10 February 2019

আজ উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি নবীনচন্দ্র সেনের ১৭২তম জন্মবার্ষিকী। ওঁনার প্রতি রইল আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আজ ১০ই ফেব্রুয়ারি উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি নবীনচন্দ্র সেনের ১৭২তম জন্মবার্ষিকী। ওঁনার প্রতি রইল আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি নবীনচন্দ্র সেন দেশপ্রেমিক কবি হিসেবেই খ্যাত ছিলেন। ১৮৭৫ সালে ‘পলাশীর যুদ্ধ’ মহাকাব্য প্রকাশিত হলে কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কবি নবীনচন্দ্র সেকালে বাংলাসাহিত্যে সর্বাধিক পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও তাঁকে আমরা এখন প্রায় ভুলতে বসেছি। ‘পলাশীর যুদ্ধ’ প্রকাশের সাথে সাথে এই কাব্যগ্রন্থ নিয়ে ‘বঙ্গদর্শন’, ‘বান্ধব’ ও ‘আর্যদর্শন’ এই তিন সাময়িক পত্রিকায় উল্লেখযোগ্য আলোচনা হয়। ছাত্রজীবন থেকেই নবীনচন্দ্র কবিতা রচনা শুরু করেন। যখন তিনি এফ এ শ্রেণীর ছাত্র প্যারীচরণ সরকার সম্পাদিত এডুকেশন গেজেটে তাঁর প্রথম কবিতা 'কোন এক বিধবা কামিনীর প্রতি’ প্রকাশিত হয়।

রবীন্দ্র সমসাময়িক কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর বিশেষ হৃদ্যতা ছিল। চট্টগ্রামে কবি নবীনচন্দ্র দাসের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় ঘটে। নবীনচন্দ্র দাস সেই সময় কালিদাসের ‘রঘুবংশের’ বাংলা অনুবাদের প্রথম খন্ড প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর এই অনুবাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি নবীনচন্দ্র দাসকে এক দীর্ঘ প্রশংসাপত্র পাঠান। তাতে বিশ্বকবি লেখেন, “আমি আপনার লেখা রঘুবংশের বাংলা অনুবাদ পড়ে বেশ পুলকিত হয়েছি। সংস্কৃত ভাষার কবিতা অনুবাদে অনেক সময়ই কবিতার প্রাঞ্জলতা রক্ষা করা বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে। ফলে কবিতার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে যায়। কিন্তু আপনার অনুবাদে মূল কবিতার ভাবার্থ যথাসম্ভব রক্ষা করে তার ভাবরস ও সৌন্দর্যের এতোটুকু বিচ্যুতি ঘটতে দেননি। ” রঘুবংশের দ্বিতীয় খন্ডের অনুবাদ পড়েও কবিগুরু সমান মুগ্ধ হয়েছিলেন। ১৮৯৫ সালে সাধনা পত্রিকায় এই বইয়ের প্রশংসা করে রবীন্দ্রনাথ একটি দীর্ঘ সাহিত্য সমালোচনা লেখেন।

এক সময় তৎকালিন মাদারীপুর মহকুমার বিখ্যাত বাংলা কবি নবীনচন্দ্র সেন মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। নবীনচন্দ্র সেনের আমন্ত্রণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এক সময় মাদারীপুর সফরে এসেছিলেন এবং মাদারীপুর হতে নবীনচন্দ্র সেনের সাথে বর্তমান ডামুড্যা সফরেও আসেন। ডামুড্যার পূর্ব পাশের নদী দেখে বলেছিলেন এই নদী দামোদর নদীর মতো। এই নদী সাঁতার দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মায়ের সাথে দেখা করতে যেতেন। এই কথা শুনে মহকুমা প্রশাসক নবীনচন্দ্র সেন বিদ্যাসাগরের সম্মানে এই এলাকার নাম রাখেন দামোদর। ক্রমে ক্রমে এই এলাকা ডামুড্যা হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পিতার মৃত্যুর পর কবি আর্থিক সমস্যায় পড়েন। সে সময় দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নবীনচন্দ্র সেনকে আর্থিক সাহায্য করেন।


কবি নবীনচন্দ্র সেন ১৮৪৭ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার জমিদার রায় পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তবে তিনি পিতৃপুরুষের ‘রায়’ উপাধি বাদ দিয়ে ‘সেন’ উপাধি ব্যবহার করতেন। তার পিতা-গোপী মোহন রায় ছিলেন পেশায় জজ আদালতের পেশকার এবং মাতা রাজ রাজেশ্বরী দেবী।নবীনচন্দ্রের কবিতানুরাগী পিতার ফরাসি ভাষায় বিশেষ পাণ্ডিত্য ছিল।

নবীনচন্দ্রের বাল্যকালে পড়াশোনা শুরু হয় গ্রামে গুরুমশাইয়ের কাছে। পরে আট বছর বয়সে চট্টগ্রাম শহরে পিতার তত্ত্বাবধানে তিনি স্কুলে ভর্তি হন। ছাত্র নবীনচন্দ্র ১৮৬৩ সালে চট্টগ্রাম স্কুল (বর্তমানে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল) থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নবীনচন্দ্র ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। এফ এ পরীক্ষার এক মাস পূর্বে তাঁর বিয়ে হয় লক্ষ্মীকামিনী দেবীর সাথে। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতা যান। ১৮৬৫ সালে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এফ এ পাশ করেন। পরে তিনি ভর্তি হন জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে যা বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ নামে পরিচিত। জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন থেকে ১৮৬৮ সালে বি এ পাশ করেন।

বি.এ. পাশ করার পরে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ সাটক্লিফ-এর সুপারিশে নবীনচন্দ্র কলকাতার হেয়ার স্কুলে তৃতীয় শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। পরে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়োগের প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হন। ১৮৬৮ সাল থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছত্রিশবছর তিনি ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও কালেক্টর হিসেবে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় দক্ষতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। চাকরিতে নিযুক্ত থাকা কালীন বহু জনহিতকর সমাজসংস্কার মূলক কাজে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন। ১৮৮৬ সালে তিনি ফেনী হাই স্কুল (বর্তমানে ফেনী সরকারি পাইলট হাই স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন।

 ‘পলাশীর যুদ্ধ’ মহাকাব্য প্রকাশিত হলে কবি হিসেবে পরিচিতির পাশাপাশি তাঁকে ব্রিটিশ শাসকদের রোষের মুখে পড়তে হয়।পলাশীর যুদ্ধ’র পর প্রকাশিত হয় রৈবতক, কুরুক্ষেত্র কাব্যগ্রন্থ। রৈবতক, কুরুক্ষেত্র ও প্রভাস এই তিনটি একটি বিরাট কাব্যের তিনটি স্বতন্ত্র অংশ। এই কাব্য তিনটিতে কৃষ্ণ চরিত্রকে কবি নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেছিলেন। কবির মতে আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির সংঘর্ষের ফলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল। আর্য অনার্য দুই সম্প্রদায়কে মিলিত করে শ্রীকৃষ্ণ প্রেমরাজ্য স্থাপন করেছিলেন। নবীনচন্দ্রর অন্যান্য কাব্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাব্য গ্রন্থ  ক্লিওপেট্রা, অমিতাভ,  রঙ্গমতী,খৃষ্ট। এছাড়াও কিছু গদ্য রচনাও করেছিলেন তিনি। ভগবতগীতা এবং মার্কণ্ডেয়-চণ্ডীরও পদ্যানুবাদ করেছিলেন। অনবদ্য সৃষ্টিশীলতা, কবিত্ব তাকে রবীন্দ্র সমসাময়িক যুগেও বাংলা সাহিত্য সমাজে বিশেষ ভাবে জায়গা করে দিয়েছিল।

কবি নবীনচন্দ্র সেন ১৯০৯ সালের ২৩শে জানুয়ারি চট্টগ্রামে নিজের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ভালো লাগলে লাইক, শেয়ার করুন। নবীনচন্দ্র সেনের সম্বন্ধে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।

No comments:

Post a Comment