11 March 2019

আজ ১১ই মার্চ, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৭৯তম জন্ম বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিশিষ্ট বাঙালি কবি, সংগীতকার, দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ। তিনি বাংলা সংকেত লিপি (শর্ট হ্যান্ড) ও স্বরলিপি রচনার অন্যতম অগ্রপথিক। 

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪০ সালের ১১ই মার্চ জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।

ছোটবেলা-
পাঁচ বছর বয়সে হাতে খড়ি। বাড়ীতেই একই শিক্ষকের কাছে সহোদর সতেন্দ্রনাথ ও খুরতূতো ভাই গণেন্দ্রনাথের সাথে লেখাপড়া শুরু। কিছুদিন বাংলা পড়েই একেবারে সংস্কৃত মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ শুরু পন্ডিতমশায়ের কাছে। ক্রমশ মুগ্ধবোধ পার হয়ে রঘুবংশ, কুমারসম্ভব শেষ। এরপর তিনি ভর্তি হন সেন্ট পল’স স্কুলে। এই স্কুলে তিনি দু বছর পড়ার পর স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ) ভর্ত্তি হন। ক্লাসের বাঁধাধরা নিয়মে পড়াশোনা তাঁর ভালো লাগেনি। ভরসা ছিল লাইব্রেরী। সেখান থেকে বই নিয়ে বাড়ীতে পড়েই তাঁর জ্ঞান তৃষ্ণা মিটত। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় পাশ করার জন্য পড়াশানা তাঁর পোষাল না। ছেড়ে দিলেন কলেজ।ছোটবেলা থেকেই কবিতা রচনা করার ঝোঁক থাকলেও, কবি হবার কথা ছিল না তাঁর। তিনি হতে চেয়েছিলেন চিত্রকর।

ভাইদের সাথে সম্পর্ক এবং একান্নবর্তী পরিবার-
অনুজের প্রতি দ্বিজেন্দ্রনাথের স্নেহ লক্ষ করা যায়। দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর পরের ভাই সতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের  অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যদিও দুই ভাইয়ের মধ্যে মতের কিছু পার্থক্য ছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন সমাজের প্রচলিত সংস্কারগুলির একনিষ্ঠ অনুগামী। অন্যদিকে সত্যেন্দ্রনাথ এই সংস্কারগুলিকে ভেঙে নতুন আধুনিক সমাজ গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন।পরিবারের কথা বলতে গিয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ বলেন 'আমাদের ফ্যামিলি মোটো হচ্ছে ওয়ার্ক উইল উয়িন। রবি সেটা লিটার‍্যালী পালন করছে। আমাদের ভাইদের মধ্যে রবিই সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়াছেন। সতু নিরীহ ছেলেমানুষ, রবি এক্টিভ আর আমি কিছুনা'। রবীন্দ্রনাথ দ্বিজেন্দ্রনাথকে বড়োদাদা বলে ডাকতেন। ঠাকুরবাড়ীর ঐশ্বর্য তখন সর্বোচ্চ শিখরে। দ্বারকানাথ ঠাকুর তখনো বেঁচে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ তখনো ব্রাহ্ম হননি। তখনো এবাড়ী ওবাড়ী হয়নি। যৌথ পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায়, খুড়তুতুতো ভাই বোনেদের মধুর সাহচর্যে, বাড়ীতে দোল, দুর্গোৎসবের ভরপুর আনন্দ নিয়ে, কাকীমা যোগমায়াদেবীর স্নেহ-আদরে তাঁর ছোটবেলাটি কেটেছিল। বাড়ী ছিল তাঁদের স্বর্গ। তাঁর থেকে দু দশকের ছোট রবি এসবের স্বাদ পায়নি। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলে  দ্বিজেন্দ্রনাথের ছোটবেলাতেই জোড়াসাঁকোর একান্নবর্তী ঠাকুরবাড়ী দু ভাগ হয়ে যায়। দ্বিজেন্দ্রনাথ একান্নবর্তী পরিবারের বিশেষ ভক্ত ছিলেন এবং তিনি ভাবতেন তাঁর একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে যে প্রীতি ও সদ্ভাব ছিল আজকাল আর দেখা যায় না। সামাজিক রীতিনীতি ঠিক মত মেনে চললে এই রকম পারিবারিক ব্যবস্থাই যে ভালো সে বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ ছিলেন। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের একটি বিশেষ দোষ তাঁর চোখে পড়েছিল। তিনি বলতেন  'এখানে যদি কেউ ধর্ম সম্বন্ধে নতুন মত অবলম্বন করার প্রয়াস করে তাহলে এই একান্নবর্তী পরিবার বাধা দেয়। সে কিছুতেই ব্যক্তি বিশেষের মত মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে  চায় না, অথবা তার মত মেনে নিয়ে তাকে বৃহৎ পরিবারের মধ্যে থাকতে দিয়ে, স্বাধীন ভাবে তাকে তার নিজের স্বতন্ত্র জীবন যাত্রা নির্বাহ করতে দেয় না। এইখানেই এই জয়েন্ট ফ্যামিলি সিস্টেম এর সংকীর্ণতা'।

বিবাহ-
যৌবনারম্ভেই তিনি যশোহরে নরেন্দ্রপুরের তারাচাঁদ চক্রবর্তীর কন্যা সর্বসুন্দরীকে বিয়ে করেন। তাঁর পাঁচ পুত্রও দুই কন্যা। যৌবনেই তাঁর স্ত্রীবিয়োগ ঘটেছিল। অবশিষ্ট জীবন দ্বিজেন্দ্রনাথ বিপত্নীক অবস্থাতেই কাটিয়ে ছিলেন। স্ত্রী মারা যাবার পর তিনি শান্তিনিকেতনে চলে আসেন।

কাব্য চর্চা-
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন কাব্যচর্চা শুরু করেন, তখন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন স্বীয় সাফল্যের শীর্ষদেশে। সেই যুগে বাংলার প্রত্যেক কবিই অল্পবিস্তর মধুসূদন দ্বারা প্রভাবিত হলেও, দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন এই প্রভাবের ঊর্ধ্বে। বরং মধুসূদনই দ্বিজেন্দ্রনাথকে ভবিষ্যতের কবি হিসাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের ঠিক এক বছর আগে দ্বিজেন্দ্রনাথের বয়স যখন ২০ বছর তখন তাঁর প্রিয়কাব্য কালিদাসের সংস্কৃত ভাষায় রচিত মেঘদূতের বঙ্গানুবাদ গ্রন্থটি প্রকাশ হয়। এরপর তাঁর তত্ত্ববিদ্যা (তিন খণ্ডে) প্রকাশিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় রূপক-কাব্য স্বপ্ন-প্রয়াণে এক যুবকের ভ্রমণবৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। ১৮৮৪ সাল থেকে সুদীর্ঘ ২৫ বছর তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

আত্মভোলা খাঁটি মানুষ-
তাঁকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন পুত্রবধূ হেমলতা দেবী। তিনি তাঁর সম্পর্কে বলেছেন “সকল দিকে তিনি যে একজন খাঁটি মানুষ ছিলেন এতে কোন ভুল নাই। তাঁর ঈশ্বরভক্তি ছিল খাঁটি, পিতৃভক্তি ছিল খাঁটি, ভাইদের ও সন্তানদের প্রতি স্নেহ ছিল খাঁটি, স্বদেশপ্রীতি, বন্ধুপ্রীতি, জীবপ্রীতি ছিল তাঁর খাঁটি। দার্শনিক তত্বের বিচার ও বিশ্লেষণে অনুরাগ ছিল খাঁটি। কাব্যে প্রীতি ও বাংলা ভাষার প্রতি দরদ ছিল খাঁটি।
তিনি প্রায়ই তাঁর চশমা খুঁজে পেতেন না। তখনই প্রিয় ভৃর্ত্য মুনীশ্বরকে খুব বকাবকি করতেন। কিন্তু সেই চশমা পাওয়া যেত তাঁর পকেট থেকে বা কপালের ওপর থেকে। অনেক সময় চোখে চশমা পড়া থাকলেও আমার চশমা কোথায় বলে হাঁক পারতেন। চশমা খুঁজে পাওয়া গেলে অট্টহাসিতে বাড়ী মাতিয়ে তুলতেন। এই রকমই আত্মভোলা মানুষ ছিলেন।

হিন্দুমেলা বা স্বদেশী মেলা-
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর দেবেন্দ্রনাথ মল্লিকের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় স্বদেশী মেলার চালু হয়। ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলে ভক্তির সাথে উপলব্ধির চেষ্টা সেই প্রথম।  এই মেলায় দেশের স্তবগান গাওয়া হত, সেই সাথে চলতো কবিতা পাঠ, দেশী শিল্প, ব্যায়াম প্রভৃতি প্রদর্শণ করা হত। সেখানে দেশী গুণী লোকদের পু র স্কৃত করা হতো। এই মেলার জন্য দ্বিজেন্দ্রনাথ দেশাত্মবোধক গানও রচনা করেছিলেন। এই মেলাকে কেন্দ্র করে অনেকেই বিভিন্ন জাতীয় সংগীত সৃষ্টি করেন। প্রকৃতপক্ষে সেই প্রথম সঠিক দেশানুরাগের গান রচিত হতে থাকলো। এই মেলাই বাংলাদেশে হয়তো বা সারা ভারতবর্ষে সর্ব প্রথম 'জাতীয় শিল্প প্রদর্শণী'র সূচনা করে। এই মেলা প্রথমদিকে চৈত্র সংক্রান্তির দিন অনুষ্ঠিত হত বলে এই মেলার নাম  'চৈত্রমেলা' ছিল।

সংসারিক বুদ্ধি-
ছিল না শুধু সংসারিক বুদ্ধি। এইজন্য তাঁর আপন জনেরা তাঁকে বিষয় -আশয় থেকে দুরে রাখতেন। তিনি অনাসক্ত গৃহী ছিলেন। তাঁর অন্তরে যেমন একটি সহজ সরল দর্পহীন তেজস্বিতা ছিল, বাহিরের পোষাক পরিচ্ছদেও তেমনি অনাড়ম্বর। একবার গরম লুচি খাবার সময় হাতে ঘি লেগে যায়। তক্ষুনি আদেশ করেন ঘিয়ের বদলে লুচি জলে ভাজতে। এরকমই ছিল তাঁর সাংসারিক জ্ঞান।

শান্তিনিকেতন ও পশুপাখী প্রীতি-
পশুপাখীদের প্রতি তাঁর আন্তরিক ভালোবাসা ছিল। শান্তিনিকেতনের নিচু বাংলার বারান্দায় তিনি যখন বসতেন তখন চড়াই পাখি, কাঠবিড়ালি, শালিখ পাখি তাঁকে ঘিরে থাকত আর তাঁর গায়ে মাথায় চড়ে বসত। অনেক সময় কাঠবিড়ালি তাঁর জামার মধ্যে ঢুকে খেলা করত। এক শালিখ ভালোবাসার আবেশে তাঁর চোখে ঠুকরে দিয়েছিল। কি বুঝে তার পরদিন থেকে সে আর আসেনি। তাকে দেখতে না পেয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথের মন খারাপ থাকত।

মহাত্মা গান্ধী-
তিনি গান্ধিজীর খুব ভক্ত ছিলেন। গান্ধীজিও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ যতদিন বেঁচে ছিলেন শেষ সময় পর্যন্ত তিনি গান্ধীজির সাথে যোগাযোগ রেখে ছিলেন। এই যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও দীনবন্ধু এন্ড্রুজ। ১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধি তৃতীয়বার শান্তিনিকেতনে আসেন এবং থাকেন তিন দিন। এই তিন দিনের প্রতিদিনই গান্ধীজি দ্বিজেন্দ্রনাথের সাথে সকাল সন্ধ্যায় দুবেলাই দেখা করতেন। এটাই ছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের শেষ সাক্ষাৎ।

হারমনিয়াম ও বাঁশি-
দ্বিজেন্দ্রনাথের পিতা বাড়ীতে হারমোনিয়াম আনেন। ভারতবর্ষে সেই প্রথম এই যন্ত্রটি এল। দ্বিজেন্দ্রনাথ এই হারমোনিয়াম বাজাতে শিখেছিলেন। তিনি এক সময় বাঁশি বাজাতেন। বাড়ীতে অনেক রকমের বাঁশি থাকত।

ঈশ্বরপরায়ণ, বিষয়ভোলা, জ্ঞানবৃদ্ধ, স্বভাবশিশু প্রকৃতির কোলঘেঁষা এই আশ্চর্য মানুষটি বিদায় নিলেন ১৯২৬ সালের ১৯শে জানুয়ারী।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

No comments:

Post a Comment