09 March 2019

মদনমোহন তর্কালংকারের ১৬১তম মৃত্যু বার্ষিকীতে আজ ৯ই মার্চ, আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


মনে পড়ে ছোটবেলায় পড়া ছড়াটি ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসমকলি সকলি ফুটিল’? মনে পড়ে 'আমার পণ'এর ছড়াটি 'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি'? এ ছড়াগুলি পড়েননি এমন বাঙালি হাতে গোনা। এখনও কেউ কেউ চেষ্টা করলে ছড়ার দু’এক লাইন মনেও করতে পারেন। কিন্তু বেশির ভাগ বাঙালিই জানেন না বাংলা শিশু সাহিত্যের সার্থক ওই কবিতার কবির নাম। তিন খন্ডে প্রকাশিত শিশুদের জন্য লেখেন ‘শিশু শিক্ষা’ নামে একটি বই। যে বই দিয়ে শৈশবে রবীন্দ্রনাথের লেখাপড়া শুরু হয়েছিল।  স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের লেখাপড়া শুরু হয়েছিল যাঁর বই পড়ে সেই কবিকে আমরা সবাই ভুলতে বসেছি। 

আসুন আজ ৯ই মার্চ, সেই শিশু কবি মদনমোহন তর্কালংকারের ১৬তম মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে তাঁকে স্মরণ করি।

ঊনবিংশ শতাব্দীয় অন্যতম পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব যিনি লেখ্য বাংলা ভাষার বিকাশে বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। তিনি বাংলার নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত হিসাবেও পরিগণিত। দু’শো বছর পেরিয়ে গেল, তবুও উপেক্ষিত এই কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কার।

মদনমোহনের তর্কালংকার ১৮১৭ সালের ৩রা জানুয়ারি নদিয়ার নাকাশিপাড়ার বিল্বগ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক উপাধি ‘চট্টোপাধ্যায়’ হলেও প্রাপ্ত উপাধি ‘তর্কালঙ্কার’ হিসেবেই তিনি সুপরিচিত। 
নিজের গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন এবং সেখানে  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর সতীর্থ ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। উভয়েই পন্ডিত  জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ও প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের থেকে সাহিত্য, ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, জ্যোতিষ ও স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। মদনমোহন পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষা গ্রহণ করেন। 

তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। পরবর্তীতে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার বিচারক নিযুক্ত হন। তিনি ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে মুর্শিদাবাদের এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কান্দির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হয়েছিলেন।

মদনমোহন তর্কালঙ্কার বাংলা ভাষায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য যথেষ্ট শ্রম ব্যয় করেন। তাঁর রচিত শিশুশিক্ষা গ্রন্থটি ঈশ্বরচনন্দ্রের  “বর্ণপরিচয়” গ্রন্থটিরও পূর্বে প্রকাশিত।  ‘বাসব দত্তা’ ও রসতরঙ্গিনী নামে তাঁর দুটি গ্রন্থ ছাত্রাবস্থায় রচিত হয়।

বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি ছিলেন ‘হিন্দু বিধবা বিবাহ’ প্রথার অন্যতম উদ্যোক্তা। ১৮৫৭ সালে প্রথম বিধবা বিবাহ হয়। ওই বিয়ের পাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং পাত্রী ছিলেন কালীমতি। তাঁদের দুজনের সন্ধান ও যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে মদনমোহন তর্কালঙ্কার ছিলেন অন্যতম।মদনমোহন বিদ্যাসাগরের সহযোগিতায় ‘সংস্কৃত-যন্ত্র’ (১৮৪৭) নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে ভারতচন্দ্রের  অন্নদামঙ্গল কাব্যটি সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়।

ইয়ং বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাতা ডিরোজিওর উদ্যোগে সে সময়ে দেশ জুড়ে চলছে কুসংস্কার, নানা সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে ও ইংরেজি স্ত্রী শিক্ষার প্রসারের জন্য আন্দোলন। ইয়ংবেঙ্গলের অন্যতম সদস্য রামতনু লাহিড়ীর বাড়িতে থাকার সুবাদে মদনমোহনও সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মুর্শিদাবাদ এবং কান্দিতে মেয়েদের স্কুল, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, অনাথ আশ্রম, দাতব্য চিকিৎসালয় ইত্যাদি জনহিতকর প্রতিষ্ঠান গঠন করেন।  সেকালে শিক্ষা সংস্কারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেবর এদেশের মেয়েদের জন্য ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’ স্থাপনে মদনমোহন ছিলেন তাঁর প্রধান সহযোগী। বিনা বেতনে তিনি ওই স্কুলে পড়াতেন। শুধু তাই নয় তিনি তাঁর ছোট্ট দুই মেয়ে ভুবনমালা এবং কুন্দমালাকে ওই স্কুলে ভর্তি করেন।  ওই সময় ভারতে মেয়েদের প্রকাশ্যে শিক্ষার সুযোগ ছিল না। সমাজ তা ভাল চোখে দেখতও না। স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে তার অবদান অনস্বীকার্য।  সর্বশুভকরী পত্রিকায় স্ত্রী শিক্ষার পক্ষে একটি যুগান্তকারী প্রবন্ধ লেখেন ১৮৫০ সালে। এর ঠিক পরেই তিনি লেখেন ‘স্ত্রীশিক্ষা’ নামে এর একটি বই। যেখানে তিনিই প্রথম বলেছিলেন শিশুকে শিক্ষিত করতে গেলে মায়েরই শিক্ষা আগে দরকার। স্ত্রীশিক্ষার সমর্থনে তিনি সর্বশুভকরী পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় (১৮৫০) দৃষ্টান্তস্থাপনকারী একটি প্রবন্ধ রচনা করেন।

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ৯ মার্চ কান্দিতে কলেরা রোগে ভুগে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।


No comments:

Post a Comment