30 April 2019

যেভাবে এলো শ্রমিকদের এই ঐতিহাসিক দিনটি।

দেশে বর্তমানে সপ্তদশ নির্বাচন পর্ব চলছে। ভোটের দিন রাজ্যগুলিতে ছুটি থাকছে। এর মধ্যে এসে গেল আর একটি ছুটির দিন। সেটা হল ১লা মে। ছুটি মানেই মজার দিন। কিন্তু এই দিনটির তাৎপর্য আমাদের ভুললে চলবে না।

এই দিনটি ঐতিহাসিক মে দিবস। শ্রমিকদের আত্মদানের দিবস। শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। দাবি ছিল দিনে ৮ ঘন্টা কাজ এবং  প্রাপ্য মজুরি। এই আন্দোলনের জন্য ১৮৬০ সালে শ্রমিকরা আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার নামে এক সংগঠন তৈরী করে। তাদের শ্লোগান ছিল সারা দিনে ৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা বিশ্রাম, আর ৮ ঘন্টা শুধু নিজের জন্য।

এই আন্দোলনের জন্য তাদের প্রাণও দিতে হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮৮৬ সালে। ১৮৮৪ সালে শ্রমিকদের দাবি ছিল ১লা মে, ১৮৮৬ সালের মধ্যে তাদের দাবি মেনে নিতে হবে। তাই ১লা মে যুক্তরাষ্ট্রের তিন লাখ শ্রমিক কাজ ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়লে আন্দোলন চরমে ওঠে। দুদিন পরে ৪ঠা মে, শ্রমিকরা সন্ধ্যের পর শিকাগোর হে-মার্কেট স্কয়ার নামে এক বাণিজ্যিক এলাকায় মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। পুলিশ এই শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করলে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। তাছাড়া ছজন শ্রমিককে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসি দেওয়া হয়।

শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের ‘দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ’-এর দাবী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। ১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী বছর থেকে ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’।

আজকের দিনে শ্রমিকদের অবস্থানটা অনেকটা পাল্টে গেছে। এখন তাদের ৮ ঘন্টার বেশী কাজ করতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে ন্যায্য মজুরিও জোটেনা। স্থায়ী শ্রমিকের বদলে অস্থায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ চলছে। সেখানে নেই কাজের কোন নিরাপত্তা। আজকের দিনে শ্রমিক আন্দোলনের রূপটাই বদলে গেছে।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

20 April 2019

১০০ বছর হয়ে গেল জালিয়ানওয়ালা বাগের বালক ও শিশু সহ নিরপারাধ নারী পুরুষদের উপর ব্রিটিশ শাসকদের নিশংস হত্যাকান্ড।


প্রবল রাষ্ট্রক্ষমতা অসহায় মানুষের উপআর অত্যাচার করলে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে - এই বার্তাটাই দিয়ে গেল জালিয়ানওয়ালাবাগ। শোনা কথা অনাথ কিশোর উধম সিংহ সেদিন আহত হয়ে সারা রাত পড়ে থাকার পর সকালে এক মুঠো রক্তাক্ত মাটি তুলে ফিরে এসে শপথ নিয়ে ছিল এই হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেবার। শুধু উধম সিংহ নয় সমগ্র ভারতবাসী শপথ নিল প্রতিশোধ নেবার। এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সারা দেশে এমনকি সারা বিশ্বে নিন্দা ও সমালোচনার বন্যা বয়ে গেল। গান্ধিজী তার ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লেখেন এই শয়তান সরকারের সংশোধন সম্ভব নয়, একে ধ্বংস করতেই হবে। কবিমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও চুপ থাকতে পারেন নি। গ্রেফতারের পরোয়ানা না করে তিনি চেয়েছিলেন অমৃতসরে গান্ধিজীর সাথে সভা করতে। কবি নিজের নাইটহুড প্রত্যাখ্যানের চিঠি লিখে  করে পাঠালেন বড়লাটের কাছে। নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।" আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে মানব দরদী ইংরেজ সাহেব দীনবন্ধু এন্ড্রুজ পাঞ্জাবে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু ইংরেজ সরকার তাঁকে পাঞ্জাবে যেতে দিল না। এটাই হল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজের শেষের শুরু।

১০০ বছর হয়ে গেল জালিয়ানওয়ালা বাগের বালক ও শিশু সহ নিরপারাধ নারী পুরুষদের উপর ব্রিটিশ শাসকদের নিশংস হত্যাকান্ড। ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ার জন্মেছিলেন এই পাঞ্জাবে ভারতের মাটিতেই। এই হত্যাকান্ডের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই।

১৯১৪ সালের জুলাই মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীও অংশ নিয়েছিলো। ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যুদ্ধে অংশ নিলে পরাধীন দেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। এই কথায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত  গান্ধিজী সহ অনেকেই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে যুদ্ধে ভারতবাসীকে উৎসাহিত করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ১ লক্ষ ভারতীয় সৈন্য মারা যায় তার মধ্যে অধিকাংশই ছিল পাঞ্জাবের।

পাঞ্জাবের দন্ডমুন্ডের কর্তা স্যর মাইকেল ও'ডোয়্যার ৬ বছর ধরে কড়া শাসনে বেঁধে রেখেছিল পঞ্চনদীর দেশকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নানা সুবিধার লোভ দেখিয়ে শুধু পাঞ্জাব থেকেই প্রায় ৫ লাখ পুরুষকে যুদ্ধে পাঠানো গিয়েছিল। ১৯১৭ সালের দিকে আর কেউ যুদ্ধে নাম লেখাতে চাইল না। শুরু হল অত্যাচার। মিলিটারিতে নাম লেখাতে শুরু হল জোর জবরদস্তি এবং শাস্তি। এই বছর হয় অতি বৃষ্টি, সাথে ম্যালেরিয়া আর প্লেগ মহামারি। এই সময় ব্রিটিশ সরকার দমন পীড়নের মাধ্যমে সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কন্ঠরোধ এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে সচেষ্ট হয়। এই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার বিচারপতি রাউলাটের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ‘সিডিশন কমিশন’ গঠন করে। ভারতীয়দের হিংসাত্মক আন্দোলন থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে কমিশন কতকগুলি সুপারিশ করে।

১৯১৮ সালের শেষের দিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। এই যুদ্ধে জার্মানি ইংল্যান্ড তথা মিত্রবাহিনীর হাতে পরাস্ত হয়। কিন্তু ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজ সরকারের নীতিতে কোন রকম পরিবর্তন দেখা যায়নি। যেসব সৈন্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদেরকে বেকার করে নিজেদের গ্রামে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।  ভারতবাসীর মনে সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে। এই সন্দেহ থেকেই ক্ষোভ এবং ইংরেজ বিরোধী মনোভাবের সূচনা ঘটে। এই বছর অনাবৃষ্টি,অর্থনৈতিক মন্দা এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিতে এক কোটির বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।

১৯১৯ সালের ১৮ই মার্চ  সিডিশন কমিশনের সুপারিশ সমূহের ওপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ সরকার এক দমনমূলক আইন চালু করে। এই আইনই সাধারণভাবে কুখ্যাত ‘রাউলাট আইন’ নামে পরিচিত। এই আইনে জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।
ভারতীয়দের জাতীয় স্বার্থবিরোধী এই আইনের বিরুদ্ধে চারিদিকে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় আইন সভার সমস্ত ভারতীয় সদস্য প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন । মদনমোহন মালাব্য, মহম্মদ আলি জিন্নাহ, মাজহার উল হক আইন পরিষদের সদস্য পদে ইস্তফা দেন। চরমপন্থীরা তো বটেই সুরেন্দ্রনাথ সহ সকল নরমপন্থী নেতা এর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। গান্ধিজী সর্বভারতীয় আন্দোলনের ডাক দেন।

১৯১৯ সালের মার্চ মাসে গান্ধিজীর ডাকে দেশব্যাপী বিক্ষোভ হরতাল হয় ও জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। গান্ধিজী সত্যাগ্রহের হুমকি দেন। কুখ্যাত রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে স্থানীয় কংগেস নেতা সইফুদ্দিন কিচলু ও সত্যপালের শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ এবং হিন্দু-মুসলমান- শিখের অভূতপূর্ব যোগদান ইংরেজ প্রশাসকদের খুবই চিন্তা ও অস্বস্তিতে ফেলেছিল। এই দুই নেতা রাওলাট-এর নামে সদ্য চালু হওয়া কালা কানুনের স্বরূপ পঞ্জাববাসীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছিলেন। এই দুই নেতার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করা হল কোনো জনসভায় ভাষণ না দেওয়ার।

এপ্রিল মাসে গান্ধিজী সত্যাগ্রহ তথা রক্তপতহীন আন্দোলনের মাধ্যমে এর রাওলাট আইনের প্রতিবাদের আয়োজন করেন। ৬ই এপ্রিল বিরাট এক জনসমাবেশে সইফুদ্দিন কিচলু ও সত্যপালের বিরুদ্ধে ফতোয়া প্রত্যাহারের দাবি ওঠে। পুরো অমৃতসর শহর স্তব্ধ করে হরতাল পালিত হয়।

৭ই এপ্রিল পাঞ্জাব যাওয়ার পথে গান্ধিজীকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে আহমেদাবাদের শিল্প শ্রমিক এবং পাঞ্জাবের সাধারণ জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সরকার গান্ধিজীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এর পরও বিক্ষোভ কমেনি। ধর্মঘটে এবং বিক্ষোভের লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় সরকারী দপ্তর এবং যানবাহন। সাদা চামড়ার ইউরোপীয় কর্মকর্তা এবং অধিবাসীদের উপরও ভারতীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তাদের উপরও আক্রমণ করা হয়। মোম্বাইতে জনতা পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়।
এপ্রিল মাসের গোড়ায় রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সভা, হরতাল, হিন্দু- মুসলমান সম্প্রীতির আবহ ব্রিটিশ শাসকদের ক্রমশই বিচলিত করে তুলছিল।  ৮ই এপ্রিল ডেপুটি কমিশনার আরভিং লেফটেনান্ট গভর্নর মাইকেল ও'ডোয়্যার কে চিঠি লিখে মেশিনগান, সাঁজোয়া গাড়ি আর বাড়তি সেনা চেয়ে নেন।

১০ই এপ্রিল ১৯১৯ সালে সইফুদ্দিন কিচলু ও সত্যপালকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় অজানা গন্তব্যে। এই খবর ছড়িয়ে পরার সাথে সাথে ক্ষুব্ধ জনতা পথে নামলেন। আগুন জ্বলল অমৃতসর শহরে। মানুষ নেতার মুক্তির দাবিতে হাঁটল শহরের ডেপুটি কমিশনারের সাথে দেখা করতে চেয়ে। মিলিটারি পিকেট তাদের পথ আটকায়। ব্যারিকেট ভেঙ্গে এগোনের চেস্টা করলে শুরু হয় গন্ডগোল। জনতার উপর গুলি চললে মারা যায় ২০-৩০ জন। এরপর জনতাকে আর আটকানো গেল না। তাদের একাংশ উন্মত্ত হয়ে আক্রমণ করল টাউন হল, দুটো বিদেশী ব্যাংক, টেলিগ্রাফ আর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। মারমুখী জনতার হাতে মারা গেল পাঁচজন সাহেব। অমৃতসর শহরে ১৩০ জন ইংরেজ নর-নারীকে সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি নেটিভদের শিক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে শহটাকে মিলিটারির হাতে তুলে দেওয়া হয়।

পরের দিন ১১ই এপ্রিল সকাল থেকেই অমৃতসরের মাথার উপর চক্কর মারছিল যুদ্ধ বিমান। রাস্তায় কারফিউ ও সেনা টহল। আগের দিনের ঘটনায় মৃতদের দেহ সতকারে নানা রকম নিষেধাজ্ঞা সহ চলল যথেচ্ছ ধরপাকড়। রাতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার অমৃতসরে পৌঁছে শহরের  দায়িত্ব নিলেন। সে দিন গভীর রাতে বিদ্যুৎহীন করে দেওয়া হল অমৃতসর শহরটাকে। জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হল।

১২ই এপ্রিল সকাল থেকেই অমৃতসরের মাথার যুদ্ধ বিমান নজর রাখছিল শহরের উপর। শহরের অলিগলিতে সেনা নামল। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার দুটি সাঁজোয়া গাড়ী নিয়ে বেরোলেন শহর পরিদর্শনে। বিনা অনুমতিতে শহরে প্রবেশ বা বার হওয়া নিষিদ্ধ। মিলিটারি পরাক্রম দেখিয়ে অমৃতসর শহর দখল হয়ে গেল। নোটিশ ঝুলিয়ে শহরের কিছু জায়গায় মিটিং- জমায়েত নিষিদ্ধ করা হল।

১৩ই এপ্রিল, ১৯১৯ সালের সেই অভিশপ্ত দিন। এদিন শহরের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি ঠিক করলেন বিকেলে একটা শান্তিপূর্ণ মিটিং করে কিচলু ও সত্যপালের মুক্তির দাবি তুলবেন। তার সাথে ১০ তারিখের অনভিপ্রেত ঘটনার পর সাধারণ মানুষের চরম হয়রানি ও যথেচ্ছ প্রেফতারের বিরুদ্ধেও কথা হবে। সেদিন ছিল বৈশাখী মেলা উৎসবও। স্বর্ণমন্দিরের কাছাকাছি একটি বাগান জালিয়ানওয়ালা বাগে মিটিং এর স্থান ঠিক হয়। সেখানে মিটিং নিষেধের কোনো নোটিশ ছিল না। চারিদিকে  পুলিশের পাহারা থাকলেও বাগান চত্বরে ঢোকার মুখে ভিড় আটকানোর চেষ্টা হয়নি। সেখানে জমা হয়েছিল প্রায় ১০ হাজার জনতা মিটিং শুরু হলে ডায়ার পরিকল্পনা করে ওই চত্বরে একমাত্র সরু যাতায়াতের গলির মুখে দুটো সাঁজোয়া গাড়ী লাগায়। রাস্তার দুধারে বসে গেল পুলিশ পিকেট। আকাশ পথে যুদ্ধ বিমান ঘটনা স্থল পরিদর্শন করে নিল। তার পরেই ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের নির্দেশে হাঁটু-গেড়ে বসা বালুচ ও গোর্খা সৈন্যরা শুরু করল গুলিবর্ষণ। বালক ও শিশু সহ নিরপারাধ নারী পুরুষদের উপর গুলি চলল ১৬০০ রাউন্ডের বেশী। বাগান থেকে বেরোনোর রাস্তা বন্ধ। প্রাণ বাঁচাতে বাগানের দেওয়াল টপকানোর অনেকে চেষ্টা করে। বাগানের মাঝখানে কুয়োতে অনেকে আবার ঝাঁপ দিয়ে গুলি এড়াতে চেয়েছিল। ১০ মিনিট ধরে চলে এই হত্যাকান্ড। সেদিন সরকারী হিসাবে মারা যায় ৩৭৯ জন এবং আহতের সংখ্যা ছিল ১২০০। কিন্তু বেসরকারী হিসাবে নিহতের সংখ্যা ১০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল এবং আহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী।
সন্ধ্যের পর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার ক্যাম্পে ফিরে বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরোলেন রাত আটটার পর শহরে টহল দিতে। দেখে নিতে কেউ বাগানের দিকে যাচ্ছে কিনা মৃত প্রিয়জনদের খোঁজে।

গোটা পঞ্জাব জুড়ে চালু হল সামরিক শাসন। চলল ২ মাস ধরে ধরপাকড় ও অসহ্য নির্যাতন সাথে হেনস্থা। এই হত্যাকান্ড ব্রিটিশ সরকার সম্বন্ধে ভারতীয়দের মোহভঙ্গ ঘটল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন রূপ সারা বিশ্বের কাছে উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিল। এর পরে গান্ধিজী দেশে বৃহত্তর গণ আন্দোলনের প্রস্তুতি নেন যার পরিণত রূপ ছিল অহিংসা আন্দোলন।

নারকীয় এই গণহত্যা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। সেই সময় এন্ড্রুজ সাহেব ছিলেন শান্তিনিকেতনে। নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্য তিনি পাঞ্জাব যাবার মনস্থির করেন। কিন্তু ইংরেজ সরকার মানব দরদী ইংরেজ সাহেব দীনবন্ধু এন্ড্রুজকে পাঞ্জাবে যেতে দিল না। এন্ড্রুজ যখন অমৃতসর রেল স্টেশনে পৌঁছান তখন তাঁকে আটক করে দিল্লিতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।  বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও এই হত্যাকান্ডে চুপ থাকতে পারেন নি। তিনি এন্ড্রুজকে গান্ধিজীর কাছে পাঠান যাতে তিনি এবং গান্ধিজী অমৃতসরে গিয়ে আর্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু গান্ধিজী সেই সময় অমৃতসরে গিয়ে সরকারকে বিব্রত করতে চান নি।
প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথ ৩০শে মে সারা রাত জেগে কবি নিজের নাইটহুড প্রত্যাখ্যানের চিঠি লিখে ৩১ মে ভোরবেলা তার করে পাঠালেন বড়লাটের কাছে। নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।" এই পত্রের প্রতিলিপি লন্ডনের শহরে বিলি হয়।

ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ বাড়তে থাকে। ১০২০ সালের মার্চ মাসে জেনারেল ডায়ারকে পদত্যাগ করিয়ে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভারত ও ইংল্যান্ডে ডায়ার খুবই নিন্দিত হয়েছিলেন। কিন্তু কিছু ব্রিটিশ শাসক দলের কাছে বীর সম্মান পান। ডায়ার পরে নিজে তার কাজের জন্য অনুশোচনা করতেন।
জীবনের শেষ দিন গুলি ডায়ারের ভালো কাটেনি। একের পর এক স্ট্রোকের  কারণে বেশ কিছুদিন  পক্ষাঘাত এবং বাকরোধে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী  ছিলেন। ১৯২৭ সালে ইংল্যান্ডের সমারসেট কাউন্ট্রিতে সেরিব্রাল হেমারেজে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুশয্যায় তবে তিনি বলেছিলেন -
"অমৃতসরের পরিস্থিতি যারা জানত তাদের অনেকেই বলেছেন আমি ঠিক করেছি ... আবার অনেকেই বলেছেন আমি ভুল করেছি। আমি মরে আমার সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে জানতে চাইব আমি ঠিক না বেঠিক"।

কথিত আছে জালিয়ানওয়ালা বাগের সভায় অনাথ কিশোর উধম সিংহ আহত হয়ে সারা রাত পড়ে থাকার পর সকালে এক মুঠো রক্তাক্ত মাটি তুলে ফিরে এসে শপথ নিয়ে ছিল এই হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেবার। একুশ বছর পর ১৯৪০ সালে এই শপথ আংশিক ভাবে পূরণ করেন। নাম পাল্টে আফ্রিকা, আমেরিকা ও ইউরোপ হয়ে তিনি লন্ডনে পৌঁছান। মাইকেল ও'ডোয়্যার লন্ডনের সভায় বক্তৃতা দেবার সময় উধম সিংহ সামনে থেকে তাকে গুলি করে হত্যা করে। দ্রুত বিচারের পর উধম সিংহের ফাঁসি হয়।  জালিয়ানওয়ালা বাগে তাঁর চিতাভষ্ম রাখা হয় এবং সেখানে তাঁর একটা মূর্তিও বসেছে।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

17 April 2019

আজ ১৭ই এপ্রিল, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ও শিক্ষক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে  বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ ৫ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮ সালে তামিলনাডুর তিরুট্টানিতে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অভাব সেই পরিবারের নিত্য সঙ্গী। তবুও বাবা মা চেয়েছিলেন ছেলেটিকে পড়াশুনা শিখিয়ে মানুষ করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই রাধাকৃষ্ণণের পড়াশুনার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। ওঁনার বাবা মা ছিলেন ঐতিহ্যগতভাবে ধর্ম বিশ্বাসী এবং পরিবারের সবাই হিন্দু ধর্মের রীতিনীতি নিষ্ঠার সাথে মেনে চলত।

যখন তাঁর বয়স ৮ তখন তিনি ভর্তি হন তিরুপতি শহরের লুথেরান মিশনারী বিদ্যালয়ে। মিশনারী পরিবেশে পড়াশুনা করার ফলে বাইবেল সম্বন্ধে তার আগ্রহ ছিল। জীবনে কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি। বিভিন্ন বৃত্তির মাধ্যমে তাঁর ছাত্রজীবন এগিয়ে চলে। ১৯০৫ সালে তিনি মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার বিষয় ছিল ‘বেদান্ত দর্শনের বিমূর্ত পূর্বকল্পনা’। ২১ বছর বয়সে এম এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

১৯০৯ সালে  মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এখানে অধ্যাপনা করেন ৯ বছর। সাথে চলত প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র দর্শন নিয়ে গর্বেষণা। ১৯২১ সালে বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রনে কলাকাতায় আসেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।  দেশ–বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বারবার অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন।

ছাত্রদের কাছে উনি ছিলেন খুব জনপ্রিয় এবং সব ছাত্ররাই তাঁকে তাদের পথ প্রদর্শক এবং ফিলোজফার হিসাবে মানত। ১৯২১ সালে মাইশোর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যখন কলকাতা বিশ্ববদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হন তখন ছাত্ররা ফুল দিয়ে সাজানো বাহনে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ও অধ্যাপক এই শান্ত মানুষটি ছাত্রজীবনে অতি মেধাবী ছিলেন।  বিশ্বের দরবারে তিনি অতি জনপ্রিয় দার্শনিক অধ্যাপক হিসাবেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৩১ সালে তাঁকে ব্রিটিশ নাইটহুডে সম্মানিত করা হয়। ১৯৫৪তে ভারতরত্ন উপাধি পান।

তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম রাজ্যসভার চেয়ারম্যান, উপরাষ্ট্রপতি (১৯৫২-১৯৬২) এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি (১৯৬২-৬৭) ছিলেন।

তিনি বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় লিখতেন। ১৯১৮ সালে তিনি লেখেন তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ দ্য ফিলোজফি অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর’। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘দ্য রেন অফ রিলিজিয়ন ইন কনটেমপোরারি ফিলোজফি’ প্রকাশিত হয় ১৯২০সালে।

শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাঁদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষক দিবস' পালিত হয়। এই দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালিত হয়ে থাকে। তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ৫ অক্টোবর তারিখে বিশ্ব শিক্ষক দিবস নামে পালিত হয়।  ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তাঁর জন্মদিন ৫ই সেপ্টেম্বরে ভারতে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালিত হয়।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

14 April 2019

আজ ১৪ই এপ্রিল ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেডকরের ১২৮তম জন্মবার্ষিকী আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেডকর ছিলেন ভারতীয় সংবিধান রচয়িতা, সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিবিদ, হরিজনবন্ধু, লেখক, বৌদ্ধধর্ম সংস্কারক, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের রূপকার। তিনি বাবাসাহেব  নামেও পরিচিত ছিলেন।

বোম্বের এলফিনস্টন হাই স্কুল, শিক্ষক একটি সমস্যা সমাধানের জন্য ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসা একজন ছাত্রকে ডাকলেন। ছাত্রটি  ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলে  মুহূর্তের মধ্যে  পুরো ক্লাসে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। অন্যান্য ছাত্ররা তাদের টিফিন বক্স রাখতো ব্ল্যাকবোর্ডের পেছনে। ছাত্রটি ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে আসার আগেই সবাই তাড়াহুড়ো করে নিজেদের টিফিন বক্স সরাতে লাগলো। কারণ ছাত্রটি কাছাকাছি আসলে যে, তাদের খাবার অপবিত্র হয়ে যাবে।

ছাত্রটির পরিবার দাপোলি থেকে সতরে চলে আসে। ছাত্রটি ক্লাসের ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেলেও বেঞ্চিতে বসতে পারতেন না। ক্লাসের এক কোনে নিজের নিয়ে আসা পাটের বস্তাটি বিছিয়ে বসে পড়তেন। দিনশেষে আবার সেটি নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে। কারণ স্কুল পরিষ্কার করা কর্মচারীও সেটি স্পর্শ করতেন না। স্কুলের ট্যাপ খুলে বা জগ থেকে তার জল খাবার অনুমতি ছিলো না। কারণ তাঁর ছোঁয়ায় এসব অপবিত্র হয়ে যাবে। কেবল যখন উচ্চ বর্ণের কেউ ট্যাপ খুলে দিত বা জগ থেকে জল ফেলত তখনই তার জল খাবার সুযোগ মিলত। এ ‘নিচু’ কাজটার দায়ভার সাধারণত স্কুলের পিয়নের কাঁধেই পড়তো। সে জগ থেকে জল ঢালত ছাত্রটির জন্য। অন্য কেউতো কাছেই ঘেঁষতো না তেমন। যেদিন পিয়ন থাকতো না, সেদিন তাকে তৃষ্ণার্ত হয়েই কাটাতে হতো।

কী প্রচণ্ড ঘৃণা! কেন? কারণ ছাত্রটি যে জন্মেছেন নিন্মবর্ণের পরিবারে। মহর পরিবারে জন্ম নেওয়া একজন দলিত তিনি। এতক্ষণ যে ছাত্রটির কথা বলেছি তার পুরো নাম ভীমরাও রামজি আম্বেডকর। দলিতরা যাকে ভালোবেসে ‘বাবা সাহেব’ বলে ডাকেন। পরবর্তীকালে যিনি হয়ে উঠেছিলেন তুখোড় অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক। তিনি হয়েছিলেন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী, ভারতীয় সংবিধানের মুখ্য স্থপতি। তবে সবচেয়ে আগে তার যে পরিচয়টি দেয়া দরকার তা হলো, বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ১৯৯০ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক উপাধি ‘ভারতরত্ন’-তে ভূষিত করা হয় তাকে।

ভীমরাও রামজি আম্বেডকর জন্মেছিলেন ১৮৯১ সালের ১৪ই এপ্রিল ভারতের মধ্যপ্রদেশের মোহ অঞ্চলে। রামজি মালোজি শাকপাল ও ভীমাবাই এর চতুর্দশ সন্তান ছিলেন তিনি। তার পূর্বপুরুষদের অধিকাংশই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। মূলত পিতার ইচ্ছাতেই তার স্কুলের পাঠ শুরু হয়। সেখানে দলিত হওয়ার কারণে তিনি শৈশবেই যে তীব্র বিদ্ধেষের মুখোমুখি হয়েছেন তা উপরের ঘটনাগুলো থেকে কিছুটা টের পাওয়া যায়।

এই বিদ্ধেষ শুধু মাত্র স্কুলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। স্কুলের বাইরেও এ হেনস্থা তাঁর পিছু ছাড়েনি। তারা যে পাড়ায় থাকতেন যেখানে অধিকাংশই উচ্চবর্ণের হিন্দু ছিল। সেখানে কোনো নাপিত তাদের চুল কেটে দিতো না, কোনো ধোপা তাদের কাপড় কেঁচে দিতো না। তার বড় বোনকেই তার ও তার ভাইদের চুল কেটে দিতে হতো।
তীব্র হতাশা থেকেই জন্ম হয় সমাজ সংস্কারকদের, বিপ্লবীদের। কেননা এ হতাশাই এনে দেয় সমাজ বদলানোর জিদ। যা ভি আর আম্বেডকরের মনেও তীব্রভাবে জেগেছিল। তিনি তার জীবনের মিশন হিসেবে নিয়েছিলেন বর্ণবৈষম্য দূরীকরণকে। দলিতদের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন গোটা ভারতে। তাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এক সুন্দর ভবিষ্যতের। আর এসব কারণেই তিনি দলিতদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ভালোবাসার ‘বাবা সাহেব’।

১৯০৩ সালে আম্বেডকর মাত্র ১২ বছর বয়সে হিন্দু রীতিতেই ৯ বৎসরের দাপোলির মেয়ে “রামাবাই”এর সাথে হয়। বিয়ের পর সপরিবারে তিনি মুম্বাইয়ে চলে আসেন। যেখানেই আম্বেডকর এলফিন্‌স্টোন রাস্তার পাশের সরকারি বিদ্যালয়ের প্রথম অস্পৃশ্য  ছাত্র হিসাবে ভর্তি হন।

ভীমরাও রামজি আম্বেডকর প্রথমে শিখধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হলেও শিখদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক টেকেনি। ১৪ই অক্টোবর ১৯৫৬ সালে তিনি নাগপুরে লক্ষ লক্ষ অনুগামীসহ তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।

আম্বেডকর ডায়াবেটিস রোগে শারীরিক অবনতির জন্য ১৯৫৪ সালে জুন থেকে প্রায় ৫-৬ মাস তিনি শয্যাগত ছিলেন ও তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারান। তিনি ৬ই ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে তাঁর দিল্লিতে বাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় চির নিদ্রায় শায়িত হন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

দূরদর্শী দার্শনিক- রাজনীতিক- সমাজতাত্ত্বিক রাহুল সাংকৃত্যায়নের ৫৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


রাহুল সাংকৃত্যায়ন শুধু পৃথিবী পরিব্রাজকই ছিলেন না, বিশ্বের জ্ঞানরাজ্যে পরিব্রাজনাতেও ছিলেন একান্ত নিষ্ঠাবান ও নিরলস। কথা সাহিত্যের আদলে লেখা তাঁর দুটি বই  'ভলগা সে গঙ্গা' ও 'মানব সমাজ' বহুল পঠিত। বহুভাষাবিদ রাহুল সাংকৃত্যায়ন লিখতেন মূলত হিন্দি ভাষায়। পাশাপাশি তিনি সংস্কৃত, পালি, তিব্বতি, ভোজপুরী ভাষাতেও লিখেছেন। কলকাতায় রাহুল সাংকৃত্যায়ন বেশ সমাদৃত। রাহুল সাংকৃত্যায়ন দীর্ঘ ৭০ বছরের জীবনের ৪৫ বছর ভ্রমণে কাটিয়েছেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর ৪৫ বছরের সঞ্চিত পরিব্রাজনজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়ে দেড়শো গ্রন্থের প্রণেতা। 

১৮৯৩ সালের ৯ এপ্রিল উত্তর প্রদেশের পন্দাহা ঝেরার আজমগড় গ্রামে রাহুল সাংকৃত্যায়নের জন্ম। তাঁর আসল নাম কেদারনাথ পান্ডে। তিনি নিজামাবাদের উর্দু মাদ্রাসায় পড়াশুনা শুরু করেন। সে সময় মাদ্রাসাগুলিই ছিল গ্রামাঞ্চলে শিক্ষালাভের একমাত্র স্থান। রাহুলের সমসাময়িক আরোও অনেকেই পড়েছেন এই উর্দু ইস্কুলগুলিতে। তার মধ্যে নাম করা যায় মুনশি প্রেমচন্দ্রের। সরকারী বৃত্তির আভাবে রাহুলের প্রথাগত শিক্ষা শেষ হল উর্দু মিডল স্কুলেই।

রাহুল যখন বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় এলেন তখন তাঁর বয়স ১০ বছর। কলকাতার রাস্তায় তিনি তখন জীবন, জ্ঞান আর এডভেঞ্চার খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে এহেন কোনো কাজ নেই যা তিনি করেননি।  জীবিকা নির্বাহের জন্য হয়েছেন ফেরিওয়ালা, রেলের হেল্পার, কখনও বা রাধুনি। কলকাতার পথের অভিজ্ঞতা তাঁকে একেবারে পালটে দেয়। এই শহরই তাঁকে রাজনীতি সচেতন করে তোলে, সজাগ করে রোজকার বেঁচে থাকার লড়াই নিয়েও। রাস্তার সাইনবোর্ড দেখে তিনি ইংরাজী পড়তে শিখলেন। আর এই সব অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝলেন তাঁর না দেখা নতুন যে জগৎ পড়ে আছে, তাকে জয় করতে পারবেন শুধু নিজের পড়াশুনা, শিক্ষার যোগ্যতা দিয়েই।

পড়াশুনার সুযোগ পেলেন বারনসীতে আর বিহারের ছাবড়ার কাছে পারসা মঠে। ১৯১৩ সালে ২০ বছর বয়সে এই মঠে তাঁর অন্তর্ভুত্তি হল 'উদাসী' সাধু রামোদার দাশ হিসাবে। পরবর্তীকালে বৌদ্ধভিক্ষু হয়ে রাহুল সাংকৃত্যায়ন নাম ধারণ করেন। বিশ্বসভায় এটি আজ একটি সুপরিচিত নাম। যাঁকে বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিব্রাজক বলে পশ্চিমা-রাশিয়ানরা শ্রদ্ধা করেন। 

পরে সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থাদি নিয়ে পড়াশুনা করবেন বলে দক্ষিণ ভারতের তিরুমিশির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সে যাত্রা অনেকটা পায়ে হেঁটে। মহাকাব্যিক এই যাত্রায় বুঝলেন, ভারত হল নিরবশেষ এক ভূখন্ডের নাম, যেখানে প্রতি চার ক্রোশ অন্তর মানুষের মুখের ভাষা পালটে যায়। আবার উত্তর ভারতের অযোধ্যায় তিনি আকৃষ্ট হলেন আর্য সমাজের প্রতি। এই সময়েই সংস্কৃত ন্যায় ও মীমাংসার পাঠের মাধ্যমে প্রবেশ করলেন ভারতীয় দর্শনের গভীরে।

এই সময় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছে। যে বিহারে একদিন তিনি সন্ন্যাসী রূপে কাজ করেছেন, সেই বিহারেই রাহুল কাজ শুরু করলেন কংগ্রেস কর্মী- প্রচারক হিসাবে। রাজনৈতিক সংযোগ ও কার্যকলাপের জেরে অচিরেই কারাবন্দী হলেন।

বন্দীদশায় পড়লেন বৌদ্ধযুগের ভারতে ফা-হিয়েন এর ভ্রমণবৃত্তান্ত, বর্মি লিপিতে লেখা পালি গ্রন্থ 'মজ্ঝমনিকায়'। পরবর্তীকালে ভারতে বৌদ্ধ পুনরুভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির মধ্যে প্রধান কাজ ছিল সংস্কৃত গ্রন্থগুলিতে উল্লিখিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি খুঁজে বার করা। এই গ্রন্থগুলি হারিয়ে গিয়েছিল, ভারতে এগুলির কোনো খোঁজ ছিলনা।
রাহুল জানতেন যখন বিহার ও বাংলা থেকে বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল কাবুলে, দক্ষিণ ভারতে তখন ভারতের লিখিত ইতিহাসে ১৫০০ বছরের একটা ছেদ আছে।

বৌদ্ধ দর্শনের মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন দীর্ঘকাল বৌদ্ধদর্শন দিয়ে গবেষণা ও চর্চা করেছেন। বৌদ্ধধর্মে বস্তুবাদের রূপরেখা দেখতে পেয়েছিলেন। বুদ্ধকে জানতে, তাঁর দর্শনকে জানতে রাহুল তিব্বতি লামার ছদ্মবেশে তিব্বতে হাজির হন- একবার নয়, চারবার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য ছাড়াই। সেখান থেকে গোপনে সংগ্রহ করে আনলেন অতি মূল্যবান বহু পুঁথি, পাণ্ডুলিপি, চিত্রপট ও বই। দেশ থেকে তিব্বতে চলে যাওয়া এইসব সম্পদ উদ্ধার করে এনেই থেমে থাকলেন না রাহুল। সে সব তিব্বতি ভাষা থেকে সংস্কৃতে অনুবাদ করেন।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন দর্শন নিয়ে দুই খন্ডে বিখ্যাত বই লিখেছিলেন। এই 'দর্শন- দিগদর্শন' বইটি  বিশেষ স্বতন্ত্র স্থান লাভ করেছে পাঠকমহলে। দর্শন-দিগদর্শনকে বলা হয় প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দর্শনের ইতিহাস। এতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন যুগের দর্শনের মূলভাবনাগুলো যেভাবে উঠে এসেছে, তেমনটি আর কোথাও উঠে আসেনি। বিখ্যাত দার্শনিক লেখক রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখা আসাধারণ অনূদিত বাংলা বই "বৌদ্ধ ধর্ম"। মুল বইটি হিন্দিতে লেখা অনুবাদ করেছেন মলয় চট্টোপাধ্যায়। বইটিতে সংক্ষেপে বৌদ্ধ ধর্মের দার্শনিক দিকগুলি ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

১৯৩৮ সালে তাঁর শেষ তিব্বত অভিযান থেকে ফেরার পর বিহারের কৃষকদের কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োগ করেন। তিনি 'অল ইন্ডিয়া কিসান সভা'র সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালে আবার কারাবন্দী হলেন।

১৯৪৩ সালে হাজারীবাগ কারাগারে বসেই কথা সাহিত্যের আদলে লিখেছিলেন 'ভলগা সে গঙ্গা'। এই বইটিতে তিনি ভলগা থেকে গঙ্গায় তিনি বিশ শতকের বিশের দশক পর্যন্ত মানব সমাজের ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। ভলগা থেকে আর্যরা কিভাবে ভারতে এসে পৌঁছায় তার ইতিদাস ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বইটি ২০টি ছোট গল্পে সংকলনে রচিত। ১৯৪৪ সালে বইটি হিন্দিতে প্রকাশিত হবার পরে তীব্র বিরোধিতার সন্মুখিন হয়। 'মানব সমাজ' গ্রন্থটিতে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পদ্ধতিগতভাবে অগ্রসরমাণ হতে পাঠকদের জন্য মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবসমাজের ইতিহাস বিবৃত করেন।

বার বার এই পরিবর্তনের ব্যাখ্যা রাহুল সাংকৃত্যায়ন  দিয়েছেন এভাবে—'আমি কোনো এক সময় বৈরাগী ছিলাম, পরে আর্যসমাজী হয়েছিলাম, বৌদ্ধ হই, আবার বুদ্ধের ওপর অপার শ্রদ্ধা রেখেও মার্কসের শিষ্য হই।' 

দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিকের রোগী রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৬১ সালে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। পরে তাঁকে চিকিৎসা করাতে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু শরীরের উন্নতি না হওয়ায় ১৯৬৩ সালের ২৩ মার্চ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ৫৬ বছর আগে ১৪ এপ্রিল এই মহামানবের দেহজ মৃত্যু হয়।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

13 April 2019

প্রফুল্ল কুমার সরকারের ৭৫ তম প্রয়াণ দিবসে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ

১৯২২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার জন্ম। এই পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী সুরেশচন্দ্র মজুমদার। প্রফুল্ল কুমার সরকার ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ১৩ই মার্চ, ১৯২২ সালে দোল পূর্ণিমার দিনে প্রথম লাল কালিতে চার পাতার সান্ধ্য আনন্দবাজার পত্রিকার ১০০০ কপি প্রকাশ হয়। আজ প্রতিদিন আনন্দবাজার পত্রিকার সংখ্যা ৭৬ লক্ষে ছাপিয়ে গেছে।

প্রফুল্ল কুমার সরকার স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৯২৩ সালে যতিন্দ্রনাথ মুখার্জীর প্রশংসা করে প্রবন্ধ লেখার অপরাধে তাঁকে প্রথম কারাবরণ করতে হয়। তারপর নির্ভীক সাংবাদিকতার জন্য তাঁকে বহুবার জেলে যেতে হয়। ওঁনার স্ত্রী নির্ঝরিনীও মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯৩০ সালে কারাবরণ করেন।

প্রফুল্ল কুমার সরকারের জন্ম ১৮৮৪ সালে।
ছেলের নাম অশোক কুমার সরকার এবং নাতি অভীক সরকার। তিনি ১৩ই এপ্রিল, ১৯৪৪ সালে পরলোকগমন করেন। ওঁনার ৭৫ তম প্রয়াণ দিবসে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

12 April 2019

বিস্মৃত প্রায় বাঙালি পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস গবেষণায় অনন্য পথিকৃৎ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৩৪তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ।

১৮৮৫ সালের ১২ই এপ্রিল প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের কালিমাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আর. ডি. ব্যানার্জি নামে সমধিক পরিচিত।

তার বাবার নাম মতিলাল ও মা কালিমতী। রাখালদাস বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ স্কুল ও কলেজ থেকে ১৯০০ সালে এনট্রান্স ও ১৯০৩ সালে এফএ পাস করেন। ১৯০৭ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক করেন এবং ১৯১০ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে এমএ করেন।

রাখালদাস ১৯১০ সালে কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সহকারী কর্মকর্তা এবং ১৯১১ সালে ভারতের  প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯১৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক তত্ত্বাবধায়ক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। কিন্তু ১৯২৬ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। এর পর ১৯২৮ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগ দেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদারো নগরীর আবিষ্কর্তা হিসেবে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যয় একটি অতি পরিচিত নাম। পশ্চিম অঞ্চলের প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে তিনি গ্রিক বিজয় স্তম্ভের সন্ধানে সিন্ধু অঞ্চলে গিয়েছিলেন এবং ঢিবির শীর্ষদেশে বৌদ্ধ বিহারের উৎখননকালে তিনি এমন কতগুলি নিদর্শনের সন্ধান পান যা তাঁকে হরপ্পায় সাহানী কর্তৃক প্রাপ্ত অনুরূপ নিদর্শনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ১৯২২ সালে তিনি মহেঞ্জোদারোর খননকার্য শুরু করেছিলেন। 
বাংলায় পাল রাজবংশ সম্পর্কিত বহু তথ্য তিনি আবিষ্কার করেন। পাহাড়পুরে খননকার্যের পরিচালক ছিলেন তিনি। মুদ্রাসম্বন্ধীয় বিষয়ে বাংলায় প্রথম গ্রন্থ রচনা তার অন্যতম কৃতিত্ব। তার উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের মধ্যে আরও রয়েছে দুই খণ্ডে বাঙ্গালার ইতিহাস, পাষাণের কথা, শশাঙ্ক ও ধর্মপাল।

মহেঞ্জোদাড়োর আবিষ্কারক রাখালদাসের মৃত্যু হয়েছিল ২৩শে মে, ১৯৩০ সালে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৫ বছর। স্বল্পকালীন জীবনে রাখালদাস কমপক্ষে ১৪টি এককগ্রন্থ ও পুস্তক, ৯টি উপন্যাস এবং বাংলা ও ইংরেজিতে তিনশরও বেশি প্রবন্ধ রচনা করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

08 April 2019

বাংলার পতঙ্গবিশারদ ও উদ্ভিদবিদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


পতঙ্গবিশারদ ও উদ্ভিদবিদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৯৮১ সালের ৮ই এপ্রিল কলকাতায় তাঁর বাসভবনে লোকান্তরিত হন। আজ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

যে যুগে কেউই মাতৃভাষায় নিজের গবেষণার তথ্য প্রকাশের কথা ভাবতেই পারতেন না, তখন গোপালবাবু তাঁর মাকড়সা, পিঁপড়ে এবং কয়েকটি বিশেষ শ্রেণীর কীট-পতঙ্গের আচরণ ও তাদের শারীরবৃত্তীয় ধর্মাবলী সম্পর্কে গবেষণার তথ্যাদি বাংলা ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি অতি সহজ সাবলীল বোধগম্য ভাষায় তাঁর প্রবন্ধগুলি লিখতেন। এজন্যে ছোটবড় সকল শ্রেণীর পাঠকের কাছে তাঁর লেখাগুলি খুবই সমাদৃত।

প্রকৃতিবিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের জন্ম ১৮৯৫ সালের ১লা আগস্ট বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার লনসি গ্রামে। গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের বয়স মাত্র ৫ বছর তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। সংসারের চাপে বাবার যজন-যাজন রক্ষার জন্য ৯ বছর বয়সেই উপনয়ন হয় গোপালচন্দের। পড়াশুনা ও যজমানি দুটো কাজ একই সঙ্গে চলতে থাকে। কষ্ট করে পড়াশোনা চালানোর পর, গোপালচন্দ ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফরিদপুর জেলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

জীববিদ্যা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব ইত্যাদি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার নানা বিষয়ে তিনি লিখেছেন, তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো তাঁর জীববিদ্যা সম্পর্কিত রচনাগুলি। এই লেখাগুলি যেমন কৌতূহলোদ্দীপক তেমনি আকর্ষণীয়। তিনি যে পঞ্চাশ বছরেরও অধিককাল মাতৃভাষায় বিজ্ঞানসাহিত্যের সেবা করে আসছেন, তাতে তাঁকে এ যুগের অন্যতম পথিকৃত বললে অত্যুক্তি হয় না।

নিজের গ্রামের এক উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতার চাকরি পেলেন। সেখানে ১৯১৫ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত ৪ বছর শিক্ষকতা করেন। স্কুলে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াতেন বনে-জঙ্গলে। নিবিষ্ট মনে লক্ষ্য করতেন কীটপতঙ্গের গতিবিধি। গাছপালা নিয়ে করতেন নানা ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা। অজানাকে জানার এই আগ্রহই তাকে বিজ্ঞান সাধনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। তাই তাকে বলা হয় স্বভাববিজ্ঞানী।

গোপালচন্দ্র প্রথমদিকে উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গাছের কাণ্ডের স্থায়িত্ব নিয়ে গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গবেষণাপত্র। এরপর নিয়মিতভাবে জৈব আলো এবং উদ্ভিদবিদ্যার ওপর বিভিন্ন নিবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। গোপালচন্দ্রের সাথে অদ্ভুতভাবে যোগাযোগ ঘটে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর। কৌতূহলবশত গোপালচন্দ্র জৈব আলোর বিকিরণ সম্বন্ধে গোপালচন্দ্র সেই সময়ের বিখ্যাত বাংলা মাসিক প্রবাসীতে লেখা পাঠান, যা অচিরেই জগদীশ চন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাসের সহায়তায় গোপালচন্দ্রকে ডেকে পাঠালেন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে। ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিজ্ঞানাচার্যের ডাকে সেখানে শুরু হলো গোপালচন্দ্রের গবেষণা। উদ্ভিদের রাহাজানি, গাছের আলো, শিকারি গাছের কথা, বাংলার গাছপালা  ইত্যাদি গোপালচন্দ্রের উদ্ভিদ সম্বন্ধে লেখা উল্লেখযোগ্য বই।

পরবর্তীকালে গোপালচন্দ্রের সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয় কীটপতঙ্গের গতিবিধির উপর। তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ। বিজ্ঞানের আকস্মিক আবিষ্কার, বিজ্ঞান অমনিবাস, পশুপাখি কীটপতঙ্গ, বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংবাদ ইত্যাদি বইগুলো তার আশ্চর্য গবেষণার সাক্ষ্য বহন করে।

গোপালচন্দ্র পরাধীন দেশের মুক্তিকামী বিপ্লবীদের প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি গুপ্ত সমিতির জন্য নানা বিস্ফোরক পদার্থের ফর্মূলা সরবরাহ করতেন এবং পরোক্ষভাবে নানা উপায়ে তাদের সাহায্য করতেন।
এছাড়াও তিনি গ্রামের অবহেলিত মানুষদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্থাপন করেছিলেন 'কমল কুটির'। বিনা বেতনে সেখানে লেখাপড়ার সাথে মেয়েদের শেখানো হতো হাতের কাজ। সামাজিক কুসংস্কার ও জাতপাতের বিরুদ্ধেও ছিলেন সবসময় প্রতিবাদমুখর।

তার ভাবনার জগতে শিশুরা অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল। ছোটদের মেধা আর মননকে শাণিত করবার জন্য বিভিন্ন স্বাদের গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। এগুলো আজও মূল্যবান আর প্রশংসনীয়। শিশুদের জন্য তিনি লিখেছেন এক মজার বই 'করে দেখ'। বাংলায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখায় দক্ষ তো ছিলেনই পাশাপাশি ইংরেজিতেও তিনি লিখেছেন বহু প্রবন্ধ। ২২টির মতো নিবন্ধ তার ইংরেজী বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ পায়।

তিনি দীর্ঘদিন অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে মাসিক বিজ্ঞান পত্রিকা ' জ্ঞান ও বিজ্ঞান '-এর সম্পাদনা করেছিলেন। বাংলার সেসময়ের স্বনামধন্য বিজ্ঞান লেখকেরা এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।

কাজের স্বীকৃতি অসাধারণ এই প্রকৃতিবিজ্ঞানী সম্মানিত হয়েছেন বহুবার। ১৯৭৪ সালে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু ফলক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তাকে দেওয়া হয় জাতীয় সংবর্ধনা। কীটপতঙ্গের জীবনযাত্রা সম্পর্কে লেখা তার বই ' বাংলার কীটপতঙ্গ ' ১৯৭৫ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করে। ১৯৭৯ সালে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের পক্ষ থেকে তাকে জুবিলি মেডেল প্রদান করা হয়। ১৯৮০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

আজ ৮ই এপ্রিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১২৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ - ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণে বঙ্কিমচন্দ্রই ছিলেন প্রথম এবং অগ্রগণ্য সাহিত্যিক। 

আজও আমরা সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে মনে রেখেছি, গ্রহণ করেছি তাঁর রচিত 'বন্দেমাতরম্' সংগীত যা ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসাবে স্বীকৃত। আজ ৮ই এপ্রিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১২৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৩৮ সালের ২৬ শে জুন, চব্বিশ পরগণা জেলার  নৈহাটির কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মেদিনীপুরের কলেক্টর। জন্মের পর ছয় বছর বঙ্কিমচন্দ্র কাঁটালপাড়াতেই অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়। শিশু বয়সেই তাঁর অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়।

তখনকার দিনে খুব অল্প বয়সেই ছেলেদের বিয়ে দেওয়া হত। সেই রেওয়াজ অনুযায়ী ১৮৪৯ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্রের বিয়ে হয় ৫ বছরের এক বালিকার সাথে। যশোরে চাকরিতে থাকাকালীন ১৮৫৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের স্ত্রী মারা যান। পরের বছর জুন মাসে হালি শহরের বিখ্যাত চৌধুরী বংশের কন্যা রাজলক্ষ্মী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। রাজলক্ষ্মী দেবী সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন- "আমার জীবন অবিশ্রান্ত সংগ্রামের জীবন। একজনের প্রভাব আমার জীবনে বড়ো বেশী রকমের- আমার পরিবার। আমার জীবনী লিখতে হলে তাঁর সম্পর্কেও জানা দরকার। তিনি না থাকলে আমি কী হতাম তা বলতে পারি না।"

১৮৫৩ সালটি বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনে একটি  স্বরণীয় বছর। তখন প্রভাকরে উত্তর-প্রত্যুত্তরে কবিতা লেখা যুবক লেখকদের একটা মহা উৎসাহের ব্যাপার ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র প্রথমে প্রভাকরে লিখে কাব্য রচনার অভ্যাস শুরু করেন। এই বছর প্রভাকর পত্রিকার কবিতা প্রতিযোগিতায় বঙ্কিমচন্দ্র অংশগ্রহণ করেন এবং পুরস্কার হিসাবে লাভ করেন ২০ টাকা। পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন সংবাদ প্রভাকরের কবিবর ঈশ্বরগুপ্তের সহায়তা না পেলে তিনি গদ্য-পদ্য রচনা প্রকাশ করতে পারতেন না।

১৮৫৭ সালে জানুয়ারী মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে পরের বছর ১৮৫৮ সালে প্রথমবারের মত বি.এ. পরীক্ষা নেওয়া হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পাশ করেছিলেন মাত্র দুজন- বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু। আইন পড়া শেষ হওয়ার আগেই যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কলেক্টরের চাকরি পান।

কাজের সূত্রে বঙ্কিমচন্দ্রকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হত। বহু মানুষের দুঃখ বেদনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছিলেন। এইসব বিষয়গুলিকে পাথেয় করে তিনি একের পর এক উপন্যাস রচনা করেছেন।

১৮৬৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস
দুর্গেশনন্দিনী মুদ্রিত ও প্রচারিত হয়। এই উপন্যাস সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শিবনাথ শাস্ত্রীর কথায় "দুর্গেশনন্দিনীতে আমরা যাহা দেখিলাম, তাহা অগ্রে কখনও দেখি নাই। এরূপ অদ্ভুত চিত্রণ শক্তি বাংলাতে কেহ অগ্রে দেখে নাই। দেখিয়া সকলে চমকিয়া উঠিল।"  তারপর লেখা হল 'কপালকুণ্ডলা'। যে তুলি 'দুর্গেশনন্দিনী'র নয়নানন্দকর কমনীয়তা তুলে ধরেছিল সেই তুলি 'কপালকুণ্ডলা'য় গাম্ভীর্য রসপূর্ণ ভাব সৃষ্টি করল।

স্বদেশবাসীদের মনে দেশপ্রেম জাগানোর উদ্দেশ্যে তিনি আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী এবং সীতারাম প্রকাশ করেন। আনন্দমঠ উপন্যাসে যে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সম্রাজ্ঞী বিদ্রোহের কথা তুলে ধরা ছিল সে যুগের বিপ্লবীদের কাছে তা ছিল 'গীতা'র মতো। আনন্দমঠ উপন্যাসে বন্দেমাতরম সংগীত দেশপ্রেমের শ্রেষ্ঠ গান রচনা হয়। স্বাধীনতা লাভের পর এই বন্দেমাতরম গণপরিষদে স্তোত্র হিসাবে গৃহিত হয়।

তাঁর বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল এবং রজনী আধুনিক পারিবারিক উপন্যাসের উৎসস্থল। মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও পরনারীর সাথে সম্পর্কের জটিলতা এগুলোতে পরিস্ফুট হয়েছে। ক্রমে প্রকাশিত হয় মৃণালিণী, ইন্দিরা, রাজসিংহ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। সীতারাম বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বশেষ উপন্যাস। এছাড়া কমলাকন্তের দপ্তর, ধর্মতত্ত্ব, রম্যরচনা; শ্রীমদভগবত গীতা ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করে তিনি অমর হয়ে আছেন। এই সব রচনা-উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্রেকে বাংলা সাহিত্যের শীর্ষস্থানে পৌঁছেদিল। হলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭২ সালে মাসিক পত্রিকা 'বঙ্গদর্শন' প্রকাশ হলে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার আর একটা দিক দেখা গেল।

দীর্ঘ ৩৩ বছর বঙ্কিমচন্দ্র সরকারী পদে বহাল থেকে ১৮৯১ সালে অবসর গ্রহণ করে চলে আসেন কলকাতার পটলডাঙায়। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তাঁর বহুমূত্র রোগ ধরা পরে এবং এই রোগের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ১৮৯৪ সালের ৮ই এপ্রিল  কলকাতায় বঙ্কিমচন্দ্র পরলোকগমণ করেন।

স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে - ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। 

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

03 April 2019

আজ ৩রা এপ্রিল বাংলার বিস্মৃতপ্রায় গর্ব জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

পুঁথিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি না থাকলেও শুধু নিজের আগ্রহ ও ইচ্ছা মানুষকে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তার উদাহরণ রাধাগোবিন্দ চন্দ্র। ১৯১০ সালে রাধাগোবিন্দ খালি চোখে হ্যালির ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করেন। তখন তিনি যেসব তথ্য উন্মোচন করেছিলেন তা 'প্রবাসী' মাসিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এর কিছুদিন পর রাধাগোবিন্দ 'ধূমকেতু' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি ধূমকেতু সম্পর্কে পৌরাণিক গল্পগুলোর আধুনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

রাধাগোবিন্দ চন্দ্র ১৬ই জুলাই ১৮৭৮ সালে যশোরের বাকচর গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা গোরাচাঁদ চন্দ্রের আদি নিবাস ছিল বর্ধমান জেলায়। পদ্মমুখীর সাথে বিয়ের পর তিনি শ্বশুর বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। রাধাগোবিন্দের মামা অভয়া চরণ দে ছিলেন একজন লেখক। রাধাগোবিন্দ প্রথমে গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পড়াশুনা শুরু করেন। পরে তিনি যশোর জেলা স্কুলে ভর্ত্তি হন। তবে প্রথাগত পড়াশোনায় মন না থাকায় তিনি তিন বারের চেষ্টাতেও দশম শ্রেণীর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি।

রাধাগোবিন্দের দিদিমা সারদা সুন্দরীর  আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের বিষয়ে খুব ভালো জ্ঞান ছিল। তিনি দৃশ্যমান উজ্জ্বল তারাগুলিকে সহজেই চিনতে পারতেন।
রাধাগোবিন্দ ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় 'ব্রহ্মাণ্ড কী প্রকাণ্ড' নামে একটি প্রবন্ধ পড়ে তাঁর মনে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে নানা রকম প্রশ্ন জাগে এবং তখন থেকেই তাঁর নক্ষত্রবিদ হবার প্রবল ইচ্ছা জাগে।

রাধাগোবিন্দ ১৮৯৯ সালে ২১ বছর বয়সে মুর্শিদাবাদের গোবিন্দমোহিনীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন গোবিন্দমোহিনীর বয়স ছিল ৯ বছর। তাদের দুটি সন্তান ছিল। রাধাগোবিন্দ এর দুই বছর পর যশোর কালেক্টরেট অফিসে খাজাঞ্চির চাকরি নেন।

যশোর জেলার আইনজীবী কালীনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁদের পারিবারিক বন্ধু। জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা ছিল তাঁর নেশা। আইনজীবী হলেও গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর তিনি বইও লিখতেন। সন্ধ্যের পর তার বাড়িতে বসত গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে আড্ডা। রাধাগোবিন্দ বাড়ি থেকে অফিস সাইকেলে যাতায়াত করতেন। তিনি অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের বড়িতে যেতেন এবং আগ্রহ নিয়ে তাদের আলোচনা শুনতেন। প্রথম প্রথম আলোচনায় তিনি তেমন পাত্তা পেতেন না। কিন্তু পরে রাধাগোবিন্দর উৎসাহ লক্ষ্য করে কালীনাথ বাবু তাকে প্রুফ রিডারের কাজ করান। বই প্রকাশ হবার পর রাধাগোবিন্দ সেই সব বই বাজার থেকে কিনতেন নিজের পড়ার জন্য। কালীনাথ বাবুর কাছ থেকে তিনি কম্পলিমেন্টারী কপি পেতেন না।

বকচরের একতলা বাড়ির ছাদে সন্ধ্যার পর পরই রাধাগোবিন্দ গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতেন। গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কিত বইপত্র হাতের কাছে না থাকায় প্রশ্নগুলো একই বৃত্তে ঘুরপাক খেত। কালীনাথ বাবু সংস্কৃতে  'ভোগোলা চরিতম' ও 'পপুলার হিন্দু অ্যাস্ট্রোনমি' নামে গ্রন্থ লিখেছিলেন। বইগুলো পড়ে রাধাগোবিন্দের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভ করেন। একসময় কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে একটি 'স্টার ম্যাপ' ধার নিয়ে নক্ষত্র অনুসন্ধান শুরু করেন।

শান্তিনিকেতনের বিজ্ঞান শিক্ষক জগদানন্দ রায় তাঁকে দূরবীন কেনার পরামর্শ দেন। সেই সময় সরকার কর্মচারীদের মাইনে বাড়িয়ে ছিল। মাইনের বর্ধিত এবং বকেয়া জমা টাকা দিয়ে রাধাগোবিন্দ ১৯১২ সালে তিন ইঞ্চি মাপের একটি দূরবিন কেনেন। ১৯১৮ সালের ৭ জুন তিনি নতুন নক্ষত্র আবিষ্কার করেন। নক্ষত্রটির নামকরণ হয় 'নোভা অ্যাকুইলা থ্রি ১৯১৮'। 

রাধাগোবিন্দের নোভা দর্শন সম্পর্কিত প্রবন্ধ জগদানন্দ রায়ের মাসিক পত্রিকা 'প্রবাসী'তে গুরুত্ব সহকারে ছাপা হত। 'হার্ভার্ড অবজারভেটরি'র পরিচালক এডওয়ার্ড চার্লস পিকারিংকে বিষয়টি লিখিতভাবে অবহিত করেন রাধাগোবিন্দ। তিনি নবগঠিত আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ভেরিয়েবল স্টার অবজারভার্সের (অ্যাভসো) সদস্য মনোনীত হন। অ্যাভসোর সদস্য হওয়ার পর তিনি 'ভেরিয়েবল স্টার' নিয়ে কোমর বেঁধে লেগে যান। অ্যাভসোর সদস্যরা তাঁকে একটি সাড়ে ছয় ইঞ্চি দূরবিন কিনে দেন। ১৯২৬ সালে দূরবিনটি হার্ভার্ড থেকে বকচরে পৌঁছায়। ভারতের প্রথম দূরবিন তৈরির কারখানা 'ধর ব্রাদার্স'-এর স্বত্বাধিকারী নগেন্দ্রনাথ দূরবিনটির পিতলের স্ট্যান্ড তৈরি করে দেন।

রাধাগোবিন্দে ১৯১৯ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ৩৭ হাজার ২১৫টি ভ্যারিয়েবল স্টার সম্পর্কে অ্যাভসোকে তথ্য সরবরাহ করেন। তারার আলো, দূরত্ব এবং ঔজ্জ্বল্য পরিবর্তনের কারণ ছাড়াও সৃষ্টি রহস্যের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন রাধাগোবিন্দের কাজের সূত্র ধরেই।

দেশ ভাগের পর রাধাগোবিন্দ ভারতে চলে আসেন। ভারতে আসার পর তিনি যথেষ্ট আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েন। অভাব অনটনে খাবারের সংস্থান করতেও তার সংগ্রাম করতে হতো। বারাসাতের দুর্গাপল্লীতে ১৯৭৫ সালের ৩রা এপ্রিল ৯৭ বছর বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময় তার প্রায় সমস্ত বইপত্র এবং তিন ইঞ্চির  দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি তিনি দান করে দিয়ে যান বারাসাতের সত্যভারতী বিদ্যাপীঠে।

কোনোরকম ডিগ্রি বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই তিনি যে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সাথে সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জ্যোতির্বিজ্ঞানে অসামান্য অবদান রেখেছেন এর জন্যে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।

অ্যাভসো ছাড়াও ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং ফ্র্যান্সের লিও অবজারভেটরির বিজ্ঞানীরাও রাধাগোবিন্দেকে বিভিন্নভাবে সম্মানিত করেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্র প্রথম বাঙালি যিনি ১৯২৮ সালে ফ্রান্স সরকার থেকে 'Officer D Academic Republique Francaise' সন্মান অর্জন করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।