08 February 2019

আজ নাট্যপরিচালক ও মঞ্চাভিনেতা গিরিশচন্দ্র ঘোষের ১০৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে স্মরণ করি৷

আজ ৮ই ফেব্রুয়ারী বাংলা থিয়েটারের স্বর্ণযুগের প্রাণ পুরুষ ও জনক গিরিশচন্দ্র ঘোষের প্রয়াণ দিবস।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে কলকাতার কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের (বর্তমানে বিধান সরণি) স্টার থিয়েটার ভিড়ে জমজমাট থাকতো। সেখানে অভিনয় করতেন অমৃতলাল মিত্র, অমৃতলাল বসু, হরিপ্রসাদ বসু ও প্রধান আকর্ষণ পরিচালক ও অভিনেতা গিরিশচন্দ্র ঘোষ। স্টারে অভিনীত নাটকের রচয়িতাও ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। সারা বাংলায় তখন সবার মুখে মুখে গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাম।

১৮৪৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা নীলকমল ঘোষ তখন কলকাতার স্বনাম ধন্য ব্যক্তি ছিলেন। মায়ের নাম রাইমনি। গিরিশচন্দ্র ঘোষের ছিলেন তাঁর পিতামাতার অষ্টম সন্তান। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং পণ্ডিত হলেও গিরিশচন্দ্র ঘোষের কোন বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলনা। গিরিশচন্দ্র ঘোষের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন স্থানীয় এলাকার বিদ্যালয়ে শুরু হয়। পরে গৌরমোহন আঢ্যের বিদ্যালয় ও হেয়ার স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৮৬২ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। তবে পরবর্তীকালে একান্ত নিজস্ব চেষ্টায় তিনি ইংরেজি ভাষা ও হিন্দু পুরাণ বিষয়ে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। এক সময় তিনি ‘অ্যাটকিন্সন টিলকন’ কোম্পানির হিসাবরক্ষণ বিভাগে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দেন। গিরীশচন্দ্র ঘোষের মন প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে এবং অদ্ভুত ভাবে চিন্তা করতে পারতো। তার চিন্তা কিংবা আইডিয়া বা শব্দাবলী তাৎক্ষনিক লিখে রাখার জন্য তিনি দেবেন্দ্র নাথ মজুমদারকে সেক্রেটারি নিয়োগ দেন। দেবেন্দ্র সারাক্ষণ তার কাছে তিনটা পেন্সিল প্রস্তুত রাখতেন, দোয়াত কলম রাখতেন না। কারণ কলমে কালি ভরার মত সময়টুকুও তিনি পেতেন না। কোন কথা বুঝতে না পেরে পুনরায় জিজ্ঞেস করলে গিরীশ রেগে যেতেন, কারণ তাতে তার চিন্তায় বিঘ্ন ঘটতো। তাই কোন শব্দ বুঝতে না পারলে তার নির্দেশ অনুযায়ী দেবেন্দ্র সেখানে ডট বসিয়ে যেতেন, যাতে পরে জেনে নিতে পারেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রভাবে তিনি প্রথম গান এবং কবিতা লিখতে শুরু করেন। পরে নাট্য মঞ্চের সাথে যুক্ত হলে নাটক লিখতে শুরু করেন। ১৮৬৬ সালে গিরিশচন্দ্রের লেখা 'বিল্বমঙ্গল' প্রথম স্টারে অভিনীত হয়। ১৮৬৭ সালে মাইকেল মধুসূদন রচিত 'শর্মিষ্ঠা' নাটকের গীতিকার হিসেবে নাট্যজগতে তাঁর প্রথম জীবন শুরু হয়েছিল। এর ঠিক দু'বছর পরে দীনবন্ধু মিত্রের 'সধবার একাদশী' নাটকে অভিনয় করে সুনাম অর্জন করেন। ১৮৭২ সালে তিনিই প্রথম বাংলায় পেশাদার নাট্য কোম্পানি ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন।

১৮৭৭ সালে মেঘনাদ বধ কাব্যে রামচন্দ্র ও মেঘনাদ উভয় ক্ষেত্রে অভিনয়ের জন্য সাধারণী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁকে "বঙ্গের গ্যারিক" আখ্যায় ভূষিত করেন। তার হাত ধরে বহু অভিনেতা অভিনেত্রী বাংলা থিয়েটারে এসেছেন, বাংলা থিয়েটারকে করেছেন সমৃদ্ধ। তাদের মধ্যে অন্যতম বিনোদিনী দাসী। যিনি মাত্র ১২ বছর বয়েসে বাংলা নাটকের জগতে প্রবেশ করেন এবং ২৩ বছর বয়সে অবসর নেন। ১৮৮৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর 'নটী বিনোদিনী'কে নিয়ে স্টার থিয়েটারে 'চৈতন্যলীলা' নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন। এই নাটকটি দেখে রামকৃষ্ণদেব মুগ্ধ হয়ে নিমাই এর ভূমিকায় বিনোদিনীকে আশীর্বাদ করেছিলেন। এরপর গিরিশচন্দ্র ঘোষ রামকৃষ্ণদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার সাথে সাক্ষাতের আগে গিরিশচন্দ্র ছিলেন কুখ্যাত মদ্যপ ও স্বেচ্ছাচারী, বেপরোয়া, সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধাচারি, বিশৃঙ্খল জীবনাচরণে অভ্যস্ত এক ব্যক্তি। কিন্তু তা সত্ত্বেও জীবনের পরবর্তী ভাগে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসের এক বিশিষ্ট শিষ্য হয়েছিলেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম অন্তরঙ্গ শিষ্যে পরিণত হয়েছিলেন।  রামকৃষ্ণদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণের পর গিরিশ ঘোষের মধ্যে পরিবর্তন আসে। এইসময় ধর্ম প্রভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি একাধিক পৌরাণিক ও ভক্তিমূলক নাটক রচনা করেন।

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ পৌরাণিক, ভক্তিমূলক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে মোট ৪০ টি নাটক রচনা করেছিলেন। তাঁর লেখা নাটকের সংখ্যা ৭৫।  উল্লেখযোগ্য পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে 'রাবণবধ', 'অভিমুন্যবধ', "সীতার বনবাস', 'বিল্বমঙ্গল', 'অজ্ঞাতবাস' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। "অশোক", "সিরাজউদ্দৌলা", "মীরকাশিম", "ছত্রপতি শিবাজী" ইত্যাদি তাঁর রচিত প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক নাটক। তাঁর রচিত সামাজিক নাটকগুলি হলো প্রফুল্ল, হারানিধি, মায়াবসান, বলিদান ইত্যাদি। আবার "মুকুল মঞ্জরা" ও "আবুহোসেন" এর মতো কিছু রোমান্টিক নাটকও তিনি রচনা ক‍রেছেন। তিনি সীতার বনবাস লিখেছিলেন এক রাতে, 'সধবার একাদশী’র জন্য ২৬ টা গানও লিখেছিলেন এক রাতে। তার বোন দেবমাতা বলেছিলেন, অন্যতম শ্রেষ্ঠ  নাটক 'বিল্বমঙ্গল' লিখেছিলেন মাত্র ২৮ ঘণ্টায় এবং নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে এক বসাতে। এই নাটকগুলো আজও জনপ্রিয়তা হারায়নি। গিরিশচন্দ্র ঘোষের রচিত বুদ্ধদেব চরিত  বাঙালির মধ্যে বুদ্ধের প্রতি নতুন ভাবে আগ্রহ সৃষ্টি করতে অনেক অবদান রেখেছে। বাংলায় বুদ্ধ ধর্মীয় চর্চার ইতিহাসেও গ্রন্থটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

বেশ কয়েক বছর তিনি হাঁপানি রোগে ভোগেন। ১৮৯০ সালের ২০শে জুন তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি উইল করেন। প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েও জীবনে তাঁর সুখ ছিল না। পরপর দুই স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তাঁর একমাত্র পুত্র সুরেন্দ্র ঘোষ পেশায় অভিনেতা ছিলেন। গিরিশচন্দ্র তাঁর বোস পাড়া লেনের বাড়ি শ্রীধর জীউ ঠাকুরের নামে দান করেন। তিনি তাঁর বোন ও দুই দৌহিত্রকে একটি বাড়ি ও গ্রন্থাবলির কপিরাইট দিয়ে যান। ১৯১২ সালের ৮ ই ফেব্রুয়ারি ৬৮ বছর বয়সে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের মৃত্যু হয়।

No comments:

Post a Comment