21 November 2018

কালিপুজোয় পরিবেশ এবং শব্দ দূষণ ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ঃ ৮.১১.২০১৮


কালিপুজোয় পরিবেশ এবং শব্দ দূষণ ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ঃ ৮.১১.২০১৮

এখন রাত্রি ৮টা। বাইরে ত্বারস্বরে মাইক বাজছে। আজ কালি পুজোর বিসর্জনের দিন। পাশের ক্লাবের পুজোর আজ বিসর্জন হবে না। সেখানে চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাধারণ ভাবে রাত ১০টার পর মাইক বাজানো নিষেধ। তাছারা লাউডস্পিকারের শব্দের মাত্রা ৬৫ ডেসিবলে বেঁধে দেওয়া আছে। কিন্তু হাই ওয়াটের সাউন্ড সিস্টেমের সাথে মাইকের আওয়াজ কটা অবধি চলবে জানি না। সাধারণ মানুষের শান্তিতে থাকার অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। এটা শব্দ দূষনণের মধ্যে পরে। এ সব ক্ষেত্রে উদ্যোগতারা লোকাল থানার সাথে বোঝাপড়া করে নেয়। উদ্দ্যোগতাদের নেতা গোছের কেউ থানার ওসি কে ফোন করে বললো আমরা পুজো প্যান্ডেলের সামনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবো এবং চলবে রাত ১২টা পর্যন্ত। ওসি আঁতকে উঠে বলবেন না না হবে না। ওটা খুব জোর  ১১ টা পর্যন্ত চলতে পারে। ওপারে নেতার আকুতি মিনতির পর ওসি বলবেন আপনার কথা থাক আর আমার কথা থাক, ওটা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত রইল। কিন্তু কার্যত সেটা মধ্যরাত পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। লোকাল লোকেরা ভয়ে থানায় অভিযোগ জানায় না। সাহস করে কেউ ফোন করলে তাকে মানিয়ে  নিতে বলে।

আমরা যখন ছোট ছিলাম সেই ৬০-৭০ দশকে সারা রাত্রি ব্যাপি মাইক বাজিয়ে পাড়ায় রাস্তা জুড়ে ফাংশন হত। সেই সময় বউবাজারের বাড়ির আশেপাশে মোটামুটি তিনটি  জায়গায় রাস্তা জুড়ে সারা রাত্রিব্যাপি ফাংশন হত। একটা হিদারাম ব্যানার্জী ও মদন দত্ত লেনের সংযোগ স্থলে। আর একটা হলধর বর্ধন লেন ও রাম কানাই অধিকারী লেনের সংযোগ স্থলে। আর একটা হত বড় করে শশীভূষণ দে স্ট্রীটের ওপর। এসব জায়গায় বাংলার শিল্পীরা আসতেন। আজও  মনে পড়ে হেমন্ত মুখার্জীর সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরে স্টেজের ওপর বসে হারমনিয়াম নিয়ে "ও নদীরে একটি কথা",  "আয় খুকু আয়", "এই পথ যদি না শেষ হয়" এর মত হিট হিট গান গেয়ে স্টেজ মাতিয়ে রাখতেন।  উনি মাঝরাত্রের একটু আগে স্টেজে উঠতেন। গান চলাকালীন শ্রোতাদের কাছ থেকে ছোট্ট কাগজের মধ্যে গানের অনুরোধ যেত। গান শেষ করে উঠে যাবার সময়  "আর একটা আর একটা" বলে চিৎকার উঠত।  শ্রোতাদের অনুরোধ রাখতেন।
কাঞ্চন বলে একজন  শিল্পী সাফারী সুট পড়ে তখন কার হিট গান গুলো মহিলা কন্ঠে গাইতেন। বেশ পপুলার ছিলেন। মাঝে জহর বা ভানুর হাস্যকৌতুক। আর সব থেকে বেশি আর্কষণ ছিল ভোর রাত্রে হিন্দি গানের তালে রুমকি ঝুমকির নাচ। ঝকমকি ড্রেস পরে  পেছন ফিরে হাতে কলকে নিয়ে রুমকির স্টেজে ঢোকা আর দম মারো দম গানের তালে নাচ। এগুলি সাধারণত শীতকালে হত। দুর্গা পুজোর পর নেবুতলা মাঠের জলসায় বোম্বের শিল্পীদের দেখা যেত। তাছারা  কালি পুজোর সময় কংগ্রেসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত ওরফে ফাটাকেষ্টর সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের আর সোমেন মিত্রের আমহার্স্ট স্ট্রিট ও কেশব সেন স্ট্রিটের মুখে স্টেজে বা মাচা শোয়ে বাংলার এবং বোম্বের নাম করা  আর্স্টিস্টদের উপস্থিতি কারোর অজানা নয়।  তার মধ্যে রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, রাহুল দেব বর্মন, আশা ভোঁশলেও ফাটাকেষ্টর শোয়ে উপস্থিত  ছিলেন। আম পাবলিকের কাছে তিনি ফাটাকেষ্ট নামে পরিচিতি থাকলেও  ক্লোসড সার্কেলে উনি ছিলেন কেষ্টদা। ঠাকুর দেখতে আসা কেউ একজন ফাটাকেষ্ট বলাতে ক্লাবের ছেলেরা তাকে রাস্তার উপর কান ধরে ওঠবোস করায়। সেই সময় লাউডস্পিকার বাজানোর সময় সীমা নিয়ে কড়াকড়ি সেরকম ছিল না। তাছারা পাবলিক ও থুব বেশী প্রতিবাদ মুখর ছিলেন না।
এখনকার  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কলকাতা ও তার আশেপাশে সাধারণত দুর্গা, কালি ও সাম্প্রতিক কালের জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়  বেশী হচ্ছে। সন্ধ্যের পর  শুরু হয় চলে অধিক রাত্রি পর্যন্ত। শিল্পীর গানের গলার থেকে হাই ভোল্টেজ মিউজিক সিস্টেমের আওয়াজ বেশী শোনা যায়। আর গানের মাঝে "কি ভালো লাগছে তো, তাহলে একটা জোরে হাততালি হয়ে যাক" গোছের আবদার শিল্পীর কাছ থেকে আসে।
সময় পালটেছে। এখন আর ওপেন ফাংশন রাস্তা জুড়ে  সারা রাত্রি  হয়না। সে হিসাবে অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলা যায়। তবে এখন হাই ওয়াটের সাউন্ড সিস্টেমের গুম গুম শব্দে খাট শুদ্ধু কেঁপে ওঠে।

শব্দ ও পরিবেশ দূষণের আর একটি কারণ কালি পুজো ও অন্যান্য  উৎসবে আতসবাজির সাথে শব্দ বাজি পোড়ানো। এই সময় শব্দ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা অত্যাথিক বেড়ে  যায় এবং পরিবেশ দূষিত হয়। শব্দ দূষণের কারণে শ্রবণ শক্তি, হার্ট, ফুসফুসের ক্ষতি বেশী রকম হয়।  এর কুফল মানুষ এবং পশুপাখি উভয়ের উপরেই পড়ে। আমাদের ছোটবেলায় কালিপুজোর সময় প্রচুর আতস ও শব্দবাজি পাড়ার গলিতে পোড়াতাম। তখন শব্দ ও পরিবেশ দূষণের ব্যাপার আমাদের মাথায় ছিল না। আমাদের বাড়ির নিচের তলায় সার্বজনিন এক মামা ছিলেন। উনি প্রতি কালিপুজোয়  বড়বাজার থেকে প্রচুর আতস ও শব্দ বাজি কিনে আনতেন আর আমাদের দিয়ে পোড়াতেন। ফুলঝুরি, রংমশাল, চরকি, বসানো তুবরি, উরন তুবরি,সাইরেনের সাথে সাথে কালিপটকা, চকলেট বোম, আলু বোম, দোদমা, রকেট ফাটাতাম।  বারুদের ধোয়া আর গন্ধে চারিদিক ভরে উঠতো। খুব আনন্দ হত।  তাছারা বিসর্জনের দিন ঠাকুরকে লরিতে চাপিয়ে ঢাকির তলে নাচতে নাচতে সারা রাস্তায় বাজি পোড়তে পোড়াতে বাবুঘাটে যাওয়া ছিল আলাদা মজা ছিল।
 আমাদের পাড়ার হলধর বর্ধন লেনের ৪৫ পল্লীর ঠাকুর বিসর্জনের রুট ছিল হিদারাম ব্যানার্জী লেন থেকে বেড়িয়ে নির্মল চন্দ্র স্ট্রীট ধরে ওয়েলিংটন মোড় পেড়িয়ে ডান দিকের এস এন ব্যানার্জী রোড ধরে  ইডেন গার্ডেন কে ডান হাতে রেখে সোজা বাবুঘাট। তখন এখনকার মতন ব্যাঞ্জর  প্রচলন  ছিল না। বিসর্জনের আগে ঘাটেও বাজি পুড়তো। বিশেষ করে বসানো তুবরির প্রদর্শণ ছিল দেখার মত। সারা বছর ঐ দিনগুলোর  জন্য অপেক্ষা  করতাম। ফাটাকেস্টর নব যুবক সংঘের ঠাকুর ১৪- ১৫ দিন পর ভাসান হত। ওদের ঠাকুর বিসর্জন ছিল জাঁকজমক পূর্ণ।  ১০৮ টা লাইটের গেট, ব্যান্ড পার্টি, ঢাকের বহর সবাইকে টেক্কা দিত। বিরাট শোভাযাত্রার সাথে নিমতলার ঘাটে ঠাকুর বিসর্জন হত। আমার এক বন্ধু সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটের কাছে কলেজস্ট্রীতে থাকত।  তার সাথে একবার সেই শোভাযাত্রায় যোগদান করে ছিলাম। শোভাযাত্রা সুস্থ  ভাবে পরিচালনা করে নিয়ে যাবার জন্য উদ্দ্যোক্তাদের ছেলেদের মধ্যে থাকত ব্যাপক তৎপড়তা এবং টান টান উত্তেজনা। তারা রাস্তায় সব সব রকমের সমস্যা মোকাবিলা করার মত প্রস্তুতিতে থাকত।  তবে সেই শোভাযাত্রায় বিশাল  রকমের বাজি পোড়াবার কথা মনে পড়ে না।
কিন্তু এখন বাজি পোড়াবার সময় শব্দ ও পরিবেশ দূষণের ব্যাপার চলে আসছে। সাথে থাকছে পুলিশের ভয়।
১৯৯৭ সালে বিচারক ভগবতী প্রসাদ ব্যানার্জী মহাশয়ের রায় খুবই উল্লেখ্যোগ্য। তখন থেকে এ রাজ্যে বাজির শব্দের মাত্রা ৯০ ডেসিবল বেঁধে দেওয়া হয়।
এবারের ২০১৮ সালের কালিপুজো এবং দেওয়ালির প্রাকালে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত একটি রায় দেয়। সেখানে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে শুধুমাত্র লাইসেন্স প্রাপ্ত ডিলার বা দোকানদাররা অনুমতিপ্রাপ্ত বাজি বিক্রি করতে  পারবে এবং  রাত ৮ টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মানে ২ ঘন্টা বাজি পোড়ানো যাবে।  তাছারা লোএমিশণ বা গ্রিন বাজি পোড়াবার কথা বলা হয়েছে।এই রায় কার্যকরি করার ভার থানার স্টেশন হাউস অফিসারের ওপর  থাকবে। কলকাতা পুলিশ  নিষিদ্ধ ১০৫ টা বাজির লিস্ট তৈরী করেছে। মোদ্দা কথা যে সব বাজির আওয়াজ কানের পক্ষে বেদনা দায়ক সেগুলি নিষিদ্ধ।
এই নির্দেশ কতটা মান্য করা হবে সে বিষয়ে সর্বস্তরের মানুষের একটা সন্দেহ ছিল। কার্যত তাই হল। মানুষ সময়ের তোয়াক্কা না করে আতসবাজী আর শব্দ বাজী পুড়িয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ দূষণের মাত্রা ৪ গুন বেড়ে গেছে। শব্দ বাজির ভীষন শব্দে প্রাণ যায় যায়। আমার বাড়ীতে ছোট্ট একটা কুকুর আছে। সে বাজির শব্দে কেঁপে উঠছে।  কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবে ভেবে পাচ্ছে না। আর রাস্তার কুকুর, বেড়াল, পাখিদের অবস্থা সহযেই অনুমেয়।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অমান্য হয়েছে। বিনা লাইসেন্সে দেদার বাজি রাস্তায় ঢেলে বিক্রি হয়েছে। বাজির কারখানা গুলোতে  নজরদারী ছিল না। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে বাজি পুড়েছে। সেই সংগে নিষিদ্ধ বাজিও প্রচুর পুড়েছে।এর জন্য প্রাথমিক ভাবে পুলিশ প্রসাশন কে দায়ী করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন থাকছে কেউ যদি বাজি ফাটিয়ে ঘরে ঢুকে যায় বা লুকিয়ে যায় তাহলে পুলিশ কি করবে। আবার এটাও দেখা গেছে  রাস্তার ওপর সবার সামনে বাজি পোড়াচ্ছে। সেখানে কোনো পুলিশের দেখা নেই। এই আইন অমান্য করায় পুলিশ  ধর পাকড়ও করেছে। অনেক ক্ষেত্রে ছোটরা  নিষিদ্ধ বাজি আনন্দ করে পোড়াচ্ছে। তাদের ওপর আইন প্রয়োগ করাটাও সব সময় সম্ভব হয় না। তবে কিছু বেয়াদপ ছেলেদের ধরেছে। এক জনকে ধরে  মাথা নেড়া করে থানায় বসিয়ে রাখতে দেখেছি। কালিপুজো ও দেওয়ালিতে কলকাতা শহরাঞ্চলে পুলিশ প্রায় ২৫০০ কেজি নিষিদ্ধ বাজি বাজায়াপ্ত করেছে এবং ১০২৯ জনকে গ্রেফতার করেছে।  সামগ্রিক ভাবে এই ব্যর্থতার জন্য পুলিশ প্রসাশনকে আদালতের কাঠগোড়ায় টেনে আনা যায়। এর বিচার কে করবে।
এত গেল আইনের কথা। মূল ব্যর্থতার কারণ হল সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতার অভাব এবং আদালতের রায় মানার অনীহা। এর জন্য চাই বিপুল প্রচার এবং বাজি  তৈরীর কারখানাগুলোর ওপর বাড়তি নজরদারী। স্কুল ও কলেজ গুলিতে ব্যাপক প্রচার দরকার। ২০১৮ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায় শব্দ ও পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন। আগে কালিপুজো আর দেওয়ালিতে সারা রাত ধরে শব্দ বাজি পুড়তো। এখন সেটা অনেক কমে এসেছে। আশা করব আগামী দিনে আমরা এ বিষয়ে আরোও সচেতন হব এবং নতুন প্রজন্মকে সুন্দর পরিবেশ উপহার দেবো।

1 comment: