28 February 2019

আজ ২৮শে ফেব্রুয়ারী বাংলা থিয়েটারের জনক গিরিশচন্দ্র ঘোষের ১৭৫তম জন্ম বার্ষিকীতে জানাই আমাদের শ্রদ্ধা।

২৮শে ফেব্রুয়ারী ১৮৪৪ সালে বাংলা থিয়েটারের জনক গিরিশচন্দ্র ঘোষ কলকাতার বাগবাজারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সংগীতস্রষ্টা, কবি, নাট্যকার, উপন্যাসিক, নাট্য পরিচালক, মঞ্চাভিনেতা। বাংলার থিয়েটারের স্বর্ণযুগ মূলত তারই অবদান।

গিরিশচন্দ্রে পিতা নীলকমল ঘোষ ছিলেন একজন একাউন্টেন্ট। মাতার নাম ছিল রাইমনি। তাদের ১২টি সন্তানের অনেকেই অল্প বয়সে মারা যায়। গিরিশচন্দ্র ছিলেন তাদের অষ্টম সন্তান। ১১ বছর বয়সে গিরিশচন্দ্র তাঁর মাকে হারান এবং পিতাকে হারান তখন তার বয়স মাত্র ১৪। তখন বোন কৃষ্ণ কিশোরী সংসারের অভিভাবক হন। গিরিশচন্দ্র ছোটবেলার উশৃংখল ছিলেন। যখন গিরিশচন্দ্রের বয়স ১৫ ভাইকে শুধরাতে বোন কৃষ্ণ কিশোরী গিরিশচন্দ্রের বিয়ে দিলেন প্রমোদিনীর সাথে।

গিরিশচন্দ্র বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন কিন্তু সেখানে তার মন বসে না। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ে পড়াশুনা ছেড়ে দেন। কিন্তু তার ছিল প্রবল ইচ্ছা শক্তি আর প্রখর স্মরণ শক্তি। তিনি বিয়ের যৌতুক বাবদ যে টাকা পেয়েছিলেন সেই টাকা দিয়ে তিনি ক্লাসিক ইংরাজী সাহিত্যের অনেক বই কিনে নিজেই পড়াশুনা শুরু করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ইংরাজী ভাষা রপ্ত করে নেন এবং সাথে বায়রন, শেক্সপিয়ারের পাতার পর পাতা লেখা কন্ঠস্থ করে ফেলেন।  গিরিশচন্দ্রের জীবনে বেশ কিছুটা উশৃংখলতা স্বেচ্ছাচারিতা দেখা দেয়। তখনকার সময় ইংরাজী জানলে ভালো চাকরি পাওয়া যেত। তার শ্বশুরমশাই গিরিশচন্দ্রকে একটা বুককিপিং এর চাকরির জোগার করে দেন।

বই পড়ার প্রবল আগ্রহ থাকায় তিনি এসিয়াটিক সোসাইটির সদস্যপদ নিয়ে রামায়ণ, মহাভারত সহ বহু পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক বই পড়ে ফেলেন। সেই সঙ্গে শুরু করেন বাংলায় অনুবাদ। বন্ধুরা বললেন  শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথের সংলাপ বাংলায় অনুবাদ করা সম্ভব নয়। কারণ তার সংলাপগুলি খুবই কঠিন। ইংরাজীতেই ঠিক করে বোঝা দায়। কিন্তু গিরিশচন্দ্র ম্যাকবেথ বাংলায় অনুবাদ করে ফেলেন।

তখন একটা নাটক বহু দিন ধরে মঞ্চস্থ করা হোত। গিরিশচন্দ্র শ্রোতাদের এক ঘেয়েমি দূর করতে প্রতি দু মাস অন্তর নতুন নতুন নাটক লিখতেন। একবার দুর্গাপুজোর সময়  গিরিশের বয়স যখন ২০ তখন তিনি দীনবন্ধু মিত্রের "সধবার একাদশী"তে নিমচাঁদ চরিত্র অভিনয় করেন। এই চরিত্রে মাতালের ভূমিকায় অভিনয় করার সময় পরিচালক বোতলের মধ্যে জলে লাল রং মিশিয়ে দেয়। কিন্তু গিরিশচন্দ্র বলেন তিনি মাতালের ভূমিকায় অভিনয় করবেন আর মদ থাকবে না। তাঁকে মদ দিতেই হবে, তাহলেই অভিনয় করবেন। নিরুপায় হয়ে পরিচালক রাজি হন এবং গিরিশচন্দ্র মদ খেয়েই অভিনয় করেন এবং খুবই প্রসংসা অর্জন করেন।

স্টার থিয়েটারে গিরিশচন্দ্রের চৈতন্যলীলা নাটকে ঠাকুর রামকৃষ্ণ চৈতন্য চরিত্রে বিনোদিনীর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন এবং বিনোদিনীর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ গিরিশচন্দ্রের মোট পাঁচটি নাটক চৈতন্যলীলা, প্রহ্লাদ চরিত্র, বৃষকেতু, নিমাই সন্ন্যাস ও দক্ষযক্ষ দেখেন। স্বেচ্ছাচারী বেপরোয়া গিরিশচন্দ্র পরবর্তীকালে ঠাকুর পরমহংসের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর মধ্যে নৈতিক পরিবর্তন হয় এবং আধ্যাত্মিক ভাব জাগরিত হয়।

একবার গিরিশচন্দ্র ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন প্রভু আমি পাপী, আমার কি করা উচিত। আমি এত মদ খেয়েছি যে মদের বোতল গুলি একটার ওপরে একটা রাখলে হিমালয়ের সমান উঁচু হবে। ঠাকুর বলেন তুমি যা করছো তাই করো। অভিনয় চালিয়ে যাও। গিরিশচন্দ্র বললেন আমি ওসব করি পেটের জ্বালায়। তখন ঠাকুর বলেন তাহলে সকাল সন্ধ্যে দুবেলা ঈশ্বরের নাম নিতে। গিরিশচন্দ্র বলেন কখন সকাল হয় কখন সন্ধ্যে হয় তা আমার জ্ঞানে থাকে না। ঠাকুর বলেন তাহলে শুধু খাবার আগে এবং শোবার সময় ঈশ্বরের নাম করতে। তখন গিরিশচন্দ্র বলেন কখন আমি খাই আর কখন ঘুমাই শুধু ঈশ্বরই জানেন। ঠাকুর বলেন তুমি এটাও যদি না করতে পারো তাহলে থাক আমিই তোমার হয়ে ঈশ্বরের নাম করবো।

রামকৃষ্ণের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ যেমন আমেরিকা  সহ বিশ্বব্যাপী বেদ বাদান্তের  প্রচার করেছিলেন তেমনি তার আর এক শিষ্য গিরিশচন্দ্র রামকৃষ্ণের কথা ও বাণী প্রচার করে ছিলেন।

১৮৮৬ সাল। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস সেই সময় দুরারোগ্য গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর শারীরিক অবস্থারও যথেষ্ট অবনতি ঘটেছিল। উত্তর কলকাতার  কাশীপুর অঞ্চলের একটি বাগানবাড়িতে চিকিৎসার সুবিধার জন্য তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল। ১ জানুয়ারি একটু সুস্থ বোধ করায় তিনি বাগানে বিকালের দিকে হাঁটতে বেরিয়ে ছিলেন। সে দিন ছুটির দিন। ভক্তরা বাগান বাড়ীতে এসে বিভিন্ন জায়গায় বসে গল্প করছেন। গিরিশচন্দ্রও সুরেন্দ্রনাথ, রামচন্দ্র দত্ত ও অনান্যদের সাথে একটি গাছ তলায় বসে কথাবার্তা বলছেন। হঠাৎ তারা দেখলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। ঠাকুর সুস্থ হয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন দেখে তারাও খুব খুশি। ভক্তরাও উঠে দাঁড়ালেন। ঠাকুর সেই গাছ তলায় এসে সেখানে তিনি তাঁর অনুগামী নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষকে বলেন "গিরিশ তুমি আমার সম্বন্ধে কি সব বলে বেড়াচ্ছো, তুমি কি দেখেছো, তুমি কি জানো আমার সম্বন্ধে, তোমার কী মনে হয়, আমি কে?"। গিরশচন্দ্র হাঁটু গেঁড়ে বসে হাত জোড় করে বললেন "বাল্মিকী যাঁর সম্বন্ধে বলে শেষ করতে পারেন নি, আর আমি কে যে আপনার সম্বন্ধে বলবো"। রামকৃষ্ণ পরমহংস তখন বলেন, “আমি আর কী বলব? তোমাদের চৈতন্য হোক"। এরপর তিনি  সমাধিস্থ হয়ে তাঁর প্রত্যেক শিষ্যকে স্পর্শ করেন। গিরিশচন্দ্র সহ রামকৃষ্ণ অনুগামীদের মতে, তাঁর স্পর্শে সেদিন প্রত্যেকের অদ্ভুত কিছু আধ্যাত্মিক অনুভূতি হয়েছিল।

সিরাজউদ্দৌলা, মীর কাসিম আর ছত্রপতি শিবাজী নাটক করে গিরিশচন্দ্র ইংরেজদের রোষানলে পড়েন। সিরাজউদ্দৌলা বাংলার শেষ নবাব। তার সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারনে ২৩শে জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন। রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহন করে।  মীর কাসিম  ইংরেজদের সাথে সামরিক যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন।  বক্সারের যুদ্ধে তিনি ইংরেজ বাহিনির হাতে পরাজিত হন। বলা হয়ে থাকে এই যুদ্ধই ছিল বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার সর্বশেষ সুযোগ।  ইংরেজ-মারাঠা যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে মারাঠা সাম্রাজ্য চূড়ান্ত পরাজয় স্বীকার করে। এর ফলেই কার্যত ভারতের উপর ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা গিরিশচন্দ্রকে ঐ তিনটি নাটক মঞ্চস্থ করতে নিষেদ করে দেন। এর পর গিরিশচন্দ্র ঝাঁসী রানী লক্ষ্মীবাঈকে নিয়ে লেখা শুরু করেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিপ্লবী নেতা এবং ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহের অন্যতম পথিকৃত হিসেবে চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব লক্ষ্মী বাঈ। কিন্তু ব্রিটিশ রাজ জানিয়ে দেন ঝাঁসী রানী লক্ষ্মীবাঈ নাটক করলে তাকে জেলে পাঠানো হবে। গিরিশচন্দ্র এই নাটক লেখা শুরু করলেও শেষ করতে পারেন নি।

সে সময় মেয়েদের চরিত্রে ছেলেরাই অভিনয় করতো। গিরিশচন্দ্রই বাংলা নাটকে প্রথম মহিলাদের থিয়েটারে সুযোগ করে দেন। তিনি পতিতালয় থেকে মেয়েদের নিয়ে শিখিয়ে নাটকে নামান। তিনি একটি অভিনয় স্কুল খুলে ফেলেন। সেখান থেকে বহু প্রতিভাবান অভিনেত্রী তৈরী করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বিনোদিনী, তিনকড়ি, তারাসুন্দরী সহ অনেকে।

গিরিশচন্দ্র অভিনয়ের উপযোগী নতুন ছন্দের সূচনা করেন। নাটক গুলিকে ছোট ছোট ছন্দে বিন্যস্ত করেন। তার ছন্দের নাম হয় গৈরিক ছন্দ।

১৯১২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ৬৮ বছর বয়সে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের মৃত্যু হয়।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।







  

No comments:

Post a Comment