01 February 2019

আজ কবি ও সাংবাদিক যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ৭০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ওঁনার প্রতি রইলো আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আজ যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ৭০তম মৃত্যুবার্ষিকী। যতীন্দ্রমোহন বাগচী ছিলেন একজন বাঙালি কবি ও সাংবাদিক। ওঁনার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আজ ১লা ফেব্রুয়ারি 'কাজলা দিদি' কবির প্রয়াণদিবস। যতীন্দ্রমোহন বাগচীর নাম করলেই তার 'কাজলা দিদি' কবিতাটির মনে পড়ে যায়। এই কবিতাটি সকলের মন স্পর্শ করে। এ কবিতাটি পড়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেছিলেন, ‘কাজলা দিদি কবিতাটি সোনার অক্ষরে ছাপানো উচিত ছিল।’

 ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-
মাগো, আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে, নেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে-
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই;
মাগো, আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে দিদিকে আর কেনই-বা না ডাকো,
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন দিদি বলে ডাকি তখন,
ও-ঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি-তুমি কেন চুপটি করে থাকো?'

২৭ নভেম্বর, ১৮৭৮ সালে তিনি নদীয়া জেলার জমশেরপুরে জমিদার পরিবারে (বর্তমান বাগচী জমশেরপুর) জন্মেছিলেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস হুগলির বলাগড় গ্রামে।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী পড়াশোনা শুরু বহরমপুরের খাগড়ায় মিশনারি স্কুলে। শৈশব থেকেই ছিলেন খুব মেধাবী। বই পড়ায় ছিল তার খুব আগ্রহ। পরে তিনি ভর্তি হন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। তিনি তাঁর প্রথম ডিগ্রি কলকাতার ডাফ কলেজ (স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে নিয়েছিলেন।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী খুব অল্প বয়স থেকেই কাব্যচর্চা শুরু করেন। কবিতায় তার হাতেখড়ি স্কুলজীবনেই। একদিন যখন জানতে পেলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর নেই তখন তার কবি কিশোর মন বেদনায় ভরে যায়। তখন তিনি  বিদ্যাসাগর স্মরণে একটি কবিতা লেখেন। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুতে যতীন্দ্রমোহনের স্কুলের শোকসভায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র যতীন্দ্রমোহন সাহস করে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লেখা জীবনের প্রথম কবিতাটি পাঠ করলে সবাই অবাক হয়ে যান। উপস্থিত অনেকের চোখ জলে ভরে ওঠে। তেরো বছর বয়সের লেখা সেই রচনাটিই যতীন্দ্রমোহনের প্রথম মুদ্রিত কবিতা বলে জানা যায়। এখান থেকে তার লেখক জীবন শুরু।

ছাত্রাবস্থা থেকেই ঠাকুর বাড়ির বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা ‘ভারতী’ এবং সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় যতীন্দ্রমোহনের কবিতা একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকলে তিনি কবি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। গ্রাম্য প্রকৃতির সৌন্দর্য ও গ্রাম্য জীবনের সুখ-দুঃখের কথা তিনি দক্ষতার সঙ্গে প্রকাশ করেন। কাজলা দিদি ও অন্ধবন্ধু তাঁর দুটি বিখ্যাত কবিতা।

যতীন্দ্রমোহন ছিলেন রবীন্দ্রোত্তর যুগের সফল কবিদের অন্যতম। সেই যুগে রবীন্দ্রনাথের ভক্তের তুলনায় নিন্দুকের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী। তখন যতীন্দ্রমোহনের মতো সাহসী তরুন বুদ্ধিজীবি রবীন্দ্রনাথের জয়গান করে প্রকৃত আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর কবিতার প্রকৃতির উপস্থাপন ও সৌন্দর্যবয়ান জীবনানন্দ দাশ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সঙ্গতিশীল। অবশ্য এ কথা খুবই স্পষ্ট যে, যতীন্দ্রমোহন বাগচী সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারা। তাঁর প্রভাব ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠলেও সম্পূর্ণভাবে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে এড়াতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন চল্লিশের নিচে তখন থেকে ত্রিশ বৎসরকাল ধরে যতীন্দ্রমোহন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসাধনা , সামাজিক চিন্তা , সাহিত্যের চিন্তা ও গতিবিধির পুংখানুপুংখ সংবাদ রাখেন । যতীন্দ্রমোহন বহুবার কবির সাহচর্যও লাভ করিয়াছিলেন, তাঁর গৃহে বহুবার আতিথ্যগ্রহণ করেছেন, নিজগৃহেও রবীন্দ্রনাথকে বহুবার আমন্ত্রণ করে এনেছিলেনন । রবীন্দ্রনাথ যে-সব সংঘ, সংসদ ও সভা-সমিতির পরিচালনা করতেন, সে সব সম্মেলনে যতীন্দ্রমোহন উপস্থিত থাকতেন। রবীন্দ্র প্রতিভার সব কিছু  কবির নখদর্পনে ছিল।  সেকালের সর্বপ্রকার সাহিত্যিক গোষ্ঠী, সংসদ, অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যতীন্দ্রমোহনের ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল । সেকালের প্রথম শ্রেণীর প্রত্যেক সাময়িকপত্রে যতীন্দ্রমোহনের রচনা প্রকাশিত হত ।  যতীন্দ্রমোহনই সেকালের বঙ্গসাহিত্যের সর্বাঙ্গীন পরিচয় দানের অনন্যসাধারণ অধিকারী।
প্রাবন্ধিক যতীন্দ্রমোহনের সঙ্গে কবি যতীন্দ্রমোহন মিলিত হয়েই সৃষ্ট হয় এক নতুন রীতির প্রবন্ধ তাঁর কলমে।  ‘রবীন্দ্রনাথ ও যুগসাহিত্য’ তাঁর বিশেষ একটি গদ্য গ্রন্থ। রবীন্দ্রচর্চার ইতিহাসে একটি মূল্যবান গ্রন্থ। রবীন্দ্র সান্নিধ্য ও তাঁর পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের বহু তথ্য সম্বলিত এই গ্রন্থ উনিশ-বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের এক অনাবিষ্কৃত দলিল হয়ে আজও বিরাজমান । তাকে রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করে হয়।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী শিক্ষাজীবন শেষে নদীয়ার জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। জমিদারিতে তার মন বসল না। পরে কয়েক জায়গায় চাকরি করেন।

সাহিত্য জীবনে তিনি বহু পত্রিকায় গঠনমূলক অবদান রেখেছেন। তিনি মানসী, বঙ্গদর্শন, সাহিত্য, ভারতী, প্রবাসী, সাধনা, সবুজপত্র, মর্মবাণী, পূর্বাচল, যমুনা ইত্যাদি পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে  লিখেছেন।

যতীন্দ্রমোহন ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অত্যন্ত স্নেহশীল ও রসিক মানুষ। তিনি ছিলেন গীতিকার। তাৎক্ষণিক গান রচনা করে সুর দেওয়ায় ছিলেন পারদর্শী। ‘কাজলা দিদি’ ও ‘অন্ধবন্ধু’ তার দুটি বিখ্যাত কবিতা।
যতীন্দ্রমোহন বাগচীর অনান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো লেখা, কেয়া, বন্ধুর দান, জাগরণী, নীহারিকা প্রভৃতি।

১৯৪৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি দূর আকাশের তারার মধ্যে মিশে যান কবি ও সাংবাদিক যতীন্দ্রমোহন বাগচী। কবির প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

No comments:

Post a Comment