল। ২২শে ‌এপ্রিল বিকালে  বৃটিশ বাহিনী জালালাবাদ পাহাড়ে অভিযান শুরু করে। ব্রিটিশ সৈন্যরা পাহাড় বেয়ে উঠ আসার সময় বিপ্লবীরা আক্রমণ চালায়। জালালাবাদ যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন ১৪ বৎসর বয়সী টেগরা বল। এরপর আগে পরে একে একে বিপ্লবীরা যুদ্ধে প্রাণ হারাতে থাকেন। এই দিনের যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী জালালাবাদ পাহাড় দখল করতে পারেনি। বিপ্লবীদের নিয়ে  মাস্টারদা সূর্যসেন রাতের অন্ধকারে জালালাবাদ পাহাড় ত্যাগ করেন। 
মাস্টারদা কোয়েপাড়ার বিনয় সেনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এই সময় তাঁর সাথে ছিল অপর বিপ্লবী নির্মল সেন।মাস্টারদা সূর্য সেনের দলের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু সূর্যসেন ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলেন। এই সময় তাঁর গ্রেফতারের জন্য পুরস্কার ঘোষণাও করা হয়েছিল। এরই ভিতরে ১৩ জুন পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে বিপ্লবীরা মিলিত হন। এই বাড়িতে তখন ছিলেন সূর্যসেন, নির্মল সেন,  প্রীতিলতা এবং অপূর্ব সেন। সেখানে আচম্বিতে গুর্খা সৈন্য নিয়ে হানা দেয় ক্যাপ্টেন ক্যামেরন। যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন নিহত হয়। পরে প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেনকে নিয়ে মাস্টারদা সন্তর্পণে এই বাড়ি ত্যাগ করেন। এই সময় সৈন্যদের গুলিতে অপূর্ব সেন মৃত্যবরণ করেন।    
এরপর  মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন। এ অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হল প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে আক্রমণ করা হল ইউরোপীয়ান ক্লাব। সফল আক্রমণ শেষে ফেরার পথে এক ইংরেজ অফিসারের গুলিতে প্রীতিলতা আহত হলেন। ধরা না দেবার প্রত্যয়ে সঙ্গে রাখা সায়ানাইড বিষ পান করে তিনি আত্মাহুতি দিলেন। ভারতের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম নারী শহীদের নাম প্রীতিলতা।
মাস্টারদা সূর্য সেন ১৯৩৩ সালে ২রা ফেব্রুয়ারি গৈরালা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই সময় ইংরেজ সরকার তাঁর মাথার দাম ধার্য করেছিল দশ হাজার টাকা। মাস্টারদা সূর্য সেনের গোপন অবস্থানের কথা জানতে পেরে ক্যাপ্টেন ওয়ামস্‌লীর নেতৃত্বে একদল গুর্খা সৈন্য মাস্টারদাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। 
বিচারে মাস্টারদার ফাঁসির আদেশ হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্য রাতে  ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দেন বাংলার বীর বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন।  
প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

আজ ২২শে মার্চ ভারতের বিপ্লবী ও কমিউনিস্ট নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ১৩২তম জন্ম বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


ভারতের বিপ্লবী ও কমিউনিস্ট নেতা   মানবেন্দ্রনাথ রায় ১৮৮৭ সালের ২২শে মার্চ পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার আড়বেলিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত এ নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি গ্রেফতারি এড়ানোর জন্য সানফ্রান্সিসকোতে মানবেন্দ্রনাথ রায় এই ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। এই বিপ্লবী কমিউনিজমের ধ্যান-ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

মানবেন্দ্রনাথ রায় জাতীয় বিপ্লববাদী দল ‘অনুশীলন সমিতি’র সদস্য ছিলেন। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তিনি পাড়ি দেন বিদেশে। জাপান, চীন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান।বিপ্লবী জীবনে নানা দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন। একসময় তিনি ফিলিপিনস জাপান হয়ে ১৯১৬ সালে নিউইয়র্ক চলে আসেন। এখানেই দেখা হয় লালা লাজপত রায়ের সাথে। এখানে এসে মানবেন্দ্রনাথ মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং মার্কসবাদ চর্চা শুরু করেন। একদিন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি সভা শেষ করে ফেরার পথে গ্রেফতার হন। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর মার্কিন গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে মেক্সিকোতে পালিয়ে যান।

১৯১৭ সালে মেক্সিকোতে গিয়ে সমাজবাদী চিন্তা তাকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। সেখানকার সমাজবাদী দল সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টিতে যোগ দেন। সেই পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। ১৯১৯ সালে রুশ কমিউনিস্ট নেতা লেনিনের দূত মাইকেল বরোদিনের সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের পরিচয় হয়। কমরেড বরোদিনের কাছে রায় মার্কসবাদের শিক্ষা লাভ করেন। ১৯১৯ সালে তিনি সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টিকেই মার্কসবাদী দলে রূপান্তরিত করেন এবং মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে পৃথিবীর প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয়। মানবেন্দ্রনাথ রায় ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে প্রবাসী ভারতীয় ও দুজন বিদেশি মহিলাকে নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। এই দু জন মহিলাদের মধ্যে একজন ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের স্ত্রী ইভলিন ট্রেন্ট এবং অন্যজন ছিলেন অবনী মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী রোজা ফিটিনগফ। ১৯২১ সালে তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিকের অনুমোদন পায়।
১৯২৭ সালের মে মাসে তিনি  চীন দেশে হয়ে তিনি বার্লিন  যান। সেখানে এক বছর কাটান। এ সময় ইভলিন ট্রেন্টের সঙ্গে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। মানবেন্দ্রনাথ মস্কোতে ফিরে আসেন।

১৯৩০ সালের ডিসেম্বর মাসে মানবেন্দ্রনাথ  ভারতে চলে আসেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনকে সংগঠিত করেন। ১৯৩১ সালের ২১ জুলাই বোম্বের এক হোটেল থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় পুলিশ তার বিরুদ্ধে কানপুর যড়যন্ত্র মামলা (১৯২৪) দায়ের করে। তাঁকে ৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।  তিনি জেলখানায় বসে প্রচুর পড়াশোনা এবং লেখালেখি করেন।

১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে মানবেন্দ্রনাথ কংগ্রেসে যোগদান করেন। কিন্তু কংগ্রেসে মার্কসবাদ সুবিধা করতে পারেনি। জনমানুষের তাৎপর্য বুঝে উঠতে পারেনি। যে কারণে গান্ধীর সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতপার্থক্যের বিষয়টি আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৪০ সালের অক্টোবরে মানবেন্দ্রনাথ রায় কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছর ‘লীগ অব র‌্যাডিক্যাল কংগ্রেসমেন’-এর সিদ্ধান্ত হয় লীগের সবাই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করবেন এবং সংগঠনের নতুন নাম হবে ‘র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পিপলস পার্টি’। নাম পরিবর্তনের পাশাপাশি আন্দোলনের রূপ পাল্টায়। ১৯৪২ সালে কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের বিরোধিতা করার কারণে মানবেন্দ্রনাথ ও র‌্যাডিক্যালদের অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়।

মানবেন্দ্রনাথ রায় অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। ১৭টি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তার রচিত ৬৭টি গ্রন্থ ও ৩৯টি পুস্তিকার কথা জানা যায়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘নিউ হিউম্যানিজম’ (১৯৪৭), মাই মেমোয়ার্স (১৯৫৪), রেভলিউশন অ্যান্ড কাউন্টার রেভলিউশন ইন চায়না, রিজন রোমান্টিসিজম অ্যান্ড রেভলিউশন ইত্যাদি।

মানবেন্দ্রনাথ রায় ১৯৫৪ সালের ২৪-২৫শে জানুয়ারি মধ্যরাতে দেরাদুনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

20 March 2019

আজ ২০শে মার্চ খ্যাতনামা সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ২৬তম প্রয়াণ দিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় ৩রা জুলাই, ১৯০৪ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মাদারীপুরে জন্মগ্রহন করেন। ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে স্কটিশচার্চ কলেজ ভর্তি হন কিন্তু অর্থিক অনটনে কলেজ ছাড়তে হয়।

১৯২৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় তার কর্মজীবন শুরু হয়। অর্থসঙ্কটে ভুগতে থাকা ঐতিহ্যবাহী যুগান্তর পত্রিকাকে পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। একইভাবে অর্থাভাবে ক্লিষ্ট বসুমতীর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করে পত্রিকাটিকে সচল করেন।

সাংবাদিকতা ছাড়া যুদ্ধ সংক্রান্ত লেখালিখিতে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় খ্যাতি লাভ করেন। "জাপানী যুদ্ধের ডায়েরী" এবং "রুশ জার্মান সংগ্রাম" বই দুটি  পাঠক মহলে খুব সমাদৃত হয়। এরপর তিনি "দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাস" গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিস্তৃত ইতিহাস এর আগে বা পরে বোধ হয় লেখা হয়নি। লেখক তাঁর সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধানে বিশ্বযুদ্ধে জড়িত চার্চিল, রুজভেল্ট, স্ট্যালিন, হিটলার ও অনান্য মহানায়কদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ঠও দক্ষতার সাথে বর্ণনা করেছেন। এই আসীম সাহসী সাংবাদিক ১৯৫০ সালে যুগান্তর পত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামিক মৌলবাদ দ্বারা অনুষ্ঠিত ভয়াবহতম হিন্দু গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। সে সময় যুগান্তর পত্রিকা প্রায় নিষিদ্ধ হতে চলেছিল এবং সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেবার অভিযোগে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি পরোয়ানা তৈরী হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঘটনাবলীর ভয়াবহতা স্বীকার করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রেডিওতে বক্তব্য রাখার পর গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকরী হয়নি।

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর নানা লেখা প্রকাশিত হয়। যেখানে তিনি বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি ও সামরিক সাহায্য দেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। যুগান্তরসহ বিভিন্ন কাগজে মুক্তিযুদ্ধের বিবরন লিখেছিলেন যা তখন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে যান। তিনি ভারত-সোভিয়েত সুহৃদ সংঘের সভাপতি ছিলেন। বিশ্ব শান্তি সংসদের সাথে যুক্ত ছিলেন যুদ্ধবিরোধী সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। আণবিক পরীক্ষার বিরোধীতায় তিনি সম্পাদকীয় লেখেন তেজস্ক্রিয় পুঁইশাক। ১৯৯৩ সালের ২০শে মার্চ তিনি পরলোকগমণ করেন।

বিভিন্ন সময় নানা দেশ বিদেশের পুরষ্কার পান। ১৯৭০ সালে ভারত সরকার তাঁকে তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মভূষনে সম্মানিত করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

16 March 2019

আজ ১৬ই মার্চ, সাহিত্যিক, অনুবাদক, রসায়নবিদ ও অভিধান প্রণেতা রাজশেখর বসুর ১৩৯তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


বাঙালির বড়ই বদনাম আছে কারোর ডাকনাম বিকৃতি করার। কিন্তু ফটিক ডাকনামটা ফটকা বা ফইটক্যা হয়ে ছিল কিনা জানা নেই তবে এই ফটিক একদিন বড়মাপের সাহিত্যিক, রসায়নবিদ্, ভাষাতাত্ত্বিক, অভিধান রচয়িতা, ধর্মগ্রন্থ রচয়িতা ও কৌতুককাহিনীর রচয়িতা হয়ে উঠেছিল। এই ফটিকই বেঙ্গল কেমিক্যালকে ফুলে ফাঁপিয়ে তুলেছিল।বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ফটিকের নামে কৃতিম অভিযোগ করে বলেন "আপনি ফটিকের বইয়ের এত প্রশংসা করছেন যে বেঙ্গল কেমিক্যাল অসুবিধায়। প্রশংসার দরুন বেঙ্গল কেমিক্যাল ক্ষতির সন্মুখিন হবে। কারণ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার সব কাজকর্ম শিকেয় তুলে, কেমিস্ট্রি ছেড়ে গল্প লেখায় মত্ত হবে"। রবীন্দ্রনাথ এর যথাযথ উত্তরও দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ একবার ফটিককে বলেছিলেন " তুমি এত রস কোথা থেকে পাও?" ফটিকের উত্তর ছিল "আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমি রসায়নের লোক।" এই ফটিকের নামের আড়ালে মানুষটা হচ্ছেন রাজশেখর বসু।

রাজশেখর নাম-
রাজশেখর বসুর বড় ভাই শশীশেখরের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় "পিতা চন্দ্রশেখর দ্বারভাঙ্গা থেকে ঘুরে এসে বলেন ফটিকের নাম ঠিক হয়ে গেছে। তখন মহারাজ লক্ষীশ্বর সিংহ জিজ্ঞাসা করেন, তোমার দ্বিতীয় ছেলের নামও একটা শেখর হবে নাকি? আমি বললাম, ইওর হাইনেস, যখন তাকে আশীর্বাদ করেছেন, তখন আপনিই তার শিরোমাল্য, আমি আপনার সামনেই তার নামকরণ করলাম রাজশেখর।"

ছদ্মনাম-
রাজশেখর বসুর একটা ছদ্মনাম নাম ছিল "পরশুরাম"। তিনি  পরশুরাম ছদ্মনামে তাঁর ব্যঙ্গকৌতুক ও বিদ্রুপাত্মক কথাসাহিত্যের জন্য প্রসিদ্ধ। তিনি ছদ্মনাম কেন নিয়েছিলেন? পৈতৃিক বাড়ি ১৪ নং পার্শি বাগান লেনে বসত "উৎকেন্দ্র"র মজলিসে বৈঠক। উৎকট এবং কেন্দ্র এই দুটি শব্দ নিয়ে উৎকেন্দ্র। সেখানে রাজশেখর ছাড়াও  থাকতেন তাঁর চার ভাই, জলধর সেন, শৈলেন সাহার মত জ্ঞানী গুণীরা। এখানে সবরকমেরই আলোচনা হত। রাজশেখরের কথায় পরশুরাম একজন স্যাকরা। এই নামের সাথে পৌরাণিক পরশুরামের কোনো সম্বন্ধ নেই। রাজশেখরের স্বনামে গল্প লিখতে সংকোচ ছিল। বন্ধু বান্ধবরা একটা ছদ্মনাম চিন্তা করছিলেন। সেই সময় তারাচাঁদ কর্মকার নামে একজন  উৎকেন্দ্রের মজলিসে আসেন। হাতের কাছে তাকে পেয়ে তার নামটাই নিয়ে নেয়। এই নামের পেছনে অন্য কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল না। এই উৎকেন্দ্রই রাজশেখর বসুর গড্ডালিকার গল্পগুলো পাঠ করা হতো। জলধর সেন সেগুলি তার সম্পাদিত "ভারতবর্ষ" পত্রিকায় ছাপান। পরে এটা বই আকারে প্রকাশ হলে রাজশেখর প্রথম পরশুরাম ছদ্মনামটা ব্যবহার করেন। তখন তাঁর বয়স ৪২ বছর। এখানে প্রখ্যাত সাহিত্যক সৈয়দ মুজতবা আলীর সাথে মিল আছে। মুজতবার প্রথম বই "দেশে-বিদেশে" তাঁর ৪২ বছর বয়সেই প্রকাশিত হয়।

জন্ম-
রাজশেখর বসু ১৮৮০ সালের ১৬ই মার্চ বর্ধমান জেলার বামুনপাড়া গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা চন্দ্রশেখর বসু দ্বারভাঙ্গা-রাজ-এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন।

ছোটবেলা ও পড়াশুনা-
তাঁর ছোটবেলা কাটে দ্বারভাঙ্গায়। তিনি ১৮৯৫ সালে দ্বারভাঙ্গা রাজস্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন এবং এরপর পাটনা কলেজে ভর্তি হন ফার্স্ট আর্টস পড়ার জন্য। ১৯০০ সালে রসায়নে এম.এ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম স্থান লাভ করেন। এর দুই বছর পরে ১৯০২ সালে রিপন কলেজ থেকে বি.এল পাশ করে মাত্র তিনদিন আইন ব্যবসা করেই বুঝেছিলেন আইনের থেকে বিজ্ঞান চর্চাই তাঁর কাছে আকর্ষনীয় বেশি।

সাহিত্যচর্চা-
১৯২২ সালে পরশুরাম ছদ্মনামে তাঁর প্রথম  রচনা লেখেন। তাঁর ব্যঙ্গ রচনা "শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড" প্রকাশিত হয় জলধর সেনের "ভারতবর্ষ" পত্রিকায়। বেঙ্গল কেমিক্যালসে কাজ করার সময় থেকেই তাঁর সাহিত্য চর্চা আরম্ভ। রাজশেখরের কবি স্বভাব থাকলেও তিনি ছিলেন খুবই বাস্তববাদী। প্রতিটি কাজ নিখুঁত ছক করেই তিনি কাজে নামতেন। বেঙ্গল কেমিক্যালকে পূর্ণভাবে গড়ে তোলার কাজই হোক বা "চলন্তিকা" অভিধান, রামায়ণ- মহাভারতের অনুবাদ হোক, সব কিছুই তিনি প্লানমাফিক করতেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ মোট ২১টি।

শেষ জীবন-
রাজশেখর বসু মৃণালীনি দেবীকে বিবাহ করেন। বসু দম্পতির এক কন্যা ছিল। রাজশেখরের বয়স যখন ৫৪ বছর তখন তাঁর মেয়ের জামাই খুব অল্প বয়সে অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যায়। এর আট বছর পর তাঁর স্ত্রী মৃণালীনি দেবীও লোকান্তরিত হন। পরবর্তী ১৮ বছর স্ত্রীবিহীন একাকী জীবনে রচিত হয় তাঁর অমূল্য সাহিত্যকর্মসমূহ। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-দূর্দশার কথা তাঁর লেখাতে পাওয়া যায়নি। নাতি নাতনিকে বুকে আগলে বড় করেছেন। ভাল ঘরে বিয়ে দিয়েছিলেন নাতনির। নিজেই নিজের চিকিৎসা করতেন। ১৯৫৯ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তিনি লেখা চালিয়ে যেতে থাকেন। শেষে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ২৭শে এপ্রিল দ্বিতীয় দফা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর জীবনাবসান হয়।

বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায়ের পরিচালনায় রাজশেখর বসুর দু'টি ছোটগল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরী হয়। সেগুলো হলো পরশ পাথর এবং  বিরিঞ্চি বাবা অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা 'মহাপুরুষ।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

15 March 2019

স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক,কবি, ছড়াকার, ভ্রমণকাহিনী রচয়িতা এবং চিন্তাবিদ অন্নদাশঙ্কর রায়ের ১১৫তম জন্ম বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ছোটবেলাকার অনেক ছড়ার গান এখনও মনে গুন গুন করে বা শুনলে মনে পড়ে যায়। সেই সব জনপ্রিয় অনেক ছড়ার গানের রচয়িতা অন্নদাশঙ্কর রায় ১৯০৪ সালের ১৫ই মার্চ উড়িষ্যার ঢেঙ্কানালে এক শাক্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁদের আদি বাড়ী পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়।পিতা নিমাইচরণ রায় বিয়ে করেন পালিত পরিবারের মেয়ে হেমনলিনীকে যিনি বৈষ্ণব ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু একই পরিবারে শাক্ত ও বৈষ্ণব বিশ্বাসের কখনও সংঘাত ঘটেনি। অন্নদাশঙ্করের পূর্বপুরুষ রামচন্দ্র ঘোষ সুবে উড়িষ্যায় জরিপ করতে গেলে  বাদশাহ জাহাঙ্গীর তাঁকে একটা লাখেরাজ তালুক ও খান উপাদি দেন। সেই সময় থেকেই কর্মসূত্রে তাঁরা বসবাস শুরু করেন ওড়িষ্যার ঢেঙ্কানালে। মোঘল আমলেই খান পদবির সাথে জুড়ে যায় রায় চৌধুরী পদবি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে যায় রায় পদবি।তাঁদের পরিবারে সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিবেশ ছিল এবং তা নিয়মিত চর্চাও হতো।

শিক্ষাজীবন-
অন্নদাশঙ্করের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ঢেঙ্কানালের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে  পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইএ পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। মাত্র দশ বারো বয়সেই আয়ত্ব করে ফেলেন কৃতিবাসের রামায়ণ, কাশীরাম দাশের মহাভারত, কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল, বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাশের পাদাবলী। ছাত্রজীবনেই তিনি চার্লশ ডিকেন্স, বার্নার্ড শ, ইসবেন, টলস্টয় প্রমুখ লেখকের বই পড়ে তিনি ইউরোপীর সাহিত্য, সমাজ ও দেশ সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী হন।তিনি সরকারি খরচে আই.সি.এস হতে ইংল্যান্ড যান।

প্রেম ও বিবাহ-
১৯৩০ সালে মার্কিন বিদুষী তরুণী অ্যালিস ভার্জিনিয়া ওর্নডর্ফ ভারতে আসেন ভারতীয় সঙ্গীত বিষয়ে গবেষণার জন্য। কলকাতায় অ্যালিসের সঙ্গে পরিচয় হয় অন্নদাশঙ্করের। পরিচয় থেকে প্রণয় এবং পরিণয়ে আবদ্ধ হন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ বিয়ের পর অ্যালিসের নতুন নাম দেন ‘লীলা রায়’। সেই সময় ‘লীলাময় রায়’ ছদ্মনামে লিখতেন অন্নদাশঙ্কর। অন্নদাশঙ্করের জীবনে লীলা রায়ের প্রভাব ব্যাপক। বহু ভাষায় পারদর্শী লীলা রায় নিজেও খ্যাতিলাভ করেন সাহিত্যিক এবং অনুবাদক হিসেবে। গুণী মার্কিন কন্যা লীলা রায় বাঙালি রমণীর মতোই জীবন যাপন করেন। তিনি অন্নদাশঙ্কর সহ বহু বই বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তিনি সত্যজিত রায়ের অশনি সংকেত, ঘরে-বাইরে এবং অনান্য সিনেমার ইংরাজী সাব-টাইটেল তৈরী করেন।

সাহিত্য-
অন্নদাশঙ্করের প্রথম কবিতা উড়িয়া ভাষায় প্রকাশিত হয়।  বাংলা, ইংরাজী, উড়িয়া, হিন্দি ভাষার পারদর্শী হলেও সাহিত্য চর্চায় তিনি বাংলা ভাষাকেই বেছে নেন। অন্নদাশঙ্করের মাত্র ১৬ বছর বয়সে টলস্টয়ের গল্প ‘তিনটি প্রশ্ন’ বাংলায় অনুবাদ করেন তিনি এবং তা প্রবাসী পত্রিকায় ছাপা হয়। বাংলা ভাষায় তাঁর প্রথম প্রকাশিত মৌলিক রচনার বিষয় ছিল নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা, যা ভারতী পত্রিকায় ছাপা হয়। এ ধরনের বিষয় নিয়ে তিনি ওড়িয়া ভাষায়ও লেখেন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের ওপর প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথকেও আলোড়িত করে।  তাঁর লেখা অন্যান্য বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'পথে প্রবাসে', 'সত্যাসত্য', 'যার যেথা দেশ' প্রভৃতি।

বাংলা ছড়া-
আধুনিক বাংলা ছড়ার জগতে অন্নদাশঙ্কর এক নতুন ধারা আনেন। এই ছড়া লেখার পিছনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বুদ্ধদেব বসুর অনুপ্রেরণা কাজ করে ছিল। তিনি ছোট- বড়, শ্রমজীবী থেকে সাধারণ মানুষ সবার জন্য ছড়া লিখেছেন। তাঁর কিছু ছড়া খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সুরকাররা গান তাঁর অনেক ছড়ায় সুরকাররা সুর দিয়ে গান তৈরী করেন। যেমন 'খোকা ও খুকু'তে সুর দিয়েছিলেন বিখ্যাত সুরকার সলিল চৌধুরী। এই ছড়ায় অন্নদাশঙ্কর দেশভাগের বেদনা তীর্যকভাবে প্রকাশ করেছেন।

'তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো।
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো!
তার বেলা?'

অনেক ছড়ার গান  শিশুদের প্রিয় গান হয়ে ওঠে।
'ময়নার মা ময়নামতি
ময়না তোমার কই
ময়না গেছে কুটুম বাড়ী
গাছেরডালে ওই।'

তাঁর লেখা উড়কি ধানের মুড়কি, রাঙা ধানের খই প্রভৃতি ছড়ার বই ছোটোদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। জীবনের শেষদিনেও হাসপাতালে মুখে মুখে তাঁর শেষ ছড়া বলে যান। অন্নদাশঙ্করের অনান্য ছড়াগ্রন্থগুলির নাম  ‘ডালিম গাছে মউ’, ‘শালি ধানের চিড়ে’ , ‘আতা গাছে তোতা’, ‘হৈ রে বাবুই হৈ’, ‘রাঙামাথায় চিরুনি’, ‘বিন্নি ধানের খৈ’ ও ‘যাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ’।

বিদেশ ভ্রমণ রচনাবলী-
তিনি ইংল্যান্ড যান আই.সি.এস হতে। সেখানে তিনি দু বছর ছিলেন। এরই ফাঁকে ঘুরে বেড়ান সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ইটালি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ। ফলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটে তাঁর সাহিত্যে। তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘পথে প্রবাসে’ ভ্রমণকাহিনীর মাধ্যমেই তিনি বাংলা সাহিত্যে নিজের স্থান করে নেন। অন্নদাশঙ্করের অন্যান্য ভ্রমণকাহিনীগুলি হ’লো ‘ইউরোপের চিঠি’, ‘জাপানে’, ‘ফেরা’, ‘চেনাশোনা’ ও ‘বাংলাদেশে’।

কর্ম জীবন-
অন্নদাশঙ্কর ১৯৩৬ সালে কর্মজীবন শুরু করেন নদীয়া জেলার ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে। শেষের দিকে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিচার বিভাগের সেক্রেটারি হয়ে ১৯৫১ সালে তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নেন।

শান্তিনিকেতনে-
চাকরি ছাড়ার পর অন্নদাশঙ্কর বসবাস শুরু করেন শান্তিনিকেতনে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালির আত্মদান তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। পরের বছর ১৯৫৩ সালে এক ঐতিহাসিক ‘সাহিত্য মেলা’র আয়োজন করেন তিনি শান্তিনিকেতনে।

সম্মান ও পুরস্কার-
সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৭৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পুরস্কারে ভূষিত করে। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার ইত্যাদি।

২০০২ সালের ২৮শে অক্টোবর অন্নদাশঙ্কর রায় কলকাতার পি. জি হসপিটালে  পরলোকগমন করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

12 March 2019

আজ ১২রা মার্চ, বিশিষ্ট বাঙালি পন্ডিত, প্রবন্ধকার, গবেষক, সংগ্রাহক এবং শিক্ষক ক্ষিতিমোহন সেনের ৫৯তম মৃত্যু বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ক্ষিতিমোহন সেন ১৮৮০ সালের ২রা ডিসেম্বর কাশীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে। তাঁর পিতা ভুবনমোহন সেন পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন তাঁর দৌহিত্র।

ক্ষিতিমোহন কাশীর কুইন্স কলেজ থেকে সংস্কৃতে এমএ পাস করে চম্বারাজ্যের শিক্ষাবিভাগে যোগ দেন। ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে বিশ্বভারতীর ব্রহ্মাচর্যাশ্রমে যোগদান করেন ও বিশ্বভারতী বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষরূপে কর্মজীবন শেষ করেন। ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে বিশ্বভারতী এই দীর্ঘ জটিল পথ পরিক্রমায় ক্ষিতিমোহন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রধান সহযোগী। ক্ষিতিমোহন রবীন্দ্রনাথের সফরসঙ্গী হয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে যান ও ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথের চিন ভ্রমণের সহযাত্রী ছিলেন।

মধ্যযুগের সন্তদের বাণী, বাংলার বাউল সঙ্গীত সম্পর্কে তিনি ব্যাপক অনুসন্ধান, গবেষণা ও গ্রন্থাদি রচনা করেন। তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছরের চেষ্টার ফলে সংগৃহীত বিষয়গুলি কয়েকটি বইতে প্রকাশ করেন। তিনি হিন্দি ও গুজরাতি ভাষায়ও গ্রন্থ রচনা করেছেন। বেদ, উপনিষদ, তন্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্রে ক্ষিতিমোহনের পান্ডিত্য ছিল বিস্ময়কর। অভিনয়,সঙ্গীতশাস্ত্র এবং আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও তাঁর ভাল দখল ছিল।

ক্ষিতিমোহন সেনের কয়েকটি প্রকাশিত গ্রন্থের নাম কবীর, ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা, ভারতের সংস্কৃতি, বাংলার সাধনা ইত্যাদি। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ক্ষিতিমোহন ১৯৫২ সালে বিশ্বভারতীর প্রথম দেশিকোত্তম উপাধি এবং হিন্দি চর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ সর্বভারতীয় সম্মান লাভ করেন।

ক্ষিতিমোহন সেন ১৯৬০ সালের ১২ই মার্চ পরলোকগমন করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

11 March 2019

আজ ১১ই মার্চ, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৭৯তম জন্ম বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিশিষ্ট বাঙালি কবি, সংগীতকার, দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ। তিনি বাংলা সংকেত লিপি (শর্ট হ্যান্ড) ও স্বরলিপি রচনার অন্যতম অগ্রপথিক। 

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪০ সালের ১১ই মার্চ জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।

ছোটবেলা-
পাঁচ বছর বয়সে হাতে খড়ি। বাড়ীতেই একই শিক্ষকের কাছে সহোদর সতেন্দ্রনাথ ও খুরতূতো ভাই গণেন্দ্রনাথের সাথে লেখাপড়া শুরু। কিছুদিন বাংলা পড়েই একেবারে সংস্কৃত মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ শুরু পন্ডিতমশায়ের কাছে। ক্রমশ মুগ্ধবোধ পার হয়ে রঘুবংশ, কুমারসম্ভব শেষ। এরপর তিনি ভর্তি হন সেন্ট পল’স স্কুলে। এই স্কুলে তিনি দু বছর পড়ার পর স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ) ভর্ত্তি হন। ক্লাসের বাঁধাধরা নিয়মে পড়াশোনা তাঁর ভালো লাগেনি। ভরসা ছিল লাইব্রেরী। সেখান থেকে বই নিয়ে বাড়ীতে পড়েই তাঁর জ্ঞান তৃষ্ণা মিটত। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় পাশ করার জন্য পড়াশানা তাঁর পোষাল না। ছেড়ে দিলেন কলেজ।ছোটবেলা থেকেই কবিতা রচনা করার ঝোঁক থাকলেও, কবি হবার কথা ছিল না তাঁর। তিনি হতে চেয়েছিলেন চিত্রকর।

ভাইদের সাথে সম্পর্ক এবং একান্নবর্তী পরিবার-
অনুজের প্রতি দ্বিজেন্দ্রনাথের স্নেহ লক্ষ করা যায়। দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর পরের ভাই সতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের  অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যদিও দুই ভাইয়ের মধ্যে মতের কিছু পার্থক্য ছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন সমাজের প্রচলিত সংস্কারগুলির একনিষ্ঠ অনুগামী। অন্যদিকে সত্যেন্দ্রনাথ এই সংস্কারগুলিকে ভেঙে নতুন আধুনিক সমাজ গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন।পরিবারের কথা বলতে গিয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ বলেন 'আমাদের ফ্যামিলি মোটো হচ্ছে ওয়ার্ক উইল উয়িন। রবি সেটা লিটার‍্যালী পালন করছে। আমাদের ভাইদের মধ্যে রবিই সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়াছেন। সতু নিরীহ ছেলেমানুষ, রবি এক্টিভ আর আমি কিছুনা'। রবীন্দ্রনাথ দ্বিজেন্দ্রনাথকে বড়োদাদা বলে ডাকতেন। ঠাকুরবাড়ীর ঐশ্বর্য তখন সর্বোচ্চ শিখরে। দ্বারকানাথ ঠাকুর তখনো বেঁচে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ তখনো ব্রাহ্ম হননি। তখনো এবাড়ী ওবাড়ী হয়নি। যৌথ পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায়, খুড়তুতুতো ভাই বোনেদের মধুর সাহচর্যে, বাড়ীতে দোল, দুর্গোৎসবের ভরপুর আনন্দ নিয়ে, কাকীমা যোগমায়াদেবীর স্নেহ-আদরে তাঁর ছোটবেলাটি কেটেছিল। বাড়ী ছিল তাঁদের স্বর্গ। তাঁর থেকে দু দশকের ছোট রবি এসবের স্বাদ পায়নি। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলে  দ্বিজেন্দ্রনাথের ছোটবেলাতেই জোড়াসাঁকোর একান্নবর্তী ঠাকুরবাড়ী দু ভাগ হয়ে যায়। দ্বিজেন্দ্রনাথ একান্নবর্তী পরিবারের বিশেষ ভক্ত ছিলেন এবং তিনি ভাবতেন তাঁর একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে যে প্রীতি ও সদ্ভাব ছিল আজকাল আর দেখা যায় না। সামাজিক রীতিনীতি ঠিক মত মেনে চললে এই রকম পারিবারিক ব্যবস্থাই যে ভালো সে বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ ছিলেন। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের একটি বিশেষ দোষ তাঁর চোখে পড়েছিল। তিনি বলতেন  'এখানে যদি কেউ ধর্ম সম্বন্ধে নতুন মত অবলম্বন করার প্রয়াস করে তাহলে এই একান্নবর্তী পরিবার বাধা দেয়। সে কিছুতেই ব্যক্তি বিশেষের মত মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে  চায় না, অথবা তার মত মেনে নিয়ে তাকে বৃহৎ পরিবারের মধ্যে থাকতে দিয়ে, স্বাধীন ভাবে তাকে তার নিজের স্বতন্ত্র জীবন যাত্রা নির্বাহ করতে দেয় না। এইখানেই এই জয়েন্ট ফ্যামিলি সিস্টেম এর সংকীর্ণতা'।

বিবাহ-
যৌবনারম্ভেই তিনি যশোহরে নরেন্দ্রপুরের তারাচাঁদ চক্রবর্তীর কন্যা সর্বসুন্দরীকে বিয়ে করেন। তাঁর পাঁচ পুত্রও দুই কন্যা। যৌবনেই তাঁর স্ত্রীবিয়োগ ঘটেছিল। অবশিষ্ট জীবন দ্বিজেন্দ্রনাথ বিপত্নীক অবস্থাতেই কাটিয়ে ছিলেন। স্ত্রী মারা যাবার পর তিনি শান্তিনিকেতনে চলে আসেন।

কাব্য চর্চা-
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন কাব্যচর্চা শুরু করেন, তখন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন স্বীয় সাফল্যের শীর্ষদেশে। সেই যুগে বাংলার প্রত্যেক কবিই অল্পবিস্তর মধুসূদন দ্বারা প্রভাবিত হলেও, দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন এই প্রভাবের ঊর্ধ্বে। বরং মধুসূদনই দ্বিজেন্দ্রনাথকে ভবিষ্যতের কবি হিসাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের ঠিক এক বছর আগে দ্বিজেন্দ্রনাথের বয়স যখন ২০ বছর তখন তাঁর প্রিয়কাব্য কালিদাসের সংস্কৃত ভাষায় রচিত মেঘদূতের বঙ্গানুবাদ গ্রন্থটি প্রকাশ হয়। এরপর তাঁর তত্ত্ববিদ্যা (তিন খণ্ডে) প্রকাশিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় রূপক-কাব্য স্বপ্ন-প্রয়াণে এক যুবকের ভ্রমণবৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। ১৮৮৪ সাল থেকে সুদীর্ঘ ২৫ বছর তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

আত্মভোলা খাঁটি মানুষ-
তাঁকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন পুত্রবধূ হেমলতা দেবী। তিনি তাঁর সম্পর্কে বলেছেন “সকল দিকে তিনি যে একজন খাঁটি মানুষ ছিলেন এতে কোন ভুল নাই। তাঁর ঈশ্বরভক্তি ছিল খাঁটি, পিতৃভক্তি ছিল খাঁটি, ভাইদের ও সন্তানদের প্রতি স্নেহ ছিল খাঁটি, স্বদেশপ্রীতি, বন্ধুপ্রীতি, জীবপ্রীতি ছিল তাঁর খাঁটি। দার্শনিক তত্বের বিচার ও বিশ্লেষণে অনুরাগ ছিল খাঁটি। কাব্যে প্রীতি ও বাংলা ভাষার প্রতি দরদ ছিল খাঁটি।
তিনি প্রায়ই তাঁর চশমা খুঁজে পেতেন না। তখনই প্রিয় ভৃর্ত্য মুনীশ্বরকে খুব বকাবকি করতেন। কিন্তু সেই চশমা পাওয়া যেত তাঁর পকেট থেকে বা কপালের ওপর থেকে। অনেক সময় চোখে চশমা পড়া থাকলেও আমার চশমা কোথায় বলে হাঁক পারতেন। চশমা খুঁজে পাওয়া গেলে অট্টহাসিতে বাড়ী মাতিয়ে তুলতেন। এই রকমই আত্মভোলা মানুষ ছিলেন।

হিন্দুমেলা বা স্বদেশী মেলা-
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর দেবেন্দ্রনাথ মল্লিকের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় স্বদেশী মেলার চালু হয়। ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলে ভক্তির সাথে উপলব্ধির চেষ্টা সেই প্রথম।  এই মেলায় দেশের স্তবগান গাওয়া হত, সেই সাথে চলতো কবিতা পাঠ, দেশী শিল্প, ব্যায়াম প্রভৃতি প্রদর্শণ করা হত। সেখানে দেশী গুণী লোকদের পু র স্কৃত করা হতো। এই মেলার জন্য দ্বিজেন্দ্রনাথ দেশাত্মবোধক গানও রচনা করেছিলেন। এই মেলাকে কেন্দ্র করে অনেকেই বিভিন্ন জাতীয় সংগীত সৃষ্টি করেন। প্রকৃতপক্ষে সেই প্রথম সঠিক দেশানুরাগের গান রচিত হতে থাকলো। এই মেলাই বাংলাদেশে হয়তো বা সারা ভারতবর্ষে সর্ব প্রথম 'জাতীয় শিল্প প্রদর্শণী'র সূচনা করে। এই মেলা প্রথমদিকে চৈত্র সংক্রান্তির দিন অনুষ্ঠিত হত বলে এই মেলার নাম  'চৈত্রমেলা' ছিল।

সংসারিক বুদ্ধি-
ছিল না শুধু সংসারিক বুদ্ধি। এইজন্য তাঁর আপন জনেরা তাঁকে বিষয় -আশয় থেকে দুরে রাখতেন। তিনি অনাসক্ত গৃহী ছিলেন। তাঁর অন্তরে যেমন একটি সহজ সরল দর্পহীন তেজস্বিতা ছিল, বাহিরের পোষাক পরিচ্ছদেও তেমনি অনাড়ম্বর। একবার গরম লুচি খাবার সময় হাতে ঘি লেগে যায়। তক্ষুনি আদেশ করেন ঘিয়ের বদলে লুচি জলে ভাজতে। এরকমই ছিল তাঁর সাংসারিক জ্ঞান।

শান্তিনিকেতন ও পশুপাখী প্রীতি-
পশুপাখীদের প্রতি তাঁর আন্তরিক ভালোবাসা ছিল। শান্তিনিকেতনের নিচু বাংলার বারান্দায় তিনি যখন বসতেন তখন চড়াই পাখি, কাঠবিড়ালি, শালিখ পাখি তাঁকে ঘিরে থাকত আর তাঁর গায়ে মাথায় চড়ে বসত। অনেক সময় কাঠবিড়ালি তাঁর জামার মধ্যে ঢুকে খেলা করত। এক শালিখ ভালোবাসার আবেশে তাঁর চোখে ঠুকরে দিয়েছিল। কি বুঝে তার পরদিন থেকে সে আর আসেনি। তাকে দেখতে না পেয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথের মন খারাপ থাকত।

মহাত্মা গান্ধী-
তিনি গান্ধিজীর খুব ভক্ত ছিলেন। গান্ধীজিও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ যতদিন বেঁচে ছিলেন শেষ সময় পর্যন্ত তিনি গান্ধীজির সাথে যোগাযোগ রেখে ছিলেন। এই যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও দীনবন্ধু এন্ড্রুজ। ১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধি তৃতীয়বার শান্তিনিকেতনে আসেন এবং থাকেন তিন দিন। এই তিন দিনের প্রতিদিনই গান্ধীজি দ্বিজেন্দ্রনাথের সাথে সকাল সন্ধ্যায় দুবেলাই দেখা করতেন। এটাই ছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের শেষ সাক্ষাৎ।

হারমনিয়াম ও বাঁশি-
দ্বিজেন্দ্রনাথের পিতা বাড়ীতে হারমোনিয়াম আনেন। ভারতবর্ষে সেই প্রথম এই যন্ত্রটি এল। দ্বিজেন্দ্রনাথ এই হারমোনিয়াম বাজাতে শিখেছিলেন। তিনি এক সময় বাঁশি বাজাতেন। বাড়ীতে অনেক রকমের বাঁশি থাকত।

ঈশ্বরপরায়ণ, বিষয়ভোলা, জ্ঞানবৃদ্ধ, স্বভাবশিশু প্রকৃতির কোলঘেঁষা এই আশ্চর্য মানুষটি বিদায় নিলেন ১৯২৬ সালের ১৯শে জানুয়ারী।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

10 March 2019

বাংলার নবজাগরণের যুগে বিতর্কিত চরিত্র রাজা রাধাকান্ত দেবের ২৩৫তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আজ ১০ই মার্চ, বাংলার নবজাগরণের যুগে বিতর্কিত চরিত্র রাজা রাধাকান্ত দেবের ২৩৫তম  জন্মবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

রাধাকান্ত দেব স্বদেশ-সেবায় আত্মনিয়োগ করে যে সব জনহিতকর কাজ করে গিয়েছেন, সেগুলি উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসে তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। তিনি একজন পন্ডিত ও কলকাতা হিন্দু সমাজের বিশিষ্ট নেতা। তিনি একদিকে ছিলেন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা, অথচ শিক্ষাবিস্তারে তিনি পরম প্রগতিশীল।রাজা রাধাকান্ত দেব নিজেকে কলকাতার হিন্দু সমাজের প্রধান নেতারূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

জন্ম, শিক্ষা ও বিবাহ-
১৭৮৪ সালে ১০ই মার্চ রাধাকান্ত দেব উত্তর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেবের দত্তকপুত্র  গোপীমোহন দেবের পুত্র রাধাকান্ত দেব।রাজবাড়িতে জন্ম গ্রহণ করে প্রচুর ঐশ্বর্য্য ও বিলাসিতায় লালিত পালিত হয়েও রাধাকান্তের পড়াশুনায় গভীর মনযোগ ছিল। পাঁচ বছর বয়সে রাধাকান্ত দেবের শিক্ষা শুরু হয় গৃহশিক্ষক পন্ডিত কৃষ্ণমোহন বসুর কাছে। গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে তিনি সংস্কৃত ভাষা ভালোভাবে শিখে নেন। তাছাড়াও আরবী ও পারস্য ভাষাতেও তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তিনি কলকাতায় ইংলিশ একাডেমিতে ইংরাজী ভাষা শেখেন। অতি অল্প বয়সেই তিনি এতগুলি ভাষা আয়ত্ত করেন। মাত্র দশ বছর বয়সে গঙ্গামণি নামে এক বালিকার সাথে তাঁর বিয়ে হয়।

হিন্দু ধর্ম ও গোড়ামী-
ছোটবেলা থেকেই তাঁর মন স্বধর্মে অনুরক্ত ছিল। বিদেশী ভাষা শিখেও হিন্দুধর্মের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস ও ভক্তি ছিল। তিনি ছিলেন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের সমর্থক। দেশের লোকেদের পড়াশুনা এবং জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে ১৮২৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী কলকাতার হিন্দু কলেজের শিক্ষিত, পন্ডিত ও গণ্যমাণ্য লোকেদের নিয়ে গৌড়ীয় সমাজ স্থাপন করেন। 

রাধাকান্ত দেব ও শিক্ষার উন্নয়ন-
তিনি একদিকে ছিলেন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা, অথচ শিক্ষাবিস্তারে তিনি পরম প্রগতিশীল। সংস্কৃত ভাষা যাতে দেশবাসীর মধ্যে পুনরায় প্রচলিত হয় তিনি সেই চেষ্টা করেছিলেন। রাধাকান্ত দেব সবসময়ই শিক্ষার উন্নয়ন, বিশেষত হিন্দুদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে যাতে জ্ঞান অর্জন করতে পারে সে বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। ১৮১৭ সালে কলকাতা হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং ত্রিশ বছরেরও বেশি কাল ধরে তিনি এই কলেজের একজন সক্রিয় পরিচালক ছিলেন। বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও তিনি গভীর আগ্রহী ছিলেন।

স্ত্রীশিক্ষা ও রাধাকান্ত দেব-
স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারে রাধাকান্ত দেব ছিলেন বিশেষ উৎসাহী। ১৮২০ সালে মেয়েদের শিক্ষার জন্য ব্যক্তিগত উদ্দেগে তিনি "মহিলা শিক্ষা সমিতি" স্থাপন করেন। ১৮২২ সালে এ বিষয়ে উন্নতির জন্য স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক নামে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই সময়ে রাধাকান্ত নিজে ৪০ জন মেয়ের শিক্ষার ভার নিয়েছিলেন। তিনি ছোটো ছোটো চারটি শোভাবাজার, জানবাজার, শ্যামবাজার ও এন্টালিতে মেয়েদের স্কুল খোলেন। তিনি নিজের পরিবারের মহিলাদের শিক্ষাদানের জন্য ইংরেজ শিক্ষিকা  নিযুক্ত করেন।

শব্দকল্পদ্রুম রচনা-
তাঁর রচিত সংস্কৃত অভিধান শব্দকল্পদ্রুম  তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে। ১৮১৫ সালে তিনি শব্দকল্পদ্রূম রচনা শুরু করেন। আটটি খণ্ডে বিভক্ত এর প্রথম খণ্ডটি প্রকাশ পায় ১৮২২ সালে এবং শেষ খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ সালে। এই বইটি তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি সহ অন্যান্য ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি সম্মানিত হন। ঠাকুর পরিবারের পাথুরিয়াঘাটা শাখার হরকুমার ঠাকুর তাঁকে এই গ্রন্থ সংকলনে সহায়তা করেন।

সতীদাহ, বিধবাবিবাহ  ও রাধাকান্ত দেব-
রামমোহন রায়ের ধর্মান্দোলন শুরু হলে কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাঁকে সনাতন ধর্মের রক্ষকরূপে বরণ করেন। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ফেব্রুয়ারি গৌড়ীয় সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর কর্মসমিতির সদস্য নিযুক্ত হন এবং সতীদাহ প্রথা সম্পর্কে তিনি রামমোহন রায়ের বিরোধিতা করেন। এ সম্পর্কে তিনি লর্ড বেন্টিকের সঙ্গেও আলোচনা করেছিলেন। ধৰ্ম্ম বিষয়ে রাধাকান্ত দেব রক্ষণশীল ও গোঁড়া হিন্দু ছিলেন । ১৮২৯, ডিসেম্বর মাসে লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ক যখন ‘সতীদাহ’ বে-আইনি বলে ঘোষণা করেন, তখন রাধাকান্ত দেবই পিতৃপ্রতিষ্ঠিত ধর্মসভার পক্ষ থেকে এই মঙ্গলময় বিধানের বিরুদ্ধে বিলেতে আপীল করেছিলেন। ডিরোজিওর নব্যচিন্তাধারা এবং পরবর্তীকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের  বিধবাবিবাহ ও বহুবিবাহ রদ সম্পর্কিত আন্দোলনের বিরোধিতা করেন।

উপাধি ও রাধাকান্ত-
রাধাকান্ত দেবের চরিত্র-মাধুর্য,পান্ডিত্য ও স্বধর্মে নিষ্ঠা ও প্রগাড় অনুরাগ দেখে দেশীয় এবং ইংরেজরা তাঁকে শ্রদ্ধা করতো। জীবনে রাধাকান্ত বহু রাজ-সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন। ১৮৩৫ সালে তিনি কলকাতা শহরের 'জাস্টিস অব পিস' এবং 'অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট' হিসাবে নিযুক্ত হন। তখনকার দিনে খুব কম দেশীয় লোকের ভাগ্যেই এই উচ্চ সন্মান লাভ করতো । ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে গভর্ণর জেনারেল তাঁকে  ‘রাজা বাহাদুর" উপাধিতে ভূষিত করে তাঁর গুণের সন্মান জানায়। ১৮৫১ খৃষ্টাব্দে "ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া এসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হলে রাধাকান্ত দেবই এর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৮৬৬ সালে তিনি বাঙালীদের মধ্যে সৰ্ব্বপ্রথম কে-পি-এস-আই উপাধি লাভ করেন।

রাধাকান্ত দেবের বৃন্দাবন যাত্রা, পশুপাখী প্রীতি ও মৃত্যু-
রাধাকান্ত দেব সুদীর্ঘ কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করে ১৮৬৪ সালে বৃন্দাবনে চলে যান। সেখানে তিনি 'পদাবলী' দু ভাগে ভাগ করেন। বৃন্দাবনে সে সময় প্রচুর ময়ূর দেখা যেত। ইংরেজরা ছুটি কাটাতে এসে ময়ূর শিকার করতো। এই পাখী হত্যায় রাধাকান্তের মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। তিনিই বৃন্দাবনে ময়ূর শিকার বন্ধ করেন।

রাধাকান্ত আগের থেকেই জানতে পেরে ছিলেন তাঁর মৃত্যুর কথা। দেহত্যাগের তিন দিন আগে থেকেই তিনি সর্দ্দিতে কষ্ট পাচ্ছিলেন। মৃত্যুর দিন অল্প গরম দুধ খেয়ে প্রিয় ভৃত্যকে আগাম জানিয়ে দেন তাঁর মৃত্যুর কথা। পুরোহিত মশায়কে ডেকে  তিনি জানিয়ে দেন কি করে তাঁর সৎকার করা হবে। তিনি ছিলেন বৈষ্ণব। মৃত্যুর পর তুলসী ও চন্দন কাঠে তাঁর দেহ দাহ করার ব্যবস্থা তিনি নিজেই করে ছিলেন। ভৃত্যকে সেই সব কথা আবার মনে করিয়ে দিয়ে তিনি আত্মীয়স্বজনদের থেকে বিদায় নিয়ে নিচের তলায় যান। তারপর তুলসী তলায় শুয়ে মাথার দিকে শালগ্রাম শিলা রেখে অন্তিমশয্যা গহণ করেন। দু ঘন্টা ধরে মালা জব করার পর রাধাকান্ত দেব অনন্ত পথে যাত্রা করেন।

১৮৬৭ সালের ১৯শে এপ্রিল রাধাকান্ত দেবের বৃন্দাবনে  মৃত্যু হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ৮৪ বছর।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

09 March 2019

মদনমোহন তর্কালংকারের ১৬১তম মৃত্যু বার্ষিকীতে আজ ৯ই মার্চ, আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


মনে পড়ে ছোটবেলায় পড়া ছড়াটি ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসমকলি সকলি ফুটিল’? মনে পড়ে 'আমার পণ'এর ছড়াটি 'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি'? এ ছড়াগুলি পড়েননি এমন বাঙালি হাতে গোনা। এখনও কেউ কেউ চেষ্টা করলে ছড়ার দু’এক লাইন মনেও করতে পারেন। কিন্তু বেশির ভাগ বাঙালিই জানেন না বাংলা শিশু সাহিত্যের সার্থক ওই কবিতার কবির নাম। তিন খন্ডে প্রকাশিত শিশুদের জন্য লেখেন ‘শিশু শিক্ষা’ নামে একটি বই। যে বই দিয়ে শৈশবে রবীন্দ্রনাথের লেখাপড়া শুরু হয়েছিল।  স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের লেখাপড়া শুরু হয়েছিল যাঁর বই পড়ে সেই কবিকে আমরা সবাই ভুলতে বসেছি। 

আসুন আজ ৯ই মার্চ, সেই শিশু কবি মদনমোহন তর্কালংকারের ১৬তম মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে তাঁকে স্মরণ করি।

ঊনবিংশ শতাব্দীয় অন্যতম পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব যিনি লেখ্য বাংলা ভাষার বিকাশে বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। তিনি বাংলার নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত হিসাবেও পরিগণিত। দু’শো বছর পেরিয়ে গেল, তবুও উপেক্ষিত এই কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কার।

মদনমোহনের তর্কালংকার ১৮১৭ সালের ৩রা জানুয়ারি নদিয়ার নাকাশিপাড়ার বিল্বগ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক উপাধি ‘চট্টোপাধ্যায়’ হলেও প্রাপ্ত উপাধি ‘তর্কালঙ্কার’ হিসেবেই তিনি সুপরিচিত। 
নিজের গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন এবং সেখানে  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর সতীর্থ ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। উভয়েই পন্ডিত  জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ও প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের থেকে সাহিত্য, ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, জ্যোতিষ ও স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। মদনমোহন পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষা গ্রহণ করেন। 

তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। পরবর্তীতে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার বিচারক নিযুক্ত হন। তিনি ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে মুর্শিদাবাদের এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কান্দির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হয়েছিলেন।

মদনমোহন তর্কালঙ্কার বাংলা ভাষায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য যথেষ্ট শ্রম ব্যয় করেন। তাঁর রচিত শিশুশিক্ষা গ্রন্থটি ঈশ্বরচনন্দ্রের  “বর্ণপরিচয়” গ্রন্থটিরও পূর্বে প্রকাশিত।  ‘বাসব দত্তা’ ও রসতরঙ্গিনী নামে তাঁর দুটি গ্রন্থ ছাত্রাবস্থায় রচিত হয়।

বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি ছিলেন ‘হিন্দু বিধবা বিবাহ’ প্রথার অন্যতম উদ্যোক্তা। ১৮৫৭ সালে প্রথম বিধবা বিবাহ হয়। ওই বিয়ের পাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং পাত্রী ছিলেন কালীমতি। তাঁদের দুজনের সন্ধান ও যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে মদনমোহন তর্কালঙ্কার ছিলেন অন্যতম।মদনমোহন বিদ্যাসাগরের সহযোগিতায় ‘সংস্কৃত-যন্ত্র’ (১৮৪৭) নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে ভারতচন্দ্রের  অন্নদামঙ্গল কাব্যটি সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়।

ইয়ং বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাতা ডিরোজিওর উদ্যোগে সে সময়ে দেশ জুড়ে চলছে কুসংস্কার, নানা সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে ও ইংরেজি স্ত্রী শিক্ষার প্রসারের জন্য আন্দোলন। ইয়ংবেঙ্গলের অন্যতম সদস্য রামতনু লাহিড়ীর বাড়িতে থাকার সুবাদে মদনমোহনও সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মুর্শিদাবাদ এবং কান্দিতে মেয়েদের স্কুল, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, অনাথ আশ্রম, দাতব্য চিকিৎসালয় ইত্যাদি জনহিতকর প্রতিষ্ঠান গঠন করেন।  সেকালে শিক্ষা সংস্কারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেবর এদেশের মেয়েদের জন্য ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’ স্থাপনে মদনমোহন ছিলেন তাঁর প্রধান সহযোগী। বিনা বেতনে তিনি ওই স্কুলে পড়াতেন। শুধু তাই নয় তিনি তাঁর ছোট্ট দুই মেয়ে ভুবনমালা এবং কুন্দমালাকে ওই স্কুলে ভর্তি করেন।  ওই সময় ভারতে মেয়েদের প্রকাশ্যে শিক্ষার সুযোগ ছিল না। সমাজ তা ভাল চোখে দেখতও না। স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে তার অবদান অনস্বীকার্য।  সর্বশুভকরী পত্রিকায় স্ত্রী শিক্ষার পক্ষে একটি যুগান্তকারী প্রবন্ধ লেখেন ১৮৫০ সালে। এর ঠিক পরেই তিনি লেখেন ‘স্ত্রীশিক্ষা’ নামে এর একটি বই। যেখানে তিনিই প্রথম বলেছিলেন শিশুকে শিক্ষিত করতে গেলে মায়েরই শিক্ষা আগে দরকার। স্ত্রীশিক্ষার সমর্থনে তিনি সর্বশুভকরী পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় (১৮৫০) দৃষ্টান্তস্থাপনকারী একটি প্রবন্ধ রচনা করেন।

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ৯ মার্চ কান্দিতে কলেরা রোগে ভুগে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।


06 March 2019

আজ ৬ই মার্চ, উনবিংশ শতাব্দীর কবি, সাহিত্যিক ও নির্ভীক সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ২০৭তম জন্মদিনে আমাদের শুভেচ্ছা।


কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বর্তমান যুগ-প্রভাতের 'ভোরের পাখী' বলে পরিচিত।  ইংরাজী কাব্যের প্রভাব থেকে তিনি মুক্ত অথচ পাশ্চাত্য ভাবে আবিষ্ট সমাজের আচার আচরণ এবং সমকালীন রাজনীতি তাঁর কাব্যে রঙ্গরসের খোরাক যুগিয়েছে। তাঁর কবিতায় স্বদেশ, স্বভাষা ও ধর্মের প্রতি গভীর ভালোবাসা ফুটে ওঠে।
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮১২ সালের ৬ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনা জেলার  কাঞ্চনপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা হরিনারায়ণ দাশগুপ্ত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ছিলেন। মায়ের নাম শ্রীমতি দেবী।

১) পিতা হরিনারায়ণ দাশগুপ্তের দ্বিতীয় বিয়ে এবং কবি ঈশ্বরচন্দ্রের মেজাজ-
ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স যখন দশ তখন তাঁর মা মারা যান। স্ত্রী মারা যাবার কিছুদিন পরেই তাঁর পিতা হরিনারায়ণ দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন। তিনি বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ী থেকে বাড়ী না ফিরে কর্মস্থলে চলে যান। নববধূ একা বাড়ীতে এলে, হরিনারায়ণের সৎ মা  তাকে বরণ করে নেন। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র খাঁটি জিনিষ বড় ভালবাসতেন। খাঁটি মা কোথায় চলে গেছে তার বদলে নকল মাকে তিনি মানতে পারলেন না। ঈশ্বরচন্দ্রের রাগ আর সহ্য হল না। তিনি সৎ মাকে লক্ষ্য করে হাতের কাছে এক গাছা লাঠি নিয়ে ছুড়ে মারলেন। সৌভাগ্যক্রমে সেই লাঠি পাশের কলা গাছের ওপর পড়াতে সৎ মা সে যাত্রায় বেঁচে যান। ঈশ্বরচন্দ্র তখন একটা ঘরে ঢুকে পড়ে দরজায় খিল আটকে দিলেন। সমস্ত দিন বন্ধ ঘরে থাকলেন। পরে তাঁর জ্যেঠামশাই দরজা ভেঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রকে জুতো পেটা করেন।  ঈশ্বরচন্দ্রের ঠাকুরদা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, “তোদের মা নাই, মা হইল, তোদেরই ভাল। তোদেরি দেখিবে শুনিবে।” একথা ঈশ্বরচন্দ্রের সহ্য হল না। ঈশ্বরচন্দ্র দাদুকে মুখের উপর বলেন,“হাঁ! তুমি আর একটা বিয়ে করে যেমন বাবাকে দেখ্‌ছ, বাবা আমাদের তেমনই দেখ্‌বেন।” এরকমই ছিল ঈশ্বরচন্দ্র ছোটবেলাকার মেজাজ।

২) রাতে মশা দিনে মাছি এই নিয়ে কলকাতায় আছি-
দুরন্ত ছেলে, কাজেই ঈশ্বরচন্দ্র লেখা পড়ায় বড় মন দিলেন না। বুদ্ধির অভাব ছিল না। শোনা যায়  ঈশ্বরচন্দ্রের যখন তিন বছর বয়স, তখন তিনি একবার কলকাতায় মামার বাড়ীতে এসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। কলকাতায় তখন খুবই  অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছিল। আর ছিল মশা মাছির বড়ই উপদ্রব। প্রবাদ আছে, ঈশ্বরচন্দ্র বিছানায় শুয়েই থেকেই সেই মশা মাছির উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে  কবিতা আওরায় “রেতে মশা দিনে মাছি, এই তাড়্‌য়ে কল্‌কেতায় আছি।”

৩) কবির প্রেম আর বিয়ে-
ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স যখন ১৫ বছর তখন  গুপ্তীপাড়ার গৌরহরি মল্লিকের মেয়ে দুর্গামণি দেবীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। দুর্গামণির কপালে সুখ হল না। দুর্গামণির রূপ,ব্যবহার, আচরণ ঈশ্বরচন্দ্রের পছন্দ হয়নি। কবি ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে স্ত্রী দুর্গামণি ছিলেন কুৎসিতা! হাবা! বোবার মত! একে স্ত্রী বলে মানা যায় না। ঈশ্বরচন্দ্র বিয়ের পর স্ত্রী দুর্গামণির সাথে কখনও কথা বলেন নি। কিন্তু বিয়ের আগে কবি ঈশ্বরচন্দ্রের মধ্যে প্রেমের ভাব ছিল। শোনা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র কাঁচরাপাড়ার এক বড়লোকের পরমা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পিতা হরিনারায়ণ তাঁর ইচ্ছায় জল ঢেলে দেন এবং গুপ্তীপাড়ার গৌরহরি মল্লিকের মেয়ের সাথে বিয়ে দেন। গৌরহরি, বৈদ্যদের মধ্যে একজন প্রধান কুলীন ছিলেন, সেই কুল-গৌরবের কারণ এবং অর্থদান করতে হবে না বলে, সেই পাত্রীর সাথে হরিনারায়ণ ছেলের বিয়ে দেন। ঈশ্বরচন্দ্র পিতার আজ্ঞায় নিতান্ত অনিচ্ছায় বিয়ে করেন, কিন্তু বিয়ের পরই তিনি বলেন যে, আমি সংসারধর্ম করব না। পরে ঈশ্বরচন্দ্রের আত্মীয় ও বন্ধুরা তাঁকে আর একটা বিয়ে করতে বলাতে, তিনি বলেন যে, "দুই সতীনের ঝগড়ার মধ্যে পড়িয়া মারা যাওয়া অপেক্ষা বিবাহ না করাই ভাল"।

৪) ঈশ্বরচন্দ্রের ব্যঙ্গাত্বক কবিতা -
সে সময়  ঈশ্বরগুপ্ত ব্যঙ্গাত্বক কবিতা লিখে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। লোকজন  কবিতাগুলোকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিল। এই ব্যঙ্গ কবিতাগুলোর মধ্য দিয়ে তাঁর সমাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, বাস্তব চিত্রাঙ্কনের ক্ষমতা, অসঙ্গতিগুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, মিশনারী, ইয়ংবেঙ্গল, মেয়েদের উগ্র আধুনিকতা ধারণ, বিধবাবিবাহের প্রচারক কেউ তাঁর কলমের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি। 

৫) ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশব ও পড়াশুনা-
পিতা হরিনারায়ণ দ্বিতীয় বিয়ে করলে এর পর থেকে কবি কলকাতার জোড়াসাঁকোতে মামার বাড়িতে বাস করতে শুরু করেন। ঈশ্বরচন্দ্র শৈশবে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়ার কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি, তবে অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র নিজ চেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত ও  ইংরেজি ভাষা শেখেন এবং বেদান্তদর্শনে পারদর্শিতা লাভ করেন।

৬) ঈশ্বরচন্দ্রের সংবাদ প্রভাকর-
সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের প্রেরণায় এবং বন্ধু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের আনুকূল্যে ১৮৩১ সালের ২৮ জানুয়ারি তিনি সাপ্তাহিক  সংবাদ প্রভাকর প্রকাশ করেন। আধুনিক বাংলার সমাজ গঠনে সংবাদ প্রভাকরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  অর্থসংকটের কারণে মাঝে চার বছর বন্ধ থাকার পর ১৮৩৬ সালের ১০ আগস্ট সপ্তাহে তিন সংখ্যা হিসেবে পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর সুযোগ্য সম্পাদনায় পত্রিকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে ১৮৩৯ সালের ১৪ জুন থেকে এটি দৈনিক পত্রে রূপান্তরিত হয়।

৭) কবি ঈশ্বরচন্দ্র ও বিধবাবিবাহ আন্দোলন-
প্রথম দিকে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করে এ বিষয়ে নানা ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করলেও পরে স্ত্রীশিক্ষার সমর্থন, ধর্মসভার বিরোধিতা, দেশের বৈজ্ঞানিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা এবং দরিদ্র জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে উদার মনোভাবের পরিচয় দেন। এমনকি তিনি অক্ষতযোনি বিধবার বিবাহেও আর আপত্তি করেননি।

৮) উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাসাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রথম বাঙালি কবি ও সাহিত্যিক-
ঈশ্বরচন্দ্রের স্মৃতিশক্তি ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত প্রখর ছিল। একবার যেটা শুনতেন  সেটা আর ভুলতেন না। কঠিন সংস্কৃত ভাষার দুর্বোধ্য শ্লোকসমূহের ব্যাখ্যা একবার শুনেই তাহ অবিকল কবিতায় রচনা করতে পারতেন। তিনি মুখে মুখে পদ্য রচনা করতেন। গ্রাম গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন এবং কবিগান বাঁধতেন। প্রায় বারো বৎসর গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে তিনি প্রাচীন কবিদের তথ্য সংগ্রহ করে জীবনী রচনা করেছেন। ঈশ্বর গুপ্ত অজস্র কবিতা রচনা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম ঈশ্বর গুপ্তের ‘কবিতা সংগ্রহ’ দীর্ঘ ভূমিকাসহ প্রকাশ করেন। তবে অশ্লীলতার কারণে সব কবিতা তিনি প্রকাশ করেন নি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত "গুপ্ত কবি" নামে সমধিক পরিচিত। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো তাঁর পরবর্তী সাহিত্যিকরা ঈশ্বর গুপ্তকে 'গুরু'পদে বরণ করেছিলেন। তাঁর ছদ্মনাম 'ভ্রমণকারী বন্ধু'।এছাড়া বহুবিধ পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা করে কবি-সাহিত্যিকদের উৎসাহ প্রদানের জন্য সমসাময়িককালে তিনি "কবিগুরু" হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছেন।

কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৫৯ সালের ২৩শে জানুয়ারি পরলোক গমণ করেন ।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।


05 March 2019

আজ ৫ই মার্চ সাহিত্যিক, গীতিকার ও শিক্ষাব্রতী প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর ১১৪তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


প্রভাবতী দেবী সরস্বতী গোবরডাঙার কাছে খাঁটুরা গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা গোপাল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী। প্রভাবতী দেবীর প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও খুব অল্প বয়েসেই পিতার উৎসাহে কীটস, শেলী, বায়রন প্রভৃতি কবির কবিতা পড়ে ফেলেন।

মাত্র ৯ বছর বয়েসে তার বিয়ে হয় কিন্তু বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না। তাই তিনি বিয়ের অল্প সময়ের মধ্যেই পিতার কাছে ফিরে আসেন।

প্রভাবতী দেবী ব্রাহ্ম গালর্স ট্রেনিং কলেজ থেকে টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেট অর্জন করে  উত্তর কলকাতার সাবিত্রী স্কুলে শিক্ষকতা করেন ও পরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উদ্যোগে তিনি কলকাতা পুরসভা পরিচালিত বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।

মাত্র ১১ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা ‘গুরুবন্দনা’ প্রকাশ পায় তত্ত্বমঞ্জরী পত্রিকায়। প্রথম গল্প ‘টমি’ প্রকাশ পায় অর্চনা পত্রিকায় ১৯২২ সালে। প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর বলিষ্ঠ লেখনী সেই সময় খুব নাম করেছিল। সামাজিক বিষয় ছিল তাঁর লেখার মূলধন। হিন্দু ধর্মের আদর্শ ও মূল্যবোধও পাওয়া যায় তাঁর লেখায়।  ১৯২৩ সালে তাঁর রচিত প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস ‘বিজিতা’ প্রকাশিত হয় জলধর সেন সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকায়। পরবর্তীকালে এই উপন্যাসটি বাংলা, হিন্দি ও মালয়লম ভাষায় যথাক্রমে ‘ভাঙাগড়া’, ‘ভাবী' ও ‘কুলদেবম্’ নামে চলচ্চিত্রও হয়। বাংলায় ‘ভাঙাগড়া’ ও হিন্দিতে  'ভাবী' চলচ্চিত্রগুলি
খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে।  কৃষ্ণা সিরিজের কৃষ্ণা নামের একটি মেয়ে ডিটেকটিভের সাহস ও দক্ষতা নিয়ে তিনি অনেকগুলি বই লিখেছিলেন। তিনি প্রথম বাংলা সাহিত্যে মেয়ে ডিটেকটিভের চরিত্র উপস্থাপনা করেন। সেই সময় তাঁর ‘ইন্টারন্যাশনাল সার্কাস’ ছোটদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিল। তার উপন্যাস পথের শেষে 'বাংলার মেয়ে' নামে নাট্য রূপায়িত ও সাফল্যের সাথে অভিনীত হয়েছে। বাঁশরী, সারথি, উপাসনা, উদ্বোধন, সম্মিলনী, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় লেখালিখি করতেন। গল্প-উপন্যাস মিলিয়ে তিনশোরও বেশি রচনা আছে তাঁর।

সাবিত্রী স্কুলে  শিক্ষকতা করার সময় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য লাভ করেন। কবিগুরুও তাঁকে সাহিত্য রচনাতে যথেষ্ট উৎসাহিত করেন। ‘মাটির দেবতা’ উপন্যাসটি হয়ত সেই উৎসাহের ফসল।

খাঁটুরার বঙ্গ বালিকা বিদ্যালয় যখন বিলুপ্তির পথে তখন প্রভাবতী দেবী নিজের প্রতিভা ও কর্মদক্ষতায় তাকে খাঁটুরা বালিকা বিদ্যালয় নামে পুনরুজ্জীবিত করে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সমাজসেবা, দেশপ্রেম ও নারী প্রগতিতে তিনি বিশেষ ভাবে উৎসাহী ছিলেন। ওই অঞ্চলে সরোজ নলিনী নারী মঙ্গল সমিতির শাখা কেন্দ্রের সভানেত্রী ছিলেন। ‘বিপ্লবীর স্বপ্ন’ উপন্যাসটি প্রভাবতীর স্বদেশপ্রেমের সাক্ষ্য বহন করে। 

তাঁর সাহিত্য প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ তাঁকে ‘সরস্বতী’ উপাধি দেন। এ ছাড়াও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘লীলা পুরস্কার’ পান।

কলকাতার পাতিপুকুরে নিজ বাসগৃহে প্রায় মাস তিনেক গলব্লাডারের অসুখে ভুগে ১৯৭২ সালের ১৪ই মে প্রভাবতী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।


03 March 2019

আজ ৩রা মার্চ ভাষাচার্য ডঃ সুকুমার সেনের ২৭তম মৃত্যু বার্ষিকীতে আমরা শ্রদ্ধা জানাই।


ভাষাচার্য ডঃ সুকুমার সেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুখ্যাত। ভাষাতত্ত্ব ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিষয়ে ছিল তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। আজ এই মনীষীর ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা শ্রদ্ধা জানাই।

ভাষাচার্য ডঃ সুকুমার সেনের জন্ম ১৯০০ সালের ১৬ই জানুয়ারি কলকাতায়। বর্ধমান জেলার গোতান গ্রামে ছিল তাঁদের পৈতৃক নিবাস। গোতান গ্রাম থেকেই সুকুমার সেনের পড়াশোনার শুরু। ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  প্রথম স্থান পেয়ে সংস্কৃতে এম.এ করেন। তাঁর পিএইচ.ডি গবেষণার বিষয় ছিল ‘হিস্ট্রিক্যাল সিনট্যাক্স অব ইন্দো–আরিয়ান’।

বাংলা শব্দের উৎস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সুকুমার সেন সংস্কৃত বা বৈদিক ভাষার অনুসন্ধান করে বাংলা ভাষা চর্চার বিষয়ে তিনি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। ভাষাবিজ্ঞানের চর্চাকে সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।

সুকুমার সেন ১৯৭১ সালে দু খন্ডে ২০,০০০ বাংলা শব্দের অভিধান রচনা করেন। এই অভিধানে তিনি প্রতিটি বাংলা শব্দের উৎস এবং বিবর্তন দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণরূপে ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় রেখেছেন। তিনি অনুরূপ চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন "বাংলার স্থান নাম" গ্রন্থটিতে। এখানে তিনি দেখিয়েছেন কোন শব্দ থেকে বাংলায় ব্যবহৃত কোন নামের উৎপত্তি হয়েছে এবং সেই সঙ্গে দেখিয়েছেন ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারায় কি ভাবে শব্দগুলো বর্তমান রূপ নিয়েছে। তিনি তাঁর অন্য গ্রন্থটিতে প্রাচীন ভারতীয় আর্য, বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষার জন্মবৃত্তান্ত অলোচনা করেছেন। "বাঙ্গালীর ভাষা" গ্রন্থটিতে সুকুমার সেন ও সুভদ্র সেন খুব সহজ সরল ভাষায় বাংলা ভাষার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যের প্রাচীন পুঁথিটি তাঁরই আবিষ্কার। সেকশুভোদয়া পুঁথিটিও তিনি সম্পাদনা করেছেন। ১৯৬৪ সালে ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পান। এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে যদুনাথ সরকার পদক দিয়ে সম্মানিত করে। রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র থেকে পান ররীন্দ্র তত্ত্বাচার্য উপাধি।
ডঃ সুকুমার সেন ৩রা মার্চ ১৯৯২ সালে পরলোক গমন করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

02 March 2019

আজ ২রা মার্চ প্রাচ্যের নাইটেঙ্গল, স্বাধীন ভারতের প্রথম রাজ্যপাল সরোজিনী নাইডুর ৭০তম প্রয়াণ দিবস।


আজ ২রা মার্চ প্রাচ্যের নাইটেঙ্গল, স্বাধীন ভারতের প্রথম রাজ্যপাল সরোজিনী নাইডুর ৭০তম প্রয়াণ দিবস। এই উপলক্ষে  তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। অনেকে তাঁকে ভারতীয় "কোকিল" এবং "প্রাচ্যের নাইটেঙ্গল" নামে ডাকেন। আর আপামোর ভারতবাসী  তাঁকে চেনে সরোজিনী নাইডু নামে।

হায়দ্রাবাদের এক হিন্দু পরিবারে ১৩ই ফেব্রুয়ারী ১৮৭৯ সালে সরোজিনী নাইডু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের মুনসীগঞ্জ জেলায়। পিতা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সুপণ্ডিত। সরোজিনীর মায়ের নাম বরদাসুন্দরী।

সরোজিনী মাত্র বারো বছর বয়সে এনট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে শিক্ষাজগতে এক অনন্য নজীর সৃষ্টি করেন। ছোট বয়স থেকেই তিনি সুন্দর কবিতা লিখতেন। মাত্র ছয় দিনে তেরোশো লাইনের একটি কাব্য তিনি লিখেছিলেন। তাঁর প্রথম কবিতার বই লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি দেশ-বিদেশে যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করে। তিনি ইংরাজিতে দু’হাজার লাইনের একটি নাটিকা রচনা করে সকলকে চমকে দেন। পিতা অঘোরনাথ তাঁর এই অভাবনীয় কীর্তি দেখে চমৎকৃত হন। অঘোরনাথ এই নাটিকাটি ছাপিয়ে  হায়দ্রাবাদের নিজাম বাহাদুরকে উপহার দিয়েছিলেন। সরোজিনীর মনের ইচ্ছা ছিল বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া করার। এই কথা নিজাম জানতে পেরে বার্ষিক ৩০০ পাউন্ড বৃত্তি ধার্য করে দিলেন আর সেই বৃত্তি নিয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে সরোজিনী ইংল্যান্ড গিয়ে কিংস কলেজ এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে শিক্ষালাভ করেন। ইংরেজি কবিতা রচনার জন্যে তিনি ‘প্রাচ্যের নাইটেঙ্গল’ নামে পরিচিতি পান। সরোজিনী উর্দু, তেলুগু ও ফারসি ভাষা শিখেছিলেন। 

১৭ বছর বয়সে সরোজিনী চট্রোপাধ্যায় ডঃ মুথিয়ালা গোবিন্দরাজুলু নাইডুর প্রেমে পরেন এবং ১৯ বছর বয়সে পডাশোনা সমাপ্ত করে তাঁর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। উল্লেখ্য, সেই যুগে অসবর্ণ বিবাহ সমাজে নিষিদ্ধ ছিল। সরোজিনী ব্রাহ্মণ হলেও গোবিন্দরাজুলু ছিলেন অব্রাহ্মণ। ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে তাঁদের বিবাহ হয়। বিয়ের পরে তার নামের সাথে স্বামীর উপাধী ধারণ করে সরোজিনী নাইডু নামে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁদের চারটি সন্তান হয়ে ছিল। জয় সূর্য, পদ্মজা, রণধীর ও লীলামণি। কন্যা পদ্মজা পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হন। সরোজিনী নাইডু ছিলেন একাধারে বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী অন্যদিকে বিশিষ্ট কবি।

সরোজিনী দেবী ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯১৯ সালে ভারতীয় নারীর অধিকার সাব্যস্ত করার জন্যে ইংল্যান্ডে যান সরোজিনী। ১৯২৫ সালে তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বিশেষত নারীজাতির মুক্তি আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, হিন্দু- মুসলিম ঐক্য, সমাজ ও আইন সংস্কার অভিযানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল নিযুক্ত হন তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল।

সরোজিনী নাইডু গান্ধীজীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সরোজিনী নাইডুর সম্পর্ক এতটাই অন্তরঙ্গ ছিল যে গান্ধীজি তাকে "মিকি মাউস" বলে ডাকতেন। দুজনের প্রথম সাক্ষাত হয়েছিল লন্ডনে। সেই ব্যাপারে সরোজিনী নাইডু লিখেছিলেন, "একজন ছোটখাটো চেহারার মানুষ। মাথায় একটাও চুল নেই। মেঝেতে কম্বল পেতে বসে তিনি তেলে ভেজানো টম্যাটো খাচ্ছিলেন তখন। সারা পৃথিবীর মানুষ তখন গান্ধীজীকে চেনে। সেই মানুষটাকে ওইভাবে দেখে আমি হেসে ফেলেছিলাম। উনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, 'নিশ্চয়ই আপনিই মিসেস নাইডু? এতটা অশ্রদ্ধা আর কে-ই বা করতে পারে আমাকে? আসুন, আমার সঙ্গে খাবার শেয়ার করুন।" এইভাবেই সরোজিনী নাইডু আর গান্ধীজীর সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল।

১৯৪৯ সালের ২রা মার্চ এলাহাবাদে নিজের অফিসেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান সরোজিনী নাইডু।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।