06 March 2019

আজ ৬ই মার্চ, উনবিংশ শতাব্দীর কবি, সাহিত্যিক ও নির্ভীক সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ২০৭তম জন্মদিনে আমাদের শুভেচ্ছা।


কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বর্তমান যুগ-প্রভাতের 'ভোরের পাখী' বলে পরিচিত।  ইংরাজী কাব্যের প্রভাব থেকে তিনি মুক্ত অথচ পাশ্চাত্য ভাবে আবিষ্ট সমাজের আচার আচরণ এবং সমকালীন রাজনীতি তাঁর কাব্যে রঙ্গরসের খোরাক যুগিয়েছে। তাঁর কবিতায় স্বদেশ, স্বভাষা ও ধর্মের প্রতি গভীর ভালোবাসা ফুটে ওঠে।
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮১২ সালের ৬ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনা জেলার  কাঞ্চনপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা হরিনারায়ণ দাশগুপ্ত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ছিলেন। মায়ের নাম শ্রীমতি দেবী।

১) পিতা হরিনারায়ণ দাশগুপ্তের দ্বিতীয় বিয়ে এবং কবি ঈশ্বরচন্দ্রের মেজাজ-
ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স যখন দশ তখন তাঁর মা মারা যান। স্ত্রী মারা যাবার কিছুদিন পরেই তাঁর পিতা হরিনারায়ণ দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন। তিনি বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ী থেকে বাড়ী না ফিরে কর্মস্থলে চলে যান। নববধূ একা বাড়ীতে এলে, হরিনারায়ণের সৎ মা  তাকে বরণ করে নেন। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র খাঁটি জিনিষ বড় ভালবাসতেন। খাঁটি মা কোথায় চলে গেছে তার বদলে নকল মাকে তিনি মানতে পারলেন না। ঈশ্বরচন্দ্রের রাগ আর সহ্য হল না। তিনি সৎ মাকে লক্ষ্য করে হাতের কাছে এক গাছা লাঠি নিয়ে ছুড়ে মারলেন। সৌভাগ্যক্রমে সেই লাঠি পাশের কলা গাছের ওপর পড়াতে সৎ মা সে যাত্রায় বেঁচে যান। ঈশ্বরচন্দ্র তখন একটা ঘরে ঢুকে পড়ে দরজায় খিল আটকে দিলেন। সমস্ত দিন বন্ধ ঘরে থাকলেন। পরে তাঁর জ্যেঠামশাই দরজা ভেঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রকে জুতো পেটা করেন।  ঈশ্বরচন্দ্রের ঠাকুরদা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, “তোদের মা নাই, মা হইল, তোদেরই ভাল। তোদেরি দেখিবে শুনিবে।” একথা ঈশ্বরচন্দ্রের সহ্য হল না। ঈশ্বরচন্দ্র দাদুকে মুখের উপর বলেন,“হাঁ! তুমি আর একটা বিয়ে করে যেমন বাবাকে দেখ্‌ছ, বাবা আমাদের তেমনই দেখ্‌বেন।” এরকমই ছিল ঈশ্বরচন্দ্র ছোটবেলাকার মেজাজ।

২) রাতে মশা দিনে মাছি এই নিয়ে কলকাতায় আছি-
দুরন্ত ছেলে, কাজেই ঈশ্বরচন্দ্র লেখা পড়ায় বড় মন দিলেন না। বুদ্ধির অভাব ছিল না। শোনা যায়  ঈশ্বরচন্দ্রের যখন তিন বছর বয়স, তখন তিনি একবার কলকাতায় মামার বাড়ীতে এসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। কলকাতায় তখন খুবই  অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছিল। আর ছিল মশা মাছির বড়ই উপদ্রব। প্রবাদ আছে, ঈশ্বরচন্দ্র বিছানায় শুয়েই থেকেই সেই মশা মাছির উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে  কবিতা আওরায় “রেতে মশা দিনে মাছি, এই তাড়্‌য়ে কল্‌কেতায় আছি।”

৩) কবির প্রেম আর বিয়ে-
ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স যখন ১৫ বছর তখন  গুপ্তীপাড়ার গৌরহরি মল্লিকের মেয়ে দুর্গামণি দেবীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। দুর্গামণির কপালে সুখ হল না। দুর্গামণির রূপ,ব্যবহার, আচরণ ঈশ্বরচন্দ্রের পছন্দ হয়নি। কবি ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে স্ত্রী দুর্গামণি ছিলেন কুৎসিতা! হাবা! বোবার মত! একে স্ত্রী বলে মানা যায় না। ঈশ্বরচন্দ্র বিয়ের পর স্ত্রী দুর্গামণির সাথে কখনও কথা বলেন নি। কিন্তু বিয়ের আগে কবি ঈশ্বরচন্দ্রের মধ্যে প্রেমের ভাব ছিল। শোনা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র কাঁচরাপাড়ার এক বড়লোকের পরমা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পিতা হরিনারায়ণ তাঁর ইচ্ছায় জল ঢেলে দেন এবং গুপ্তীপাড়ার গৌরহরি মল্লিকের মেয়ের সাথে বিয়ে দেন। গৌরহরি, বৈদ্যদের মধ্যে একজন প্রধান কুলীন ছিলেন, সেই কুল-গৌরবের কারণ এবং অর্থদান করতে হবে না বলে, সেই পাত্রীর সাথে হরিনারায়ণ ছেলের বিয়ে দেন। ঈশ্বরচন্দ্র পিতার আজ্ঞায় নিতান্ত অনিচ্ছায় বিয়ে করেন, কিন্তু বিয়ের পরই তিনি বলেন যে, আমি সংসারধর্ম করব না। পরে ঈশ্বরচন্দ্রের আত্মীয় ও বন্ধুরা তাঁকে আর একটা বিয়ে করতে বলাতে, তিনি বলেন যে, "দুই সতীনের ঝগড়ার মধ্যে পড়িয়া মারা যাওয়া অপেক্ষা বিবাহ না করাই ভাল"।

৪) ঈশ্বরচন্দ্রের ব্যঙ্গাত্বক কবিতা -
সে সময়  ঈশ্বরগুপ্ত ব্যঙ্গাত্বক কবিতা লিখে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। লোকজন  কবিতাগুলোকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিল। এই ব্যঙ্গ কবিতাগুলোর মধ্য দিয়ে তাঁর সমাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, বাস্তব চিত্রাঙ্কনের ক্ষমতা, অসঙ্গতিগুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, মিশনারী, ইয়ংবেঙ্গল, মেয়েদের উগ্র আধুনিকতা ধারণ, বিধবাবিবাহের প্রচারক কেউ তাঁর কলমের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি। 

৫) ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশব ও পড়াশুনা-
পিতা হরিনারায়ণ দ্বিতীয় বিয়ে করলে এর পর থেকে কবি কলকাতার জোড়াসাঁকোতে মামার বাড়িতে বাস করতে শুরু করেন। ঈশ্বরচন্দ্র শৈশবে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়ার কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি, তবে অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র নিজ চেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত ও  ইংরেজি ভাষা শেখেন এবং বেদান্তদর্শনে পারদর্শিতা লাভ করেন।

৬) ঈশ্বরচন্দ্রের সংবাদ প্রভাকর-
সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের প্রেরণায় এবং বন্ধু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের আনুকূল্যে ১৮৩১ সালের ২৮ জানুয়ারি তিনি সাপ্তাহিক  সংবাদ প্রভাকর প্রকাশ করেন। আধুনিক বাংলার সমাজ গঠনে সংবাদ প্রভাকরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  অর্থসংকটের কারণে মাঝে চার বছর বন্ধ থাকার পর ১৮৩৬ সালের ১০ আগস্ট সপ্তাহে তিন সংখ্যা হিসেবে পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর সুযোগ্য সম্পাদনায় পত্রিকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে ১৮৩৯ সালের ১৪ জুন থেকে এটি দৈনিক পত্রে রূপান্তরিত হয়।

৭) কবি ঈশ্বরচন্দ্র ও বিধবাবিবাহ আন্দোলন-
প্রথম দিকে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করে এ বিষয়ে নানা ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করলেও পরে স্ত্রীশিক্ষার সমর্থন, ধর্মসভার বিরোধিতা, দেশের বৈজ্ঞানিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা এবং দরিদ্র জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে উদার মনোভাবের পরিচয় দেন। এমনকি তিনি অক্ষতযোনি বিধবার বিবাহেও আর আপত্তি করেননি।

৮) উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাসাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রথম বাঙালি কবি ও সাহিত্যিক-
ঈশ্বরচন্দ্রের স্মৃতিশক্তি ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত প্রখর ছিল। একবার যেটা শুনতেন  সেটা আর ভুলতেন না। কঠিন সংস্কৃত ভাষার দুর্বোধ্য শ্লোকসমূহের ব্যাখ্যা একবার শুনেই তাহ অবিকল কবিতায় রচনা করতে পারতেন। তিনি মুখে মুখে পদ্য রচনা করতেন। গ্রাম গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন এবং কবিগান বাঁধতেন। প্রায় বারো বৎসর গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে তিনি প্রাচীন কবিদের তথ্য সংগ্রহ করে জীবনী রচনা করেছেন। ঈশ্বর গুপ্ত অজস্র কবিতা রচনা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম ঈশ্বর গুপ্তের ‘কবিতা সংগ্রহ’ দীর্ঘ ভূমিকাসহ প্রকাশ করেন। তবে অশ্লীলতার কারণে সব কবিতা তিনি প্রকাশ করেন নি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত "গুপ্ত কবি" নামে সমধিক পরিচিত। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো তাঁর পরবর্তী সাহিত্যিকরা ঈশ্বর গুপ্তকে 'গুরু'পদে বরণ করেছিলেন। তাঁর ছদ্মনাম 'ভ্রমণকারী বন্ধু'।এছাড়া বহুবিধ পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা করে কবি-সাহিত্যিকদের উৎসাহ প্রদানের জন্য সমসাময়িককালে তিনি "কবিগুরু" হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছেন।

কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৫৯ সালের ২৩শে জানুয়ারি পরলোক গমণ করেন ।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।


No comments:

Post a Comment