15 March 2019

স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক,কবি, ছড়াকার, ভ্রমণকাহিনী রচয়িতা এবং চিন্তাবিদ অন্নদাশঙ্কর রায়ের ১১৫তম জন্ম বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ছোটবেলাকার অনেক ছড়ার গান এখনও মনে গুন গুন করে বা শুনলে মনে পড়ে যায়। সেই সব জনপ্রিয় অনেক ছড়ার গানের রচয়িতা অন্নদাশঙ্কর রায় ১৯০৪ সালের ১৫ই মার্চ উড়িষ্যার ঢেঙ্কানালে এক শাক্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁদের আদি বাড়ী পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়।পিতা নিমাইচরণ রায় বিয়ে করেন পালিত পরিবারের মেয়ে হেমনলিনীকে যিনি বৈষ্ণব ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু একই পরিবারে শাক্ত ও বৈষ্ণব বিশ্বাসের কখনও সংঘাত ঘটেনি। অন্নদাশঙ্করের পূর্বপুরুষ রামচন্দ্র ঘোষ সুবে উড়িষ্যায় জরিপ করতে গেলে  বাদশাহ জাহাঙ্গীর তাঁকে একটা লাখেরাজ তালুক ও খান উপাদি দেন। সেই সময় থেকেই কর্মসূত্রে তাঁরা বসবাস শুরু করেন ওড়িষ্যার ঢেঙ্কানালে। মোঘল আমলেই খান পদবির সাথে জুড়ে যায় রায় চৌধুরী পদবি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে যায় রায় পদবি।তাঁদের পরিবারে সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিবেশ ছিল এবং তা নিয়মিত চর্চাও হতো।

শিক্ষাজীবন-
অন্নদাশঙ্করের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ঢেঙ্কানালের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে  পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইএ পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। মাত্র দশ বারো বয়সেই আয়ত্ব করে ফেলেন কৃতিবাসের রামায়ণ, কাশীরাম দাশের মহাভারত, কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল, বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাশের পাদাবলী। ছাত্রজীবনেই তিনি চার্লশ ডিকেন্স, বার্নার্ড শ, ইসবেন, টলস্টয় প্রমুখ লেখকের বই পড়ে তিনি ইউরোপীর সাহিত্য, সমাজ ও দেশ সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী হন।তিনি সরকারি খরচে আই.সি.এস হতে ইংল্যান্ড যান।

প্রেম ও বিবাহ-
১৯৩০ সালে মার্কিন বিদুষী তরুণী অ্যালিস ভার্জিনিয়া ওর্নডর্ফ ভারতে আসেন ভারতীয় সঙ্গীত বিষয়ে গবেষণার জন্য। কলকাতায় অ্যালিসের সঙ্গে পরিচয় হয় অন্নদাশঙ্করের। পরিচয় থেকে প্রণয় এবং পরিণয়ে আবদ্ধ হন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ বিয়ের পর অ্যালিসের নতুন নাম দেন ‘লীলা রায়’। সেই সময় ‘লীলাময় রায়’ ছদ্মনামে লিখতেন অন্নদাশঙ্কর। অন্নদাশঙ্করের জীবনে লীলা রায়ের প্রভাব ব্যাপক। বহু ভাষায় পারদর্শী লীলা রায় নিজেও খ্যাতিলাভ করেন সাহিত্যিক এবং অনুবাদক হিসেবে। গুণী মার্কিন কন্যা লীলা রায় বাঙালি রমণীর মতোই জীবন যাপন করেন। তিনি অন্নদাশঙ্কর সহ বহু বই বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তিনি সত্যজিত রায়ের অশনি সংকেত, ঘরে-বাইরে এবং অনান্য সিনেমার ইংরাজী সাব-টাইটেল তৈরী করেন।

সাহিত্য-
অন্নদাশঙ্করের প্রথম কবিতা উড়িয়া ভাষায় প্রকাশিত হয়।  বাংলা, ইংরাজী, উড়িয়া, হিন্দি ভাষার পারদর্শী হলেও সাহিত্য চর্চায় তিনি বাংলা ভাষাকেই বেছে নেন। অন্নদাশঙ্করের মাত্র ১৬ বছর বয়সে টলস্টয়ের গল্প ‘তিনটি প্রশ্ন’ বাংলায় অনুবাদ করেন তিনি এবং তা প্রবাসী পত্রিকায় ছাপা হয়। বাংলা ভাষায় তাঁর প্রথম প্রকাশিত মৌলিক রচনার বিষয় ছিল নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা, যা ভারতী পত্রিকায় ছাপা হয়। এ ধরনের বিষয় নিয়ে তিনি ওড়িয়া ভাষায়ও লেখেন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের ওপর প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথকেও আলোড়িত করে।  তাঁর লেখা অন্যান্য বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'পথে প্রবাসে', 'সত্যাসত্য', 'যার যেথা দেশ' প্রভৃতি।

বাংলা ছড়া-
আধুনিক বাংলা ছড়ার জগতে অন্নদাশঙ্কর এক নতুন ধারা আনেন। এই ছড়া লেখার পিছনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বুদ্ধদেব বসুর অনুপ্রেরণা কাজ করে ছিল। তিনি ছোট- বড়, শ্রমজীবী থেকে সাধারণ মানুষ সবার জন্য ছড়া লিখেছেন। তাঁর কিছু ছড়া খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সুরকাররা গান তাঁর অনেক ছড়ায় সুরকাররা সুর দিয়ে গান তৈরী করেন। যেমন 'খোকা ও খুকু'তে সুর দিয়েছিলেন বিখ্যাত সুরকার সলিল চৌধুরী। এই ছড়ায় অন্নদাশঙ্কর দেশভাগের বেদনা তীর্যকভাবে প্রকাশ করেছেন।

'তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো।
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো!
তার বেলা?'

অনেক ছড়ার গান  শিশুদের প্রিয় গান হয়ে ওঠে।
'ময়নার মা ময়নামতি
ময়না তোমার কই
ময়না গেছে কুটুম বাড়ী
গাছেরডালে ওই।'

তাঁর লেখা উড়কি ধানের মুড়কি, রাঙা ধানের খই প্রভৃতি ছড়ার বই ছোটোদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। জীবনের শেষদিনেও হাসপাতালে মুখে মুখে তাঁর শেষ ছড়া বলে যান। অন্নদাশঙ্করের অনান্য ছড়াগ্রন্থগুলির নাম  ‘ডালিম গাছে মউ’, ‘শালি ধানের চিড়ে’ , ‘আতা গাছে তোতা’, ‘হৈ রে বাবুই হৈ’, ‘রাঙামাথায় চিরুনি’, ‘বিন্নি ধানের খৈ’ ও ‘যাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ’।

বিদেশ ভ্রমণ রচনাবলী-
তিনি ইংল্যান্ড যান আই.সি.এস হতে। সেখানে তিনি দু বছর ছিলেন। এরই ফাঁকে ঘুরে বেড়ান সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ইটালি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ। ফলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটে তাঁর সাহিত্যে। তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘পথে প্রবাসে’ ভ্রমণকাহিনীর মাধ্যমেই তিনি বাংলা সাহিত্যে নিজের স্থান করে নেন। অন্নদাশঙ্করের অন্যান্য ভ্রমণকাহিনীগুলি হ’লো ‘ইউরোপের চিঠি’, ‘জাপানে’, ‘ফেরা’, ‘চেনাশোনা’ ও ‘বাংলাদেশে’।

কর্ম জীবন-
অন্নদাশঙ্কর ১৯৩৬ সালে কর্মজীবন শুরু করেন নদীয়া জেলার ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে। শেষের দিকে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিচার বিভাগের সেক্রেটারি হয়ে ১৯৫১ সালে তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নেন।

শান্তিনিকেতনে-
চাকরি ছাড়ার পর অন্নদাশঙ্কর বসবাস শুরু করেন শান্তিনিকেতনে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালির আত্মদান তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। পরের বছর ১৯৫৩ সালে এক ঐতিহাসিক ‘সাহিত্য মেলা’র আয়োজন করেন তিনি শান্তিনিকেতনে।

সম্মান ও পুরস্কার-
সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৭৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পুরস্কারে ভূষিত করে। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার ইত্যাদি।

২০০২ সালের ২৮শে অক্টোবর অন্নদাশঙ্কর রায় কলকাতার পি. জি হসপিটালে  পরলোকগমন করেন।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

No comments:

Post a Comment