09 February 2019

৯ই ফেব্রুয়ারী কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, চিকিৎসক 'বনফুল'-বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের প্রয়ান দিবস। আজ ওঁনার প্রয়াণ দিবসে জানাই শ্রদ্ধা।

ছোটবেলা থেকেই বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ছিল। বলাইচাঁদ যখন সাহেবগঞ্জ রেলওয়ে হাইস্কুলের ছাত্র সেই সময়ে ‘বিকাশ’ নামে হাতে লেখা পত্রিকায় কবিতা লেখালিখি করতো। পরে ‘মালঞ্চ’ পত্রিকায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ছাপা হয়। এতে স্কুলের হেডপণ্ডিত রামচন্দ্র ঝা খুশি হলেন না। হেডপণ্ডিত রামচন্দ্র ঝার ধারণা বলাইচাঁদ সংস্কৃতে একশো পাওয়ার যোগ্য কিন্তু কবিতা লেখার কারনেই বলাইচাঁদ সংস্কৃতে একশো পাচ্ছে না। তাই হেডপণ্ডিত বলাইচাঁদকে কবিতা লিখতে নিষেদ করেন। কিন্তু বলাইচাঁদের প্রবল ইচ্ছা লেখার। তাই হেডপণ্ডিত রামচন্দ্র ঝার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য 'বনফুল' ছদ্মনাম দিয়ে লিখতে শুরু করেন। কিন্তু এই ছদ্মনামে লিখেও পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে ধরা পড়ে গেলেন। এ বার আর পণ্ডিতমশাই বাধা দিলেন না। তিনি বলাইচাঁদকে নির্দেশ অমান্য করার জন্য 'শাস্তি' হিসাবে তাঁকে কিছু সংস্কৃত শ্লোক অনুবাদ করতে বলেন। সেই আনুবাদগুলি 'প্রবাসী’ ও ‘ভারতী’-পত্রিকাতে ছাপাও হয়। এ ভাবেই বলাইচাঁদ 'বনফুল' নামে পরিচিতি লাভ করে 'প্রবাসী', 'ভারতী' এবং সমসাময়িক অন্যান্য পত্রিকায় তাঁর ছোটগল্প প্রকাশ হতে থাকে।

বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম অণুগল্প লেখেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর গল্পগুলো আধ পৃষ্ঠা বা এক পৃষ্ঠা কিংবা দুই পৃষ্ঠা পর্যন্ত সীমায়ত থাকত। ঈশপের ও জাতকের গল্প, পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ প্রভৃতি বনফুলের অণুগল্পের পূর্বতন ঐতিহ্যের নিদর্শন। ‘নিমগাছ’ শিরোনামের আধ-পৃষ্ঠার গল্পটিতে ফুটে উঠেছে এক অসাধারণ কাব্যিক ব্যঞ্জনা। আরেকটি অণুগল্পের নাম হলো ‘অতি ছোটগল্প’। মানুষের নিয়তিকে নিয়ে দুটি অণুগল্পের নাম হলো ‘আত্ম-পর’ ও ‘হাসির গল্প’।

বলাইচাঁদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে এসেছিলেন। ১৯৩৫ সালে রাজস্থানের জয়পুরের বাসিন্দা রামচন্দ্র শর্মা নামে এক ব্রাহ্মণ মন্দিরে বলি বন্ধ করতে চেয়ে কালীঘাট মন্দিরের কাছে অনশন শুরু করেন। বেশির ভাগ বাঙালিই রামচন্দ্রের এই কর্মসূচির বিরুদ্ধে থাকলেও সমর্থন জানালেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের এই অবস্থানের বিরোধিতায় খানিকটা ব্যঙ্গের সুরেই একটি কবিতা লেখেন বনফুল। কবিতা পড়ে রাগ নয় বরং কবির সঙ্গে আলাপ করতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু বনফুল জানালেন, তিনি ব্রাহ্মণ ও ডাক্তার। তাই ‘কল’, অর্থাৎ নিমন্ত্রণ ছাড়া কোথাও যান না। শেষমেশ সপরিবার বনফুলকে নিমন্ত্রণই জানালেন রবীন্দ্রনাথ। নিমন্ত্রণ পেয়ে পরিবার নিয়ে বনফুল যান শান্তিনিকেতন।

এই শুরু রবীন্দ্র-সান্নিধ্যের। পরে সে আলাপ গড়াল ঘনিষ্ঠতায়। বনফুলের ‘মানুষের মন’ গল্পটি পড়ে ভারী খুশি হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি লেখককে কিছু একটা উপহার দিতে চাইলেন। বনফুলের আবদার উপহার হিসেবে গুরুদেবের গায়ে দেওয়া একটি পুরনো জামা। রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই দেবেন না। বনফুলও নাছোড়। শেষমেশ এক দিকে দামি পশম, অন্য দিকে রেশম দেওয়া একটি প্রকাণ্ড জোব্বা উপহার পান। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বনফুলের মতান্তরও হয়েছে। বনফুলের ‘তৃণখণ্ড’-য় কিছু কবিতা  সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতামত, ‘ডাক্তারের ক্লিনিকে ওরা ভান করা সৌখিন রোগী’। বনফুলের ‘শ্রীমধুসূদন’ নাটকের কিছু অংশও রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয়নি বলে বদলানোর পরামর্শ দিলেও বনফুল তা করেননি।

লেখক হিসেবে বনফুল হাজারেরও বেশি কবিতা, ৫৮৬টি ছোট গল্প, ৬০টি উপন্যাস, ৫টি নাটক, জীবনী ছাড়াও অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর 'স্থাবর' ও 'জঙ্গম' উপন্যাসগুলি সর্বসময়ের ক্লাসিক উপন্যাস হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। অগ্নীশ্বর ও হাটেবাজারে উপন্যাসগুলি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর অনান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস তৃণখন্ড, অগ্নি, ডানা ত্রিবর্ণ, ভুবনসোম, প্রচ্ছন্ন মহিমা, উদয় অস্ত প্রভৃতি। তাঁর কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূবনসোম, অগ্নীশ্বর ও হাটেবাজারে।

সমাজের অবহেলিত মানুষের সেবা করা ছিল বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের জীবনের ব্রত। এক্ষেত্রে ডাক্তারি ছিল তাঁর অন্যতম মাধ্যম।

কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, চিকিৎসক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৯শে জুলাই বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রামে। পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড হাসপাতালের ডাক্তার। মাতা মৃণালিনী দেবী। তার অনুজ অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় খ্যাতনামা চিত্রপরিচালক।

বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী স্কুলে এবং পরে সাহেবগঞ্জ জেলার সাহেবগঞ্জ উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে তিনি লেখাপড়া করেন। এরপর ১৯২০ সালে হাজারীবাগ সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে তিনি আই.এস.সি, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং পাটনা মেডিক্যাল কলেজে থেকে এম.বি ডিগ্রী লাভ করেন।

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতার একটি বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে। পরে মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জের মিউনিসিপ্যালিটি হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার পদে কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন। তবে তিনি ভাগলপুরের খলিফাবাগে নিজ উদ্যোগে The Secro-Bactro Clinic নামে একটি ল্যাবরেটরি  প্রতিষ্ঠা করে খ্যাতিমান ডাক্তার হিসেবে পরিচিত হন। প্যাথলজিস্ট হিসাবে তিনি ৪০ বৎসর কাজ করেছেন।  তিনি ১৯৬৮ সালে কলকাতায় চলে আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য।

সাহিত্য-সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় লাভ করেন শরৎস্মৃতি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট উপাধি প্রদান করে ১৯৭৩ সালে; ১৯৭৫ সালে ভারত সরকারের কাছ থেকে তিনি পান পদ্মভূষণ উপাধি।

১৯৭৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি  কলকাতা শহরে তাঁর মৃত্যু হয়। আজ ওঁনার ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ভালো লাগলে লাইক, শেয়ার করুন। বনফুলের সম্বন্ধে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।

No comments:

Post a Comment