16 March 2019

আজ ১৬ই মার্চ, সাহিত্যিক, অনুবাদক, রসায়নবিদ ও অভিধান প্রণেতা রাজশেখর বসুর ১৩৯তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


বাঙালির বড়ই বদনাম আছে কারোর ডাকনাম বিকৃতি করার। কিন্তু ফটিক ডাকনামটা ফটকা বা ফইটক্যা হয়ে ছিল কিনা জানা নেই তবে এই ফটিক একদিন বড়মাপের সাহিত্যিক, রসায়নবিদ্, ভাষাতাত্ত্বিক, অভিধান রচয়িতা, ধর্মগ্রন্থ রচয়িতা ও কৌতুককাহিনীর রচয়িতা হয়ে উঠেছিল। এই ফটিকই বেঙ্গল কেমিক্যালকে ফুলে ফাঁপিয়ে তুলেছিল।বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ফটিকের নামে কৃতিম অভিযোগ করে বলেন "আপনি ফটিকের বইয়ের এত প্রশংসা করছেন যে বেঙ্গল কেমিক্যাল অসুবিধায়। প্রশংসার দরুন বেঙ্গল কেমিক্যাল ক্ষতির সন্মুখিন হবে। কারণ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার সব কাজকর্ম শিকেয় তুলে, কেমিস্ট্রি ছেড়ে গল্প লেখায় মত্ত হবে"। রবীন্দ্রনাথ এর যথাযথ উত্তরও দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ একবার ফটিককে বলেছিলেন " তুমি এত রস কোথা থেকে পাও?" ফটিকের উত্তর ছিল "আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমি রসায়নের লোক।" এই ফটিকের নামের আড়ালে মানুষটা হচ্ছেন রাজশেখর বসু।

রাজশেখর নাম-
রাজশেখর বসুর বড় ভাই শশীশেখরের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় "পিতা চন্দ্রশেখর দ্বারভাঙ্গা থেকে ঘুরে এসে বলেন ফটিকের নাম ঠিক হয়ে গেছে। তখন মহারাজ লক্ষীশ্বর সিংহ জিজ্ঞাসা করেন, তোমার দ্বিতীয় ছেলের নামও একটা শেখর হবে নাকি? আমি বললাম, ইওর হাইনেস, যখন তাকে আশীর্বাদ করেছেন, তখন আপনিই তার শিরোমাল্য, আমি আপনার সামনেই তার নামকরণ করলাম রাজশেখর।"

ছদ্মনাম-
রাজশেখর বসুর একটা ছদ্মনাম নাম ছিল "পরশুরাম"। তিনি  পরশুরাম ছদ্মনামে তাঁর ব্যঙ্গকৌতুক ও বিদ্রুপাত্মক কথাসাহিত্যের জন্য প্রসিদ্ধ। তিনি ছদ্মনাম কেন নিয়েছিলেন? পৈতৃিক বাড়ি ১৪ নং পার্শি বাগান লেনে বসত "উৎকেন্দ্র"র মজলিসে বৈঠক। উৎকট এবং কেন্দ্র এই দুটি শব্দ নিয়ে উৎকেন্দ্র। সেখানে রাজশেখর ছাড়াও  থাকতেন তাঁর চার ভাই, জলধর সেন, শৈলেন সাহার মত জ্ঞানী গুণীরা। এখানে সবরকমেরই আলোচনা হত। রাজশেখরের কথায় পরশুরাম একজন স্যাকরা। এই নামের সাথে পৌরাণিক পরশুরামের কোনো সম্বন্ধ নেই। রাজশেখরের স্বনামে গল্প লিখতে সংকোচ ছিল। বন্ধু বান্ধবরা একটা ছদ্মনাম চিন্তা করছিলেন। সেই সময় তারাচাঁদ কর্মকার নামে একজন  উৎকেন্দ্রের মজলিসে আসেন। হাতের কাছে তাকে পেয়ে তার নামটাই নিয়ে নেয়। এই নামের পেছনে অন্য কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল না। এই উৎকেন্দ্রই রাজশেখর বসুর গড্ডালিকার গল্পগুলো পাঠ করা হতো। জলধর সেন সেগুলি তার সম্পাদিত "ভারতবর্ষ" পত্রিকায় ছাপান। পরে এটা বই আকারে প্রকাশ হলে রাজশেখর প্রথম পরশুরাম ছদ্মনামটা ব্যবহার করেন। তখন তাঁর বয়স ৪২ বছর। এখানে প্রখ্যাত সাহিত্যক সৈয়দ মুজতবা আলীর সাথে মিল আছে। মুজতবার প্রথম বই "দেশে-বিদেশে" তাঁর ৪২ বছর বয়সেই প্রকাশিত হয়।

জন্ম-
রাজশেখর বসু ১৮৮০ সালের ১৬ই মার্চ বর্ধমান জেলার বামুনপাড়া গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা চন্দ্রশেখর বসু দ্বারভাঙ্গা-রাজ-এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন।

ছোটবেলা ও পড়াশুনা-
তাঁর ছোটবেলা কাটে দ্বারভাঙ্গায়। তিনি ১৮৯৫ সালে দ্বারভাঙ্গা রাজস্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন এবং এরপর পাটনা কলেজে ভর্তি হন ফার্স্ট আর্টস পড়ার জন্য। ১৯০০ সালে রসায়নে এম.এ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম স্থান লাভ করেন। এর দুই বছর পরে ১৯০২ সালে রিপন কলেজ থেকে বি.এল পাশ করে মাত্র তিনদিন আইন ব্যবসা করেই বুঝেছিলেন আইনের থেকে বিজ্ঞান চর্চাই তাঁর কাছে আকর্ষনীয় বেশি।

সাহিত্যচর্চা-
১৯২২ সালে পরশুরাম ছদ্মনামে তাঁর প্রথম  রচনা লেখেন। তাঁর ব্যঙ্গ রচনা "শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড" প্রকাশিত হয় জলধর সেনের "ভারতবর্ষ" পত্রিকায়। বেঙ্গল কেমিক্যালসে কাজ করার সময় থেকেই তাঁর সাহিত্য চর্চা আরম্ভ। রাজশেখরের কবি স্বভাব থাকলেও তিনি ছিলেন খুবই বাস্তববাদী। প্রতিটি কাজ নিখুঁত ছক করেই তিনি কাজে নামতেন। বেঙ্গল কেমিক্যালকে পূর্ণভাবে গড়ে তোলার কাজই হোক বা "চলন্তিকা" অভিধান, রামায়ণ- মহাভারতের অনুবাদ হোক, সব কিছুই তিনি প্লানমাফিক করতেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ মোট ২১টি।

শেষ জীবন-
রাজশেখর বসু মৃণালীনি দেবীকে বিবাহ করেন। বসু দম্পতির এক কন্যা ছিল। রাজশেখরের বয়স যখন ৫৪ বছর তখন তাঁর মেয়ের জামাই খুব অল্প বয়সে অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যায়। এর আট বছর পর তাঁর স্ত্রী মৃণালীনি দেবীও লোকান্তরিত হন। পরবর্তী ১৮ বছর স্ত্রীবিহীন একাকী জীবনে রচিত হয় তাঁর অমূল্য সাহিত্যকর্মসমূহ। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-দূর্দশার কথা তাঁর লেখাতে পাওয়া যায়নি। নাতি নাতনিকে বুকে আগলে বড় করেছেন। ভাল ঘরে বিয়ে দিয়েছিলেন নাতনির। নিজেই নিজের চিকিৎসা করতেন। ১৯৫৯ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তিনি লেখা চালিয়ে যেতে থাকেন। শেষে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ২৭শে এপ্রিল দ্বিতীয় দফা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর জীবনাবসান হয়।

বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায়ের পরিচালনায় রাজশেখর বসুর দু'টি ছোটগল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরী হয়। সেগুলো হলো পরশ পাথর এবং  বিরিঞ্চি বাবা অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা 'মহাপুরুষ।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

No comments:

Post a Comment