06 December 2018

১৯৩০ সালের ৮ ই ডিসেম্বর ব্রিটিশ শাসনের রাজধানী কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিং এ কারা আক্রমণ করেছিল-

অসংখ্য পুলিশ প্রহরী পরিবেষ্টিত দুর্ভেদ্য অফিস রাইটার্স বিল্ডিং। এই ভবন আক্রমণ করে সেখান হতে ফেরার আশা কেউ করতে পারে না। এই দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন বিনয় বসু। তাঁর সঙ্গী হলেন আরো দুজন নির্ভীক যুবক। বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত। কিশোর বয়স থেকেই বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত পরস্পর পরিচিত ছিলেন। তিনজনই ছিলেন পূর্ববাংলার (ঢাকার) সন্তান। কৈশোরকাল থেকে তিনজন দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতার মুক্তিযজ্ঞে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেন। ঘটনাচক্রে এই তিন বন্ধুই একসঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণের দায়িত্ব নেন।
দিন টা ছিল ১৯৩০ সালের ৮ ই ডিসেম্বর। ব্রিটিশ শাসনের  রাজধানী কলকাতায় নগর প্রশাসনিক কেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিং এ স্বাভাবিকভাবেই প্রতিদিনের মত কাজকর্ম চলছিল। বেলা ঠিক ১২টা।  ইওরোপীয় পোশাক পরে তিনজন বাঙালী যুবক রাইটার্স বিল্ডিং এ এসে কর্নেল সিম্পসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। তাঁরা সিম্পসনের চাপরাশীকে ঠেলে কর্নেল সিম্পসনের কামরার ভিতরে প্রবেশ করেন। হঠাৎ পদধ্বনী শুনে কর্নেল তাঁদের দিকে তাকান। বিস্ময়-বিমূঢ় চিত্তে দেখতে পান সম্মুখে ইওরোপীয় পোশাক পরে তিনজন বাঙালী যুবক রিভলবার হাতে দণ্ডায়মান। মুহূর্তের মধ্যে বিনয়ের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় 'প্রে টু গড কর্নেল। ইওর লাষ্ট আওয়ার ইজ কামিং।' কথাগুলি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি রিভলবার হতে ছয়টি গুলি সিম্পসনের দেহ ভেদ করে। সিম্পসন লুটিয়ে পড়ে মেঝের উপর। এরপরই গুলির আঘাতে আহত হন জুডিসিয়েল সেক্রেটারী মি. নেলসন। এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ করতে করতে আততায়ীরা পরবর্তী লক্ষ্য হোম সেক্রেটারী আলবিয়ান মারের কক্ষের দিকে অগ্রসর হন।  সমস্ত রাইটার্স বিল্ডিং জুড়ে তখন এক বিভীষিকাময় রাজত্ব। চারিদিকে শুধু ছুটাছুটি। কে কোন দিকে পালাবে খুঁজে পায় না।  রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণের সংবাদ পেয়ে  আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ডেকে আনা হল সশস্ত্র বাহিনীকেও। একদিকে তিনজন বাঙালী তরুণ, হাতে শুধু তিনটি রিভলবার। আর অপরদিকে রাইফেলধারী সুশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনী। আরম্ভ হল রাইটার্স বিল্ডিং এর বারান্দায় যুদ্ধ।  দীনেশের পিঠে একটি গুলি বিদ্ধ হল। তিনি তাতে ভ্রুক্ষেপও করলেন না। অসংকোচে গুলিবর্ষণ করতে লাগলেন শত্রুকে লক্ষ্য করে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিনয়-বাদল-দিনেশের হাতে গুলি ছিল, ততক্ষণ কেউ তাঁদের আক্রমণ করে প্রতিহত করতে পারেননি। একপর্যায়ে তাঁদের গুলি নিঃশেষ হল। সশস্ত্র বাহিনী অনবরত গুলিবর্ষণ করে চলল। তখন তিনজন বিপ্লবী একটি শূন্য কক্ষে প্রবেশ করে সঙ্গে আনা 'সায়নাইড'-বিষের পুরিয়াগুলি মুখে দিলেন। বিষ-ক্রিয়ায় অতি-দ্রুত জীবনপ্রদীপ নিবে না যাওয়ার আশংকায় এবং মৃত্যুকে নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেকেই নিজ নিজ ললাট লক্ষ্য করে রিভলবারে রাখা শেষ গুলিটি ছুঁড়ে দিলেন। বাদল তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেন। বিনয় ও দীনেশ সাংঘাতিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মেঝের উপর পড়ে রইলেন।
ভীষণভাবে আহত বিনয় ও দীনেশকে একটু সুস্থ করে ইংরেজ বাহিনী তাঁদের উপর চালাল প্রচণ্ড অত্যাচার। এরপর উভয়কেই পুলিশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।
বিনয়  হাসপাতালে থাকা অবস্থায় তিনি ১৪ ডিসেম্বর রাতে আকাঙ্খিত মৃত্যুকে বরণ করার জন্য মস্তিষ্কের 'ব্যাণ্ডেজে'র ভিতর অঙ্গুল ঢুকিয়ে স্বীয় মস্তিষ্ক বের করে আনেন এবং মৃত্যুকে বরণ করে নেন। অন্যদিকে ডাক্তার ও নার্সদের আপ্রাণ চেষ্টায় দীনেশ ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠেন। সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে হাসপাতাল থেকে কনডেমড সেলে নেয়া হয়। তারপর দীনেশের বিচারের জন্য ব্রিটিশ সরকার এক ট্রাইবুনাল গঠন করে ফাঁসির আদেশ দেয়। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই দীনেশের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে বিনয়-বাদল-দীনেশের নামানুসারে কলকাতার ডালহৌসি স্কয়ারের নাম পাল্টে রাখা হয় বি-বা-দী বাগ। অর্থাৎ বিনয়-বাদল- দীনেশ বাগ।

No comments:

Post a Comment