31 January 2019

আজ ৩১শে জানুয়ারী, শিবনাথ শাস্ত্রীর ১৭১তম জন্মবার্ষিকী। চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী, সমাজ-সংস্কারক, পন্ডিত এবং ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হিসেবে তিনি ছিলেন সমধিক পরিচিত।


আজ ৩১শে জানুয়ারী, শিবনাথ শাস্ত্রীর ১৭১তম জন্মবার্ষিকী। চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী, সমাজ-সংস্কারক, পন্ডিত এবং ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হিসেবে তিনি ছিলেন সমধিক পরিচিত। আসুন আজকের দিনে ওঁনার সম্বন্ধে কিছু তথ্য জেনে নি।

সমাজ উন্নয়নের ধারায় তাঁর অবদান আজো গভীয় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ এবং উজ্জ্বল আলোকিত মানুষ শিবনাথ শাস্ত্রী। ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে জানুয়ারি দক্ষিণ চবিবশ পরগনার চাংড়িপোতা গ্রামে (বর্তমানে সুভাষগ্রাম নামে পরিচিত) মামার বাড়ীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হরানন্দ ভট্টাচার্য আর মাতা কামিনী ভট্টাচার্য। উনিশ শতকের আরেক আলোকিত মানুষ, বিশিষ্ট সমাজ-সংস্কারক, সোমপ্রকাশ পত্রিকার সম্পাদক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ছিলেন তাঁর মামা। শৈশব-কৈশোরে মামার বাড়ীতেই থাকতেন শিবনাথ এবং মামার আদর্শেই তিনি বড় হতে থাকেন। মামা দ্বারকানাথ শিবনাথকে খুব ভালোবাসতেন এবং আপন আদর্শে তাঁকে বড় করে তুলতে থাকেন।শৈশব- কৈশোরেই নানা বিষয়ে তিনি কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। অন্য বালকদের মতো খেলাধুলায় তেমন মন ছিল না শিবনাথের, বরং মামার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন বিষয়ের গ্রন্থপাঠে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি।

শিবনাথ শাস্ত্রীর পৈতৃক নিবাস ছিল চবিবশ পরগনার মজিলপুর গ্রামে। মজিলপুর পাঠশালায় তাঁর বাল্যশিক্ষা আরম্ভ হলেও তিনি সেখানে বেশিদিন পড়ালেখা করেননি। মামাবাড়ির প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল তীব্র। এ-কারণে মামা দ্বারকানাথের তত্ত্বাবধানেই
শেষ হয় তাঁর বাল্যের পাঠ। অতঃপর মামার ইচ্ছানুসারে শিবনাথ ভর্তি হলেন সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে। কলেজিয়েট স্কুলের পাঠ শেষ হলে শিবনাথ ভর্তি হন কলকাতার বিখ্যাত সংস্কৃত কলেজে। সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৭২ সালে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে তিনি এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এমএ পরীক্ষায় ভালো ফল লাভ করায় তিনি অর্জন করেন ‘শাস্ত্রী’ উপাধি। অতঃপর পারিবারিক পদবি ভট্টাচার্যের পরিবর্তে তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘শাস্ত্রী’ উপাধি এবং তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন শিবনাথ শাস্ত্রী নামে।

উনিশ শতকের মধ্যপাদে কলকাতা শহরে ব্রাহ্মধর্ম ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়। সে-সময়ে শিক্ষিত যুবকদের পক্ষে ব্রাহ্মধর্মের প্রভাব এড়ানো সম্ভব ছিল না। শিবনাথও ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাঁর বাবা হরানন্দ ছিলেন রক্ষণশীল গোঁড়া ব্রাহ্মণ। কাজেই ছেলের ব্রাহ্মধর্মপ্রীতি তিনি ভালো চোখে দেখলেন না। সে সময়টায় ছিল ব্রাহ্মধর্মের জোয়ার। ব্রাহ্মধর্মের প্রভাব এড়ানো শিক্ষিত যুবকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। শিবনাথও ছাত্রজীবনে ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্ম- আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লেন। ১৮৬৯ সালের ২২ আগস্ট শিবনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। উপবীত ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেন শিবনাথ, ছেদ করেন পরিবারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক। ক্রমে শিবনাথ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন। ইতোমধ্যে ১৮৬৮ সালে ব্রাহ্ম-আন্দোলনের নেতা কেশবচন্দ্র সেন  প্রতিষ্ঠা করেন Indian Reforms Association। এ সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল মদ্যপান নিবারণ, শিক্ষা প্রসার, সুলভ সাহিত্য ও কারিগরি
জ্ঞানের প্রচার, নারীশিক্ষা তথা নারীমুক্তি। এসব আদর্শের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে শিবনাথ যোগ দেন Indian Reforms Association-এ। শিবনাথ কেশবচন্দ্রের প্রধান সহযোগী হিসেবে এসময় সমাজ সংস্কারমূলক অনেক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। নারীশিক্ষার পক্ষে তিনি গ্রহণ করেন দৃঢ় অবস্থান, বিধবাদের বিয়ের পক্ষে তিনি উচ্চারণ করেন জোরালো বক্তব্য। কেশবচন্দ্রের অনুপ্রেরণায় এসময় শিবনাথ মদ্যপান নিবারণ এবং শিক্ষা- সাহিত্য-কারিগরি বিদ্যা প্রচারে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। সমাজে মদ্যপানের ভয়াবহতা দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন। তরুণ সমাজকে মদ্যপানের ছোবল থেকে রক্ষা করার মানসে তিনি প্রকাশ করেন মদ না গরল শীর্ষক পত্রিকা।
শিবনাথ শাস্ত্রী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৭৬ সালে গঠিত হয় Indian Association’। এই সংস্থাই হলো ভারতীয় রাজনীতির প্রথম সংঘবদ্ধ প্রয়াস। এই সংস্থার অনুপ্রেরণাতেই ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। দেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ১৮৭৭ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী গঠন করেন ‘গুপ্ত বৈপ্লবিক সমিতি’। এই সংস্থার প্রধান কর্মসূচি ছিল – জাতিভেদ অস্বীকার, সরকারি চাকরি প্রত্যাখ্যান, সমাজে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, অশ্বারোহণ ও বন্দুক চালনা শিক্ষা, জাতীয়তামূলক ও সমাজ সংস্কারমূলক শিক্ষা এবং পূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা। এসব উদ্দেশ্য থেকেই শিবনাথ শাস্ত্রীর রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।

শিবনাথ শাস্ত্রী বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৭৪ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরস্থ সাউথ সুবার্বন স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন। দুবছর পর সাউথ সুবার্বন স্কুল ছেড়ে তিনি যোগ দেন হেয়ার স্কুলে, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক রূপে। এ সময় মামা দ্বারকানাথ শিবনাথ শাস্ত্রীর ওপর হরিনাভী স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। শিক্ষা ক্ষেত্রের সকল দায়িত্বই তিনি পরম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেন। তাঁর দক্ষ পরিচালনায় উল্লিখিত স্কুলগুলোতে পঠন-পাঠনে ইতিবাচক নানা পরিবর্তন সূচিত হয়। রাজনৈতিক কারণে ১৮৭৮ সালে হেয়ার স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি থেকে তিনি স্বেচ্ছায় ইস্তফা গ্রহণ করেন।

শিবনাথ শাস্ত্রীর বর্ণাঢ্য ও উজ্জ্বল কর্মজীবনের এক গৌরবজনক অধ্যায় তাঁর সাংবাদিক-জীবন। মামা দ্বারকানাথ- প্রতিষ্ঠিত সোমপ্রকাশ পত্রিকার সঙ্গে তিনি নানাভাবে জড়িত ছিলেন। দ্বারকানাথের ব্যস্ততার কারণে দুবছর শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সোমপ্রকাশ পত্রিকা। বস্ত্তত, দ্বারকানাথই ছিলেন শিবনাথের সাংবাদিক জীবনের প্রধান অনুপ্রেরণা। ১৮৮৩ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে সখা নামে ভারতের প্রথম কিশোর মাসিক প্রকাশিত হয়। অভিন্ন সময়ে তত্ত্বকৌমুদী (১৮৮২) এবং ইন্ডিয়ান মেসেজ (১৮৮৩) নামে দুটি ক্ষণস্থায়ী পত্রিকা সম্পাদনা করেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ১৮৯৫ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বিখ্যাত কিশোর মাসিক মুকুল। বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্য বিকাশে এই পত্রিকা পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। উল্লিখিত
পত্রিকাসমূহ সম্পাদনায় শিবনাথ শাস্ত্রী বিশেষ দক্ষতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দেন।

রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের দুই প্রধান কান্ডারি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর  এবং কেশবচন্দ্র সেন। প্রথম দিকে দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্রের মধ্যে ছির দারুণ সখ্য। ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা সভায় তাঁরা বসতেন পাশাপাশি। কিন্তু ১৮৭০-এর দশকে তাঁদের দুজনের সম্পর্কে চিড় ধরে। ব্রাহ্ম হলেও দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন অনেকটা প্রাচীনপন্থী। হিন্দুধর্মের আচার-অনুষ্ঠান অনেকটাই পালন করেন তিনি, ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেন হিন্দুমতে, ব্রাহ্মণদের উপবীত ধারণে অনুমতি দেন। পক্ষান্তরে কেশবচন্দ্র অনেক বেশি আধুনিক ও বিপ্লবী। ব্রাহ্মধর্মকে তিনি হিন্দুধর্ম থেকে একেবারে আলাদা করতে চান। তাঁর মতে, ব্রাহ্মরা অ-হিন্দু। হিন্দুধর্মের সকল প্রচার কুসংস্কারমূলক আচার- অনুষ্ঠান বর্জনের তিনি পক্ষপাতী। ক্রমে এই দুই ব্রাহ্ম-নেতার বিরোধ ধারণ করে চরম রূপ। এসময় ব্রাহ্ম ধর্মসভায় নারীদের প্রকাশ্য স্থানে উপাসনা করার পক্ষে ও বিপক্ষে মত প্রকাশে দেখা দেয় নতুন বিতর্ক। এ বিতর্কের সূত্র ধরেই ১৮৭৮ সালে ভেঙে যায় ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ। এ সময় শিবনাথ শাস্ত্রীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ (১৮৭৮)। অন্যদিকে কেশবচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’ (১৮৭৮)। দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ছিল ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রী এসময় পালন করেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। তাঁর নেতৃত্বগুণে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ দ্রুত কলকাতার সমাজজীবনে প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়। ধর্ম প্রচার ছাড়াও সমাজ সংস্কার ও রাজনৈতিক সংস্কার ছিল সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রধান কর্মসূচি। সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে শিবনাথ শাস্ত্রী সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ প্রচার করেন।

ইতোপূর্বেই শিক্ষাব্রতী হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রীর খানিকটা পরিচয় আমরা জেনেছি। এ প্রসঙ্গে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সিটি স্কুলের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুল পরবর্তিকালে  সিটি কলেজে রূপান্তরিত হয়। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজে উনিশ-বিশ শতকের বহু আলোকিত মানুষ বিদ্যা লাভ করেন। সিটি স্কুল প্রতিষ্ঠায় শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু আনন্দমোহন বসু এবং সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর সহযোগ লাভ করেন। অভিন্ন উদ্দেশ্যে এঁরা প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্টুডেন্ট সোসাইটি’ (১৮৭৯)। বস্ত্তত এটিই
হলো ভারতবর্ষের প্রথম ছাত্রসংগঠন।

১৮৮৮ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী ইংল্যান্ড গমন করেন। ভারতবর্ষ ও ইংল্যান্ডের সমাজকে তুলনামূলক দৃষ্টিতে বিচার করার মানসেই তাঁর বিলেত গমন। ছয় মাস তিনি বিলেতে প্রবাসজীবন যাপন করেন। এ সময় তিনি ইংল্যান্ডের নানা স্থানে ভারতবর্ষের সমাজ ও সংস্কৃতি, বিশেষত ব্রাহ্মধর্ম বিষয়ে বহু বক্তৃতা দেন এবং অর্জন করেন প্রচুর প্রশংসা। ইংল্যান্ড ভ্রমণ শিবনাথ শাস্ত্রীর মনে গভীর রেখাপাত করে। ইংরেজদের মধ্যে তিনি লক্ষ করলেন বহু সদ্গুণ। দেশে প্রত্যাবর্তন করে ওই সদ্গুণের চর্চা করার মানসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাধনাশ্রম’। জনগণের মধ্যে উচ্চ আদর্শ ও সদ্গুণ প্রচারে সাধনাশ্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান লেখক হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রীর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। সমাজ সংস্কারমূলক বিচিত্র কাজে ব্যস্ত থাকলেও তিনি
সাহিত্যসৃজনেও ছিলেন সমান উৎসাহী ও আন্তরিক। তাঁর লেখা কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ইতিহাস, আত্মজীবনী বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। শিবনাথ শাস্ত্রী যেসব কাব্য প্রকাশ করেন, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য – নির্বাসিতের বিলাপ , পুষ্পমালা, হিমাদ্রি কুসুম, পুষ্পাঞ্জলি, ছায়াময়ী,পরিণয় ইত্যাদি। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা শিবনাথ শাস্ত্রীর কবিতার বিশিষ্ট লক্ষণ। সহজ-সরল হৃদয়বাণী গুণে শিবনাথের কবিতা সমকালে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ধারায় শিবনাথ শাস্ত্রীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।একটি বিশিষ্ট আদর্শ তাঁর ঔপন্যাসিক চেতনায় সর্বদা থেকেছে ক্রিয়াশীল। নারীজীবনকে তিনি সমাজে-সংসারে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন স্বমহিমায়। প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক পরিচয়ে না দেখে সামাজিক লৈঙ্গিক দৃষ্টিকোণে নারীকে বিবেচনার প্রাথমিক আভাস শিবনাথ শাস্ত্রীর উপন্যাসে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। শিবনাথ শাস্ত্রীর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে আছে মেজবৌ, নয়নতারা, যুগান্তর, বিধবার ছেলে ইত্যাদি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তাঁর যুগান্তর উপন্যাস থেকেই উত্তরকালীন বিখ্যাত সংবাদপত্র যুগান্তরের নামকরণ করা হয়েছিল। উপন্যাসে ভাষা-ব্যবহারে শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন অতিসতর্ক। কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কথ্যভাষা ব্যবহার তাঁর উপন্যাসের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের বিকাশের ধারায় শিবনাথ শাস্ত্রীর অবদান যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এখনো মূল্যায়িত হয়নি।
প্রাবন্ধিক হিসেবেও শিবনাথ শাস্ত্রী রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার স্বাক্ষর। সমাজ সম্পর্কে প্রগতিশীল দৃষ্টিই তাঁর প্রবন্ধ- সাহিত্যের উপজীব্য বিষয়। হিন্দু ধর্মের নানামাত্রিক কুসংস্কার থেকে তিনি সমাজকে মুক্ত করার মানসে একের পর এক প্রবন্ধ লিখেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হচ্ছে – এই কি ব্রাহ্ম বিবাহ?, খৃষ্টধর্ম, জাতিভেদ, বক্তৃতা স্তবক , মাঘোৎসব উপদেশ, মাঘোৎসব বক্তৃতা, প্রবন্ধাঞ্জলি, ধর্মজীবন  ইত্যাদি। ব্রাহ্মধর্মের তিন প্রধান তাত্ত্বিকের জীবনী লিখেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী। তাঁর জীবনী
গ্রন্থগুলো হচ্ছে রামমোহন রায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী আত্মচরিত। তাঁর আত্মচরিত পাঠ করলে গোটা উনিশ শতক পাঠকের চোখে ভেসে উঠবে। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর কালজয়ী গ্রন্থ রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, যা ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য দলিল হিসেবে উত্তরকালে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইংরেজি ভাষাতেও শিবনাথ শাস্ত্রী কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য ইংরেজি গ্রন্থ – History of the Brahma Samaj এবং MenI have seen।

১৯১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শিবনাথ শাস্ত্রী কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

No comments:

Post a Comment