10 March 2019

বাংলার নবজাগরণের যুগে বিতর্কিত চরিত্র রাজা রাধাকান্ত দেবের ২৩৫তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আজ ১০ই মার্চ, বাংলার নবজাগরণের যুগে বিতর্কিত চরিত্র রাজা রাধাকান্ত দেবের ২৩৫তম  জন্মবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

রাধাকান্ত দেব স্বদেশ-সেবায় আত্মনিয়োগ করে যে সব জনহিতকর কাজ করে গিয়েছেন, সেগুলি উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসে তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। তিনি একজন পন্ডিত ও কলকাতা হিন্দু সমাজের বিশিষ্ট নেতা। তিনি একদিকে ছিলেন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা, অথচ শিক্ষাবিস্তারে তিনি পরম প্রগতিশীল।রাজা রাধাকান্ত দেব নিজেকে কলকাতার হিন্দু সমাজের প্রধান নেতারূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

জন্ম, শিক্ষা ও বিবাহ-
১৭৮৪ সালে ১০ই মার্চ রাধাকান্ত দেব উত্তর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেবের দত্তকপুত্র  গোপীমোহন দেবের পুত্র রাধাকান্ত দেব।রাজবাড়িতে জন্ম গ্রহণ করে প্রচুর ঐশ্বর্য্য ও বিলাসিতায় লালিত পালিত হয়েও রাধাকান্তের পড়াশুনায় গভীর মনযোগ ছিল। পাঁচ বছর বয়সে রাধাকান্ত দেবের শিক্ষা শুরু হয় গৃহশিক্ষক পন্ডিত কৃষ্ণমোহন বসুর কাছে। গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে তিনি সংস্কৃত ভাষা ভালোভাবে শিখে নেন। তাছাড়াও আরবী ও পারস্য ভাষাতেও তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তিনি কলকাতায় ইংলিশ একাডেমিতে ইংরাজী ভাষা শেখেন। অতি অল্প বয়সেই তিনি এতগুলি ভাষা আয়ত্ত করেন। মাত্র দশ বছর বয়সে গঙ্গামণি নামে এক বালিকার সাথে তাঁর বিয়ে হয়।

হিন্দু ধর্ম ও গোড়ামী-
ছোটবেলা থেকেই তাঁর মন স্বধর্মে অনুরক্ত ছিল। বিদেশী ভাষা শিখেও হিন্দুধর্মের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস ও ভক্তি ছিল। তিনি ছিলেন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের সমর্থক। দেশের লোকেদের পড়াশুনা এবং জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে ১৮২৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী কলকাতার হিন্দু কলেজের শিক্ষিত, পন্ডিত ও গণ্যমাণ্য লোকেদের নিয়ে গৌড়ীয় সমাজ স্থাপন করেন। 

রাধাকান্ত দেব ও শিক্ষার উন্নয়ন-
তিনি একদিকে ছিলেন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা, অথচ শিক্ষাবিস্তারে তিনি পরম প্রগতিশীল। সংস্কৃত ভাষা যাতে দেশবাসীর মধ্যে পুনরায় প্রচলিত হয় তিনি সেই চেষ্টা করেছিলেন। রাধাকান্ত দেব সবসময়ই শিক্ষার উন্নয়ন, বিশেষত হিন্দুদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে যাতে জ্ঞান অর্জন করতে পারে সে বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। ১৮১৭ সালে কলকাতা হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং ত্রিশ বছরেরও বেশি কাল ধরে তিনি এই কলেজের একজন সক্রিয় পরিচালক ছিলেন। বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও তিনি গভীর আগ্রহী ছিলেন।

স্ত্রীশিক্ষা ও রাধাকান্ত দেব-
স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারে রাধাকান্ত দেব ছিলেন বিশেষ উৎসাহী। ১৮২০ সালে মেয়েদের শিক্ষার জন্য ব্যক্তিগত উদ্দেগে তিনি "মহিলা শিক্ষা সমিতি" স্থাপন করেন। ১৮২২ সালে এ বিষয়ে উন্নতির জন্য স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক নামে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই সময়ে রাধাকান্ত নিজে ৪০ জন মেয়ের শিক্ষার ভার নিয়েছিলেন। তিনি ছোটো ছোটো চারটি শোভাবাজার, জানবাজার, শ্যামবাজার ও এন্টালিতে মেয়েদের স্কুল খোলেন। তিনি নিজের পরিবারের মহিলাদের শিক্ষাদানের জন্য ইংরেজ শিক্ষিকা  নিযুক্ত করেন।

শব্দকল্পদ্রুম রচনা-
তাঁর রচিত সংস্কৃত অভিধান শব্দকল্পদ্রুম  তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে। ১৮১৫ সালে তিনি শব্দকল্পদ্রূম রচনা শুরু করেন। আটটি খণ্ডে বিভক্ত এর প্রথম খণ্ডটি প্রকাশ পায় ১৮২২ সালে এবং শেষ খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ সালে। এই বইটি তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি সহ অন্যান্য ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি সম্মানিত হন। ঠাকুর পরিবারের পাথুরিয়াঘাটা শাখার হরকুমার ঠাকুর তাঁকে এই গ্রন্থ সংকলনে সহায়তা করেন।

সতীদাহ, বিধবাবিবাহ  ও রাধাকান্ত দেব-
রামমোহন রায়ের ধর্মান্দোলন শুরু হলে কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাঁকে সনাতন ধর্মের রক্ষকরূপে বরণ করেন। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ফেব্রুয়ারি গৌড়ীয় সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর কর্মসমিতির সদস্য নিযুক্ত হন এবং সতীদাহ প্রথা সম্পর্কে তিনি রামমোহন রায়ের বিরোধিতা করেন। এ সম্পর্কে তিনি লর্ড বেন্টিকের সঙ্গেও আলোচনা করেছিলেন। ধৰ্ম্ম বিষয়ে রাধাকান্ত দেব রক্ষণশীল ও গোঁড়া হিন্দু ছিলেন । ১৮২৯, ডিসেম্বর মাসে লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ক যখন ‘সতীদাহ’ বে-আইনি বলে ঘোষণা করেন, তখন রাধাকান্ত দেবই পিতৃপ্রতিষ্ঠিত ধর্মসভার পক্ষ থেকে এই মঙ্গলময় বিধানের বিরুদ্ধে বিলেতে আপীল করেছিলেন। ডিরোজিওর নব্যচিন্তাধারা এবং পরবর্তীকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের  বিধবাবিবাহ ও বহুবিবাহ রদ সম্পর্কিত আন্দোলনের বিরোধিতা করেন।

উপাধি ও রাধাকান্ত-
রাধাকান্ত দেবের চরিত্র-মাধুর্য,পান্ডিত্য ও স্বধর্মে নিষ্ঠা ও প্রগাড় অনুরাগ দেখে দেশীয় এবং ইংরেজরা তাঁকে শ্রদ্ধা করতো। জীবনে রাধাকান্ত বহু রাজ-সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন। ১৮৩৫ সালে তিনি কলকাতা শহরের 'জাস্টিস অব পিস' এবং 'অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট' হিসাবে নিযুক্ত হন। তখনকার দিনে খুব কম দেশীয় লোকের ভাগ্যেই এই উচ্চ সন্মান লাভ করতো । ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে গভর্ণর জেনারেল তাঁকে  ‘রাজা বাহাদুর" উপাধিতে ভূষিত করে তাঁর গুণের সন্মান জানায়। ১৮৫১ খৃষ্টাব্দে "ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া এসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হলে রাধাকান্ত দেবই এর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৮৬৬ সালে তিনি বাঙালীদের মধ্যে সৰ্ব্বপ্রথম কে-পি-এস-আই উপাধি লাভ করেন।

রাধাকান্ত দেবের বৃন্দাবন যাত্রা, পশুপাখী প্রীতি ও মৃত্যু-
রাধাকান্ত দেব সুদীর্ঘ কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করে ১৮৬৪ সালে বৃন্দাবনে চলে যান। সেখানে তিনি 'পদাবলী' দু ভাগে ভাগ করেন। বৃন্দাবনে সে সময় প্রচুর ময়ূর দেখা যেত। ইংরেজরা ছুটি কাটাতে এসে ময়ূর শিকার করতো। এই পাখী হত্যায় রাধাকান্তের মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। তিনিই বৃন্দাবনে ময়ূর শিকার বন্ধ করেন।

রাধাকান্ত আগের থেকেই জানতে পেরে ছিলেন তাঁর মৃত্যুর কথা। দেহত্যাগের তিন দিন আগে থেকেই তিনি সর্দ্দিতে কষ্ট পাচ্ছিলেন। মৃত্যুর দিন অল্প গরম দুধ খেয়ে প্রিয় ভৃত্যকে আগাম জানিয়ে দেন তাঁর মৃত্যুর কথা। পুরোহিত মশায়কে ডেকে  তিনি জানিয়ে দেন কি করে তাঁর সৎকার করা হবে। তিনি ছিলেন বৈষ্ণব। মৃত্যুর পর তুলসী ও চন্দন কাঠে তাঁর দেহ দাহ করার ব্যবস্থা তিনি নিজেই করে ছিলেন। ভৃত্যকে সেই সব কথা আবার মনে করিয়ে দিয়ে তিনি আত্মীয়স্বজনদের থেকে বিদায় নিয়ে নিচের তলায় যান। তারপর তুলসী তলায় শুয়ে মাথার দিকে শালগ্রাম শিলা রেখে অন্তিমশয্যা গহণ করেন। দু ঘন্টা ধরে মালা জব করার পর রাধাকান্ত দেব অনন্ত পথে যাত্রা করেন।

১৮৬৭ সালের ১৯শে এপ্রিল রাধাকান্ত দেবের বৃন্দাবনে  মৃত্যু হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ৮৪ বছর।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

2 comments:

  1. দুটো দারুন ভালো কাজের বিরোধিতা করেছিলেন। সতীদাহ প্রথা রোধ ও বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে। সবদিক বিচার করে তিনি নিন্দিত‌ই।

    ReplyDelete
  2. প্রভাবশালী বড়লোকশ্রেনীর। ইংরেজের পদলেহনকারী। অন্ধ কুসংস্কার ও ধর্মান্ধ মানুষ। ধর্মান্ধ মানুষ সমাজে প্রভাবশালী হুলে সনাজের বিরাট ক্ষতি হয়। সেই ক্ষতি করার প্রবল চেষ্টা করেছিলেন রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের প্রবল বিরোধিতা করে। ভাষা ও ধর্মীয় শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন ঠিকই তবে কুপ্রথার সমর্থক কখনও বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারে না। এই বংশের আদি পুরুষভনব কৃষ্ণ একজন কুলাঙ্গার ছিলেন। শোভাবাজার রাজবাড়ি বাংলার কলঙ্ক।

    ReplyDelete