29 July 2021

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ১৩০ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ১৩০ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি। বিদ্যাসাগরের কর্মজীবনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলন, দ্বিতীয়ত শিক্ষাসংস্কার ও শিক্ষাপ্রসারে ভৃমিকা,তৃতীয়ত ভাষা ও সাহিত্যে ঐতিহাসিক ভূমিকা। কঠোরতা ও কোমলতার অপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত বিদ্যাসাগরের চরিত্র আমাদের একদিকে যেমন অভিভূত করে অপরদিকে যোগ্যতার সহিত তিন পর্যায়ের কর্মধারাকে বাস্তবে পরিণত করার প্রচেষ্টাকে আমরা প্রশংসা না করে পারি না। বিদ্যাসাগরের মতো মানুষ সত্যিই বিরল আমাদের অনেক কিছু করার আছে ঊনবিংশ শতাব্দীর মহাপ্রাণ মানুষ টির প্রতি যোগ্য সন্মান আর একনিষ্ঠ শ্রদ্ধা জানাবার। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলকাতা বিশ্যবিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠিতা সদস্য ছিলেন। মাতৃভক্তির জন্য তাঁর নাম কিংবদন্তী হয়ে আছে। চিরদিন তিনি গোঁড়ামি, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। রামমোহনের সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ হবার ফলে কৌলিন্য প্রথা ও বহু বিবাহ রদ হওয়ায় সমাজে বিধবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হয় তাঁরই প্রচেষ্টায়। তাঁকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। স্কুল বিভাগের শিক্ষার জন্য তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন। বর্ণপরিচয়, কথামালা, চরিতাবলী, শকুন্তলা, সীতার বনবাস প্রভৃতি রচনা করে বাংলা ভাষার বল সঞ্চয় করে ছিলেন। এছাড়া তিনি সম্পাদনা করেছিলেন উত্তররামচরিত, রঘুবংশ সন্দর্ভ সংগ্রহ, কুমারসম্ভব, কাদ্ম্বরী, মেঘদূত প্রভৃতি গ্রন্থ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আর মা ভগবতী দেবী। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে সুপন্ডিত ব্যক্তি। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় স্বল্প বেতনের চাকরি করতেন। সেই কারণে ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশব তাঁর মা ও ঠাকুরমার সাথে কাটে। ঈশ্বরচন্দ্র ছেলেবেলায় খুব দুরন্ত হলেও খুব বুদ্ধিমান ছিলেন। গ্রামের পাঠশালায় মন দিয়ে পড়াশোনা করে অল্প দিনেই সব শিখে ফেলেন। ছেলে লেখাপড়া শিখুক এটাই ঠাকুরদাসের ইচ্ছা। অল্প মাইনের চাকরি করলেও সাহস করে ছেলেকে উচ্চ শিক্ষা দেবার জন্য নিয়ে চললেন কলকাতায়। সেই সময় রেল গাড়ি ছিল না। বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলকাতা অনেক দূর। ছেলের হাত ধরে ঠাকুরদাস হাঁটা পথেই কলকাতা রওনা দিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র পথের ধারে মাইল পোস্ট দেখে ইংরাজি সংখ্যা গুলো শিখে নেন কলকাতা পৌঁছনোর আগেই। কলকাতায় ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। খুব কষ্টকরে ঈশ্বরচন্দ্র পড়াশোনা শুরু করেন। বাড়ির সব কাজ তাঁকে করতে হত। রান্না করা, বাসন মাজা সব কিছুর মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে যান। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি সাহিত্য, অলঙ্কার, ব্যাকরণ, সংস্কৃত সহ আরও কিছু বিষয় আয়ত্ত করে ফেললেন। পরীক্ষায় সকলের চেয়ে বেশি নম্বর নিয়ে বৃত্তি পেলেন। তাঁর পান্ডিত্য দেখে দেশের পন্ডিতবর্গ তাঁকে বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন বিদ্যাসাগরের বয়স মাত্র কুড়ি। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র তখন চাকরিতে যোগ দেন।১৮৪১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেডপন্ডিতের পদ পান ঈশ্বরচন্দ্র। ঈশ্বরচন্দ্র দানশীলতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁকে 'দয়ার সাগর' বলা হত।গভীর মানবতাবোধ ও পরদুঃখ কাতরতা তাঁকে দয়ার সাগরে পরিণত করে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্যারিসে থাকাকালীনবেহিসেবী খরচের ফলে অর্থসঙ্কটে পড়লে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর টাকা পাঠিয়ে মাইকেলকে সাহায্য করেছিলেন। বাঙালি জাতি প্রথম বড় হবার, যোগ্য, মানবিক, আধুনিক, প্রগতিশীল ও বিশ্বজনীন হবার দৃষ্টান্ত খুঁজে পেয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্রের মধ্যে।তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি-"তিনি হিন্দু বা বাঙালি ব্রাহ্মণ ছিলেন না। তাঁর মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয় বট তিনি বঙ্গভুমিতে রোপণ করে গেছেন, তার তলদেশ জাতির তীর্থস্থান হয়েছে"। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন-"আমি যে দরিদ্র বাঙালি ব্রাহ্মণকে শ্রদ্ধা করি তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।" এই মহাপুরুষ ৭১ বছর বয়সে ১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই আমাদের ছেড়ে চলে যান।

No comments:

Post a Comment