10 September 2019

শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের ৯৬ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সুকুমার  রায়ের পিতা উপেন্দ্রকিশোর  রায় ছিলেন একজন বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক। পিতার কাছ থেকে শিশু সাহিত্যি রচনার প্রেরণা সুকুমার রায় শৈশবেই পান। বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায় হলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যার লেখা অসাধারণ কিছু সাহিত্যকর্ম আজও বাঙালীর মনে অমর হয়ে আছে | সুকুমার রায়ের পুত্র সত্যজিৎ রায়ও একজন শিশু সাহিত্যিক। তিন পুরুষব্যাপী শিশু সাহিত্যি রচনায় বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে কলকাতার এই রায় পরিবার। ২০১৯ সালে সুকুমার  রায়ের ৯৬ তম  মৃত্যু বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সুকুমার রায় ১৮৮৭ সালে কলকাতার  এক ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম জন্মগ্রহন করেন| তাঁর মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রধান সংস্কারক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে |

সুকুমার রায় ছোটবেলা থেকেই মুখে মুখে নানা ধরণের ছড়া তৈরি করে ফেলতেন অনায়াসেই | এমনকি গান গাইতেন, নাটক করতেন আর কবিতাও লিখতে। এক কথায় যদি বলতে হয় তাহলে সেইসময় থেকেই তিনি একধরনের মজাদার গোছের মানুষ ছিলেন এবং সবাইকে নেতৃত্ব দিতে খুব ভালোবাসতেন |

তাঁর বোন পুণ্যলতা তাঁর সম্পর্কে একসময় বলেছিলেন- “দাদা যেমন আমাদের খেলাধুলা ও সব কিছুরই পাণ্ডা ছিলো, তেমনি বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের মধ্যেও সে সর্দার ছিলো । তার মধ্যে এমন কিছু বিশেষত্ব ছিল যারজন্য সবাই তাকে বেশ মানতো । এমনকি বড়রাও তার কথার বেশ মূল্য দিতো”

প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়ই তিনি কগড়ে তুলেছিলেন “ননসেন্স ক্লাব”। এই ক্লাবের মুখপত্র ছিল হাতে লেখাকাগজ-“সাড়ে বত্রিশ ভাজা” |
তার জনপ্রিয় সাহিত্য কর্ম আবোল তাবোল, হ-য-ব-র-ল, পাগলা দাশু, কাতুকুতু বুড়ো, হুঁকো মুখো হ্যাংলা ইত্যাদি

সাড়ে বত্রিশ ভাজার পাতাতেই  সুকুমার রায় জীবনের সর্বপ্রথম নিজের রচিত হাস্যরসযুক্ত কিছু লেখা প্রকাশ করেন | আর এই ক্লাবের জন্য তিনি দুটো নাটকও রচনা করেছিলেন, যেগুলোর নাম যথাক্রমে ছিলো “ঝালাপালা”  ও “লক্ষণের শক্তিশেল”।ক্লাবের সদ্যসের নিয়েই তিনি, এই দুটো নাটককে সবার মাঝে পরিবেশন করেন। ননসেন্স ক্লাবের প্রতিটা নাটক দেখার জন্য, সেইসময়কার প্রচুর ছেলে ও বুড়োরা ভীষন ভিড় জমাতো এবং তাদের সবারই পছন্দের নাট্যকার ছিলেন সুকুমার রায়। আবোল তাবোল (১৯২৩),পাগলা দাশু (১৯৪০)হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি, খাই-খাই (১৯৫০)। আবোল তাবোল’ পুস্তকটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩-এর ১৯শে সেপ্টেম্বর, সুকুমারের মৃত্যুর ন’দিন পরে।

সুকুমার রায়ের মৃত্যুর ১৭ বছর পর ১৯৪০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় তার গল্প সংকলন ক'পাগলা দাশু'। এই গল্পগুলো সুকুমার  রায়ের সম্পাদিত পত্রিকা ' সন্দেশ'এ প্রকাশিত হত।এই সংকলনের ভূমিকা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

নাটক করা ছাড়াও, সন্দেশের সম্পাদক থাকাকালীন তাঁর লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ সবারই ভীষন পছন্দের ছিল, আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে তাঁর রচিত সব  সাহিত্যকর্মই মাইলফলক হয়ে আছে আর ভবিষ্যতেও একই থাকবে |

তিনি রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্সে বি,এস,সি পাশ করার পর ১৯১১ সালেমুদ্রণ শিল্পে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে বিলেত যান। সে সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সহিত বিলেতে তার সাক্ষাৎ হয়। সুকুমার রায় ইস্ট অ্যাড ওয়েস্ট সোসাইটির এক অধিবেশনে 'দি স্পিরিট অব রবীন্দ্রনাথ' নামক এক প্রবন্ধ পাঠ করেন। ইংল্যান্ডের সুধী সমাজে রবীন্দ্রনাথ তখন ও পরিচিত নন। সুকুমার যখন ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করছিলেন, সেইসময় অন্যদিকে তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জমি কিনে একটা  উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি করেন এবং সেইসাথে নিজস্ব ছাপাখানাও স্থাপন করেন | এইসবই তিনি তৈরী করেছিলেন ছোটদের জন্য একটা মাসিক পত্রিকা “সন্দেশের”, প্রকাশনার উদ্দেশ্যেই | কিন্তু ১৯১৩ সালে ইংল্যান্ড থেকে পড়াশোনা শেষ করে সুকুমার রায় যখন কলকাতায় ফিরে আসেন, তার ঠিক অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়।

এরপর ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে তিনি  “মনডে ক্লাব” নামে ননসেন্স ক্লাবেরই মতো একই ধরণের আরেকটা ক্লাব খুলেছিলেন | এই ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে, সদস্যরা সব বিষয় সম্পর্কেই আলোচনা করতেন ।ছোটবেলা হতেই সাহিত্য রচনায় তাঁর প্রতিভা লক্ষ্য করা যায়। মাত্র ৯ বছর বয়স থেকেই তিনি  'মুকুল' ও 'সন্দেশ' পত্রিকায়  নিয়মিত ভাবে লিখতেন। বাবার মৃত্যুর পর একজন দায়িত্ববান ছেলে হিসাবে এরপর তিনিই সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন এবং সেই পত্রিকাতেই নিজের অভূতপূর্ব সাহিত্যকর্ম গুলো একে একে প্রকাশ করতে থাকেন | বাবার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি এই সন্দেশ পত্রিকার ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন | তারপর সেইসবের দায়িত্ব তিনি আসতে আসতে তাঁর ছোটভাইকেই সম্পূর্ণরূপে দিয়ে দেন। বিয়ের ঠিক ৮ বছর পর অর্থ্যাৎ ১৯২১ সালের ২রা মে তারিখে সুপ্রভা দেবী তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তানের জন্ম দেন | যার নাম দেওয়া হয়েছিল সত্যজিৎ।

সত্যজিৎ রায় জন্মগ্রহণ করার কিছু মাস পর থেকেই সুকুমার রায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়া শুরু হয়। পরে চিকিৎসা শুরু করার পর জানা যায়, তিনি কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এবংসেই সময় সেটাকে ঠিক করা একদম অসম্ভব | কারণ তখন সেইযুগে কালাজ্বরের উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধের আবিষ্কার হয়ে ওঠেনি |

কিন্তু মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত জেনেও তিনি শেষসময়ে অসাধারণ মানসিক স্থৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন | কারণ এত বড় একটা রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরও তিনি নিজের কাজকে একটা দিনের জন্যও বন্ধ করেননি বরং আরো উদ্যমের সাথে সেটাকে করে গেছিলেন |

এই সম্পর্কে অবশ্য জানা যায়, সত্যজিৎ রায়ের একটা লেখায় | যেখানে তিনি তাঁর বাবার শেষের দিনগুলো সম্পর্কে লিখেছিলেন এই কথাগুলো:

“রুগ্ন অবস্থাতেও বাবার কাজের পরিমাণ ও উৎকর্ষ দেখলে অবাক হতাম । শুধু লেখা বা আঁকার কাজেই নয়, ছাপার কাজেও যে তিনি অসুখের মধ্যে অনেক চিন্তা ব্যয় করেছেন তারও প্রমাণ রয়েছে। একটি নোটবুকে তাঁর আবিষ্কৃত কয়েকটা মুদ্রণ পদ্ধতির তালিকা রয়েছে । এইগুলো পেটেন্ট নেবার পরিকল্পনা তাঁর মনে ছিলো, কিন্তু কাজে হয়ে ওঠেনি@@@@

এই সত্যজিৎ রায় পরবর্তীকালে বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমা জগতের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে ওঠেন, যা আমরা  প্রত্যেকেই জানি।

১৯২৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর,কালাজ্বরে ১০০নং গড়পার রোডের বাড়িতে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে সাহিত্যিক সুকুমার রায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

পোস্টটা ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই একটু Comment করে আপনার মূল্যবান মতামত  জানাবেন আপ নার মূল্যবান মতামত আমাদের বাড়তি অনুপ্রেরণা যোগাতে  ভীষনভাবে সাহায্য করবে | কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।


No comments:

Post a Comment