22 March 2019

ভারতের বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্য সেনের ১২৫তম জন্ম বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে মাষ্টারদা সূর্য সেনের নাম ভারতবাসীরা চিরদিন মনে রাখবে। ব্রিটিশ ভারতের এই বিপ্লবী ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন-সহ অনেক  বিপ্লবের কান্ডারী ছিলেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বেই কিছুকালের জন্য বাংলার এক নিভৃত স্থানে বাঙালির স্বাধীনতার পতাকা উড়েছিল। পুরো নাম সূর্যকুমার সেন। তবে মাষ্টারদা নামে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। ওঁনার স্মরণে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারের পাশ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটির নাম হয়েছে সূর্য সেন স্ট্রীট। তাছাড়া বাঁশদ্রোনী এলাকার মেট্রো স্টেশনের নাম হয়েছে মাস্টারদা সূর্য সেন। 
মাস্টারদা সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২শে মার্চে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নোওয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বহরমপুর কলেজে পড়ার সময় তিনি বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। চট্টগ্রামে ফিরে তিনি গণিতের শিক্ষক হিসেবে ওরিয়েন্টাল স্কুলে শিক্ষকতা গ্রহণ করেন এবং সেখানে ছাত্রসমাজ ও যুবসমাজের মধ্যে বিপ্লবী অন্দোলনের প্রচারের মাধ্যমে শক্তিশালী বিপ্লবী সংগঠন তৈরী করেন। সকলের প্রতি তাঁর দরদ ছিল অপরিসীম এবং খুব শীঘ্রই তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠে মাস্টারদা নামে পরিচিতি হন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ১৯২১ সালে  গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অহিংস আন্দোলন এক বৎসরের ভিতর ভারতের স্বারজ আনতে ব্যর্থ হলে, বিপ্লবীরা আবার সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেন।  
১৯২৩ সালে ২৪ই ডিসেম্বর চট্টগ্রাম শহরে একপ্রান্তে  পাহাড়ী এলাকায় পুলিশের সাথে খন্ডযুদ্ধে  মৃতপ্রায় মাস্টারদা ও অম্বিকা চক্রবর্তী পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। পরে পুলিশ হাসপাতালে তাঁদের চিকিৎসা করার পর তাঁরা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডাকাতির মামলা রুজু করেছিল হয়েছিল। যতীন্দ্র মোহন এই মামলা পরিচালিত করেন এবং প্রায় ৯ মাস কারাবন্দি থাকার পর প্রমাণাভাবে তাঁরা মামলা থেকে তাঁরা খালাস পান।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় একটি অস্ত্রলুটের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় মাস্টারদার নাম শোনা যায়। বিপ্লব আন্দোলন সংগঠিত করতে পুলিশের চোখ এড়িয়ে তাঁকে প্রায়ই কলকাতায় এসে শোভাবাজারে বিপ্লবীদের আস্তানায় উঠতেন। ১৯২৫ সালের ১০ই নভেম্বর সেখানে পুলিশ হানা দেয়। পুলিশ শোভাবাজারে মাস্টারদাকে ধরতে গেলে তিনি গামছা পরে চাকরের বেশে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান। 
এর প্রায় একবছর পর ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক মেস থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় 'মুরারিপুকুর ষড়যন্ত্র মামলা'। এ মামলায় ১৯২৮ সাল পর্যন্ত  তাঁকে মেদিনীপুর প্রেসিডেন্সি জেল, পুনার রায়েরোড়া জেল ও বম্বের রত্নগিরি জেলে কারাবাস করতে হয়।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে ফিরে এসে তিনি চট্টগ্রামের বিপ্লবী সংগঠনে তাঁদের গোপন বৈঠকে চূড়ান্ত সংগ্রামের এক পরিকল্পনা করেন। মাস্টারদা স্বীয় কর্মপন্থাকে কার্যকরী করার জন্য ছক তৈরী করে ফেলেন। এর চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল গুডফ্রাইদের দিনে যখন ইংরেজরা বিভিন্ন আনন্দ উৎসবে মত্ত থাকে। মোট ৬৫ জন বিপ্লবী যোদ্ধা নিয়ে পাঁচ প্রকার কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন। ১) পুলিশ ঘাঁটি দখল করে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া ২) চট্টগামের সৈন্যবাহিনীর অস্ত্রাগার ঘাঁটি ধ্বংস করে অস্ত্র লুট করা ৩) কলকাতা ও ঢাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা ৪) চট্টগ্রামের সাথে  রেল ও টেলিগ্রাফ সংযোগ বন্ধ করা ৫) ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলো আক্রমণ করে ইংরেজদের বন্দি করা। সিন্ধান্ত অনুযায়ী কাজও চলল। রাত ১০টা নাগাদ চট্টগাম অস্ত্রাগারে বেশ কিছুক্ষণ খন্ডযুদ্ধ চলে এবং অস্ত্র লুট করে গাড়ী বোঝাই করে বিপ্লবীরা পুলিশ ব্যারাক ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আক্রমণ চালায়। এই অতর্কিত আক্রমণে মোট ১১ জন পুলিশ নিহত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে সব বিপ্লবীরা পুলিশ ব্যারাকে সমবেত হন। মাস্টারদাকে অধিনায়ক করে এক অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয় যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। 
এই সময় শহরের অপর প্রান্ত থেকে কিছু ব্রিটিশ সৈন্য বিভ্রান্তি অবস্থার মধ্য থেকেও ডবল মুরিং জেটিতে রক্ষিত স্বয়ংক্রিয় ম্যাশিনগান থেকে গুলি বর্ষণ শুরু করেছিল। বিপ্লবীরা জানতো স্বয়ংক্রিয় ম্যাশিনগানের বিরুদ্ধে তাঁরা যুদ্ধে পারবেন না। এই আক্রমণের সময় রাত্রের অন্ধকারে অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ, আনন্দগুপ্ত, জীবন ঘোষাল মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। বাকি সদস্যদের নিয়ে  মাস্টারদা সূর্যসেন  পাহাড়ে আশ্রয় নিল। ২২শে ‌এপ্রিল বিকালে  বৃটিশ বাহিনী জালালাবাদ পাহাড়ে অভিযান শুরু করে। ব্রিটিশ সৈন্যরা পাহাড় বেয়ে উঠ আসার সময় বিপ্লবীরা আক্রমণ চালায়। জালালাবাদ যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন ১৪ বৎসর বয়সী টেগরা বল। এরপর আগে পরে একে একে বিপ্লবীরা যুদ্ধে প্রাণ হারাতে থাকেন। এই দিনের যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী জালালাবাদ পাহাড় দখল করতে পারেনি। বিপ্লবীদের নিয়ে  মাস্টারদা সূর্যসেন রাতের অন্ধকারে জালালাবাদ পাহাড় ত্যাগ করেন। 
মাস্টারদা কোয়েপাড়ার বিনয় সেনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এই সময় তাঁর সাথে ছিল অপর বিপ্লবী নির্মল সেন।মাস্টারদা সূর্য সেনের দলের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু সূর্যসেন ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলেন। এই সময় তাঁর গ্রেফতারের জন্য পুরস্কার ঘোষণাও করা হয়েছিল। এরই ভিতরে ১৩ জুন পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে বিপ্লবীরা মিলিত হন। এই বাড়িতে তখন ছিলেন সূর্যসেন, নির্মল সেন,  প্রীতিলতা এবং অপূর্ব সেন। সেখানে আচম্বিতে গুর্খা সৈন্য নিয়ে হানা দেয় ক্যাপ্টেন ক্যামেরন। যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন নিহত হয়। পরে প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেনকে নিয়ে মাস্টারদা সন্তর্পণে এই বাড়ি ত্যাগ করেন। এই সময় সৈন্যদের গুলিতে অপূর্ব সেন মৃত্যবরণ করেন।    
এরপর  মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন। এ অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হল প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে আক্রমণ করা হল ইউরোপীয়ান ক্লাব। সফল আক্রমণ শেষে ফেরার পথে এক ইংরেজ অফিসারের গুলিতে প্রীতিলতা আহত হলেন। ধরা না দেবার প্রত্যয়ে সঙ্গে রাখা সায়ানাইড বিষ পান করে তিনি আত্মাহুতি দিলেন। ভারতের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম নারী শহীদের নাম প্রীতিলতা।
মাস্টারদা সূর্য সেন ১৯৩৩ সালে ২রা ফেব্রুয়ারি গৈরালা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই সময় ইংরেজ সরকার তাঁর মাথার দাম ধার্য করেছিল দশ হাজার টাকা। মাস্টারদা সূর্য সেনের গোপন অবস্থানের কথা জানতে পেরে ক্যাপ্টেন ওয়ামস্‌লীর নেতৃত্বে একদল গুর্খা সৈন্য মাস্টারদাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। 
বিচারে মাস্টারদার ফাঁসির আদেশ হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্য রাতে  ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দেন বাংলার বীর বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন।  
প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

No comments:

Post a Comment