03 April 2019

আজ ৩রা এপ্রিল বাংলার বিস্মৃতপ্রায় গর্ব জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

পুঁথিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি না থাকলেও শুধু নিজের আগ্রহ ও ইচ্ছা মানুষকে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তার উদাহরণ রাধাগোবিন্দ চন্দ্র। ১৯১০ সালে রাধাগোবিন্দ খালি চোখে হ্যালির ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করেন। তখন তিনি যেসব তথ্য উন্মোচন করেছিলেন তা 'প্রবাসী' মাসিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এর কিছুদিন পর রাধাগোবিন্দ 'ধূমকেতু' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি ধূমকেতু সম্পর্কে পৌরাণিক গল্পগুলোর আধুনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

রাধাগোবিন্দ চন্দ্র ১৬ই জুলাই ১৮৭৮ সালে যশোরের বাকচর গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা গোরাচাঁদ চন্দ্রের আদি নিবাস ছিল বর্ধমান জেলায়। পদ্মমুখীর সাথে বিয়ের পর তিনি শ্বশুর বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। রাধাগোবিন্দের মামা অভয়া চরণ দে ছিলেন একজন লেখক। রাধাগোবিন্দ প্রথমে গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পড়াশুনা শুরু করেন। পরে তিনি যশোর জেলা স্কুলে ভর্ত্তি হন। তবে প্রথাগত পড়াশোনায় মন না থাকায় তিনি তিন বারের চেষ্টাতেও দশম শ্রেণীর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি।

রাধাগোবিন্দের দিদিমা সারদা সুন্দরীর  আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের বিষয়ে খুব ভালো জ্ঞান ছিল। তিনি দৃশ্যমান উজ্জ্বল তারাগুলিকে সহজেই চিনতে পারতেন।
রাধাগোবিন্দ ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় 'ব্রহ্মাণ্ড কী প্রকাণ্ড' নামে একটি প্রবন্ধ পড়ে তাঁর মনে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে নানা রকম প্রশ্ন জাগে এবং তখন থেকেই তাঁর নক্ষত্রবিদ হবার প্রবল ইচ্ছা জাগে।

রাধাগোবিন্দ ১৮৯৯ সালে ২১ বছর বয়সে মুর্শিদাবাদের গোবিন্দমোহিনীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন গোবিন্দমোহিনীর বয়স ছিল ৯ বছর। তাদের দুটি সন্তান ছিল। রাধাগোবিন্দ এর দুই বছর পর যশোর কালেক্টরেট অফিসে খাজাঞ্চির চাকরি নেন।

যশোর জেলার আইনজীবী কালীনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁদের পারিবারিক বন্ধু। জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা ছিল তাঁর নেশা। আইনজীবী হলেও গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর তিনি বইও লিখতেন। সন্ধ্যের পর তার বাড়িতে বসত গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে আড্ডা। রাধাগোবিন্দ বাড়ি থেকে অফিস সাইকেলে যাতায়াত করতেন। তিনি অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের বড়িতে যেতেন এবং আগ্রহ নিয়ে তাদের আলোচনা শুনতেন। প্রথম প্রথম আলোচনায় তিনি তেমন পাত্তা পেতেন না। কিন্তু পরে রাধাগোবিন্দর উৎসাহ লক্ষ্য করে কালীনাথ বাবু তাকে প্রুফ রিডারের কাজ করান। বই প্রকাশ হবার পর রাধাগোবিন্দ সেই সব বই বাজার থেকে কিনতেন নিজের পড়ার জন্য। কালীনাথ বাবুর কাছ থেকে তিনি কম্পলিমেন্টারী কপি পেতেন না।

বকচরের একতলা বাড়ির ছাদে সন্ধ্যার পর পরই রাধাগোবিন্দ গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতেন। গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কিত বইপত্র হাতের কাছে না থাকায় প্রশ্নগুলো একই বৃত্তে ঘুরপাক খেত। কালীনাথ বাবু সংস্কৃতে  'ভোগোলা চরিতম' ও 'পপুলার হিন্দু অ্যাস্ট্রোনমি' নামে গ্রন্থ লিখেছিলেন। বইগুলো পড়ে রাধাগোবিন্দের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভ করেন। একসময় কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে একটি 'স্টার ম্যাপ' ধার নিয়ে নক্ষত্র অনুসন্ধান শুরু করেন।

শান্তিনিকেতনের বিজ্ঞান শিক্ষক জগদানন্দ রায় তাঁকে দূরবীন কেনার পরামর্শ দেন। সেই সময় সরকার কর্মচারীদের মাইনে বাড়িয়ে ছিল। মাইনের বর্ধিত এবং বকেয়া জমা টাকা দিয়ে রাধাগোবিন্দ ১৯১২ সালে তিন ইঞ্চি মাপের একটি দূরবিন কেনেন। ১৯১৮ সালের ৭ জুন তিনি নতুন নক্ষত্র আবিষ্কার করেন। নক্ষত্রটির নামকরণ হয় 'নোভা অ্যাকুইলা থ্রি ১৯১৮'। 

রাধাগোবিন্দের নোভা দর্শন সম্পর্কিত প্রবন্ধ জগদানন্দ রায়ের মাসিক পত্রিকা 'প্রবাসী'তে গুরুত্ব সহকারে ছাপা হত। 'হার্ভার্ড অবজারভেটরি'র পরিচালক এডওয়ার্ড চার্লস পিকারিংকে বিষয়টি লিখিতভাবে অবহিত করেন রাধাগোবিন্দ। তিনি নবগঠিত আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ভেরিয়েবল স্টার অবজারভার্সের (অ্যাভসো) সদস্য মনোনীত হন। অ্যাভসোর সদস্য হওয়ার পর তিনি 'ভেরিয়েবল স্টার' নিয়ে কোমর বেঁধে লেগে যান। অ্যাভসোর সদস্যরা তাঁকে একটি সাড়ে ছয় ইঞ্চি দূরবিন কিনে দেন। ১৯২৬ সালে দূরবিনটি হার্ভার্ড থেকে বকচরে পৌঁছায়। ভারতের প্রথম দূরবিন তৈরির কারখানা 'ধর ব্রাদার্স'-এর স্বত্বাধিকারী নগেন্দ্রনাথ দূরবিনটির পিতলের স্ট্যান্ড তৈরি করে দেন।

রাধাগোবিন্দে ১৯১৯ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ৩৭ হাজার ২১৫টি ভ্যারিয়েবল স্টার সম্পর্কে অ্যাভসোকে তথ্য সরবরাহ করেন। তারার আলো, দূরত্ব এবং ঔজ্জ্বল্য পরিবর্তনের কারণ ছাড়াও সৃষ্টি রহস্যের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন রাধাগোবিন্দের কাজের সূত্র ধরেই।

দেশ ভাগের পর রাধাগোবিন্দ ভারতে চলে আসেন। ভারতে আসার পর তিনি যথেষ্ট আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েন। অভাব অনটনে খাবারের সংস্থান করতেও তার সংগ্রাম করতে হতো। বারাসাতের দুর্গাপল্লীতে ১৯৭৫ সালের ৩রা এপ্রিল ৯৭ বছর বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময় তার প্রায় সমস্ত বইপত্র এবং তিন ইঞ্চির  দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি তিনি দান করে দিয়ে যান বারাসাতের সত্যভারতী বিদ্যাপীঠে।

কোনোরকম ডিগ্রি বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই তিনি যে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সাথে সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জ্যোতির্বিজ্ঞানে অসামান্য অবদান রেখেছেন এর জন্যে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।

অ্যাভসো ছাড়াও ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং ফ্র্যান্সের লিও অবজারভেটরির বিজ্ঞানীরাও রাধাগোবিন্দেকে বিভিন্নভাবে সম্মানিত করেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্র প্রথম বাঙালি যিনি ১৯২৮ সালে ফ্রান্স সরকার থেকে 'Officer D Academic Republique Francaise' সন্মান অর্জন করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

No comments:

Post a Comment