14 April 2019

দূরদর্শী দার্শনিক- রাজনীতিক- সমাজতাত্ত্বিক রাহুল সাংকৃত্যায়নের ৫৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


রাহুল সাংকৃত্যায়ন শুধু পৃথিবী পরিব্রাজকই ছিলেন না, বিশ্বের জ্ঞানরাজ্যে পরিব্রাজনাতেও ছিলেন একান্ত নিষ্ঠাবান ও নিরলস। কথা সাহিত্যের আদলে লেখা তাঁর দুটি বই  'ভলগা সে গঙ্গা' ও 'মানব সমাজ' বহুল পঠিত। বহুভাষাবিদ রাহুল সাংকৃত্যায়ন লিখতেন মূলত হিন্দি ভাষায়। পাশাপাশি তিনি সংস্কৃত, পালি, তিব্বতি, ভোজপুরী ভাষাতেও লিখেছেন। কলকাতায় রাহুল সাংকৃত্যায়ন বেশ সমাদৃত। রাহুল সাংকৃত্যায়ন দীর্ঘ ৭০ বছরের জীবনের ৪৫ বছর ভ্রমণে কাটিয়েছেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর ৪৫ বছরের সঞ্চিত পরিব্রাজনজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়ে দেড়শো গ্রন্থের প্রণেতা। 

১৮৯৩ সালের ৯ এপ্রিল উত্তর প্রদেশের পন্দাহা ঝেরার আজমগড় গ্রামে রাহুল সাংকৃত্যায়নের জন্ম। তাঁর আসল নাম কেদারনাথ পান্ডে। তিনি নিজামাবাদের উর্দু মাদ্রাসায় পড়াশুনা শুরু করেন। সে সময় মাদ্রাসাগুলিই ছিল গ্রামাঞ্চলে শিক্ষালাভের একমাত্র স্থান। রাহুলের সমসাময়িক আরোও অনেকেই পড়েছেন এই উর্দু ইস্কুলগুলিতে। তার মধ্যে নাম করা যায় মুনশি প্রেমচন্দ্রের। সরকারী বৃত্তির আভাবে রাহুলের প্রথাগত শিক্ষা শেষ হল উর্দু মিডল স্কুলেই।

রাহুল যখন বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় এলেন তখন তাঁর বয়স ১০ বছর। কলকাতার রাস্তায় তিনি তখন জীবন, জ্ঞান আর এডভেঞ্চার খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে এহেন কোনো কাজ নেই যা তিনি করেননি।  জীবিকা নির্বাহের জন্য হয়েছেন ফেরিওয়ালা, রেলের হেল্পার, কখনও বা রাধুনি। কলকাতার পথের অভিজ্ঞতা তাঁকে একেবারে পালটে দেয়। এই শহরই তাঁকে রাজনীতি সচেতন করে তোলে, সজাগ করে রোজকার বেঁচে থাকার লড়াই নিয়েও। রাস্তার সাইনবোর্ড দেখে তিনি ইংরাজী পড়তে শিখলেন। আর এই সব অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝলেন তাঁর না দেখা নতুন যে জগৎ পড়ে আছে, তাকে জয় করতে পারবেন শুধু নিজের পড়াশুনা, শিক্ষার যোগ্যতা দিয়েই।

পড়াশুনার সুযোগ পেলেন বারনসীতে আর বিহারের ছাবড়ার কাছে পারসা মঠে। ১৯১৩ সালে ২০ বছর বয়সে এই মঠে তাঁর অন্তর্ভুত্তি হল 'উদাসী' সাধু রামোদার দাশ হিসাবে। পরবর্তীকালে বৌদ্ধভিক্ষু হয়ে রাহুল সাংকৃত্যায়ন নাম ধারণ করেন। বিশ্বসভায় এটি আজ একটি সুপরিচিত নাম। যাঁকে বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিব্রাজক বলে পশ্চিমা-রাশিয়ানরা শ্রদ্ধা করেন। 

পরে সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থাদি নিয়ে পড়াশুনা করবেন বলে দক্ষিণ ভারতের তিরুমিশির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সে যাত্রা অনেকটা পায়ে হেঁটে। মহাকাব্যিক এই যাত্রায় বুঝলেন, ভারত হল নিরবশেষ এক ভূখন্ডের নাম, যেখানে প্রতি চার ক্রোশ অন্তর মানুষের মুখের ভাষা পালটে যায়। আবার উত্তর ভারতের অযোধ্যায় তিনি আকৃষ্ট হলেন আর্য সমাজের প্রতি। এই সময়েই সংস্কৃত ন্যায় ও মীমাংসার পাঠের মাধ্যমে প্রবেশ করলেন ভারতীয় দর্শনের গভীরে।

এই সময় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছে। যে বিহারে একদিন তিনি সন্ন্যাসী রূপে কাজ করেছেন, সেই বিহারেই রাহুল কাজ শুরু করলেন কংগ্রেস কর্মী- প্রচারক হিসাবে। রাজনৈতিক সংযোগ ও কার্যকলাপের জেরে অচিরেই কারাবন্দী হলেন।

বন্দীদশায় পড়লেন বৌদ্ধযুগের ভারতে ফা-হিয়েন এর ভ্রমণবৃত্তান্ত, বর্মি লিপিতে লেখা পালি গ্রন্থ 'মজ্ঝমনিকায়'। পরবর্তীকালে ভারতে বৌদ্ধ পুনরুভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির মধ্যে প্রধান কাজ ছিল সংস্কৃত গ্রন্থগুলিতে উল্লিখিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি খুঁজে বার করা। এই গ্রন্থগুলি হারিয়ে গিয়েছিল, ভারতে এগুলির কোনো খোঁজ ছিলনা।
রাহুল জানতেন যখন বিহার ও বাংলা থেকে বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল কাবুলে, দক্ষিণ ভারতে তখন ভারতের লিখিত ইতিহাসে ১৫০০ বছরের একটা ছেদ আছে।

বৌদ্ধ দর্শনের মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন দীর্ঘকাল বৌদ্ধদর্শন দিয়ে গবেষণা ও চর্চা করেছেন। বৌদ্ধধর্মে বস্তুবাদের রূপরেখা দেখতে পেয়েছিলেন। বুদ্ধকে জানতে, তাঁর দর্শনকে জানতে রাহুল তিব্বতি লামার ছদ্মবেশে তিব্বতে হাজির হন- একবার নয়, চারবার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য ছাড়াই। সেখান থেকে গোপনে সংগ্রহ করে আনলেন অতি মূল্যবান বহু পুঁথি, পাণ্ডুলিপি, চিত্রপট ও বই। দেশ থেকে তিব্বতে চলে যাওয়া এইসব সম্পদ উদ্ধার করে এনেই থেমে থাকলেন না রাহুল। সে সব তিব্বতি ভাষা থেকে সংস্কৃতে অনুবাদ করেন।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন দর্শন নিয়ে দুই খন্ডে বিখ্যাত বই লিখেছিলেন। এই 'দর্শন- দিগদর্শন' বইটি  বিশেষ স্বতন্ত্র স্থান লাভ করেছে পাঠকমহলে। দর্শন-দিগদর্শনকে বলা হয় প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দর্শনের ইতিহাস। এতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন যুগের দর্শনের মূলভাবনাগুলো যেভাবে উঠে এসেছে, তেমনটি আর কোথাও উঠে আসেনি। বিখ্যাত দার্শনিক লেখক রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখা আসাধারণ অনূদিত বাংলা বই "বৌদ্ধ ধর্ম"। মুল বইটি হিন্দিতে লেখা অনুবাদ করেছেন মলয় চট্টোপাধ্যায়। বইটিতে সংক্ষেপে বৌদ্ধ ধর্মের দার্শনিক দিকগুলি ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

১৯৩৮ সালে তাঁর শেষ তিব্বত অভিযান থেকে ফেরার পর বিহারের কৃষকদের কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োগ করেন। তিনি 'অল ইন্ডিয়া কিসান সভা'র সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালে আবার কারাবন্দী হলেন।

১৯৪৩ সালে হাজারীবাগ কারাগারে বসেই কথা সাহিত্যের আদলে লিখেছিলেন 'ভলগা সে গঙ্গা'। এই বইটিতে তিনি ভলগা থেকে গঙ্গায় তিনি বিশ শতকের বিশের দশক পর্যন্ত মানব সমাজের ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। ভলগা থেকে আর্যরা কিভাবে ভারতে এসে পৌঁছায় তার ইতিদাস ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বইটি ২০টি ছোট গল্পে সংকলনে রচিত। ১৯৪৪ সালে বইটি হিন্দিতে প্রকাশিত হবার পরে তীব্র বিরোধিতার সন্মুখিন হয়। 'মানব সমাজ' গ্রন্থটিতে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পদ্ধতিগতভাবে অগ্রসরমাণ হতে পাঠকদের জন্য মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবসমাজের ইতিহাস বিবৃত করেন।

বার বার এই পরিবর্তনের ব্যাখ্যা রাহুল সাংকৃত্যায়ন  দিয়েছেন এভাবে—'আমি কোনো এক সময় বৈরাগী ছিলাম, পরে আর্যসমাজী হয়েছিলাম, বৌদ্ধ হই, আবার বুদ্ধের ওপর অপার শ্রদ্ধা রেখেও মার্কসের শিষ্য হই।' 

দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিকের রোগী রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৬১ সালে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। পরে তাঁকে চিকিৎসা করাতে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু শরীরের উন্নতি না হওয়ায় ১৯৬৩ সালের ২৩ মার্চ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ৫৬ বছর আগে ১৪ এপ্রিল এই মহামানবের দেহজ মৃত্যু হয়।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

No comments:

Post a Comment