23 February 2019

আজ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের ১১৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


আধুনিক ভারতবর্ষের নব যুগের সূচনায় প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায়ের শিষ্য ছিলেন ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। হাওড়া জেলার পাইকপাড়া গ্রামে ১৮৩৩ সালের ২রা নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন । মাত্র ৫ বছর বয়সে পিতৃমাতৃহীন হয়ে ছোটমামা মহেশচন্দ্র ঘোষের কাছে থেকে পড়াশুনা আরম্ভ করেন। 

১৮৪৯ সালে হেয়ার স্কুল থেকে “জুনিয়র বৃত্তি” নিয়ে মহেন্দ্রলাল সরকার হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের দিকে তাঁর খুব ঝোঁক ছিল। প্রিয় বিষয় ছিল অংক। এই সময় তার হাতে আসে মিল সাহেবের বিখ্যাত বই “ট্যুর রাউন্ড দি ক্রিয়েশন”। বইটি পড়ে হাতে কলমে কি ভাবে বিজ্ঞান শেখা যায় তার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। কিন্তু সে সময় দেশে ফলিত  বিজ্ঞান শেখার কোনো সুযোগ ছিল না। শুধু মাত্র মেডিকেল কলেজে হাতে কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। ১৮৫৪ সালে মহেন্দ্রলাল মেডিকেল কলেজে ভর্ত্তি হন। ১৮৬৩ সালে এম ডি পরীক্ষায় তিনি প্রথম হন। চন্দ্র কুমার দে’র পরে তিনিই হলেন  দ্বিতীয় বাঙালি এম.ডি।

কর্মজীবন শুরু হয় স্বাধীন ডাক্তারী পেশা হিসাবে এবং তখন তিনি নাম আর যশ দুই অর্জন করেন। পরবর্তী সময় ডঃ মর্গানের একটি বই পড়ে  তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার প্রতি আনুপ্রাণিত ও আকৃষ্ট হন। মহেন্দ্রলাল এ্যালোপ্যাথি ছেড়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শুরু করেন। সে সময়ের খ্যাতনামা হোমিওপ্যাথ রাজেন্দ্রলাল দত্তের ক্লিনিকে যোগ দেন।  তিনি বন্দেমাতরম সঙ্গীতের স্রষ্টা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চিকিৎসার ভার নেন। পরবর্তী সময়ে Bengal Medical Association (BMA) প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে হোমিওপ্যাথিকে এ্যালোপ্যাথির চেয়ে শ্রেয়তর বলে ঘোষণা করেন। এ কারণে কলকাতার ব্রিটিশ চিকিৎসকগণ তাকে অ্যাসোসিয়েশন থেকে বহিষ্কার করেন। কিছুকালের জন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাঁর পসার কমে যায়। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার জন্য রোগী সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। পরবর্তী সময়ে তিনি দেশের সবচেয়ে  বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকে পরিণত হন।

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার  ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসেরও  চিকিৎসা করতেন। তিনি জানতেন যে রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যরা তার ওষুধের ওপরে পুরোপুরি ভরসা রাখতে না পেরে এ্যালোপ্যাথিক, বায়োকেমিক, কবিরাজি, হেকিমি, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি কোনও কিছুই বাকি রাখেনি। পরমহংসের স্ত্রী সারদামণি তারকেশ্বর হত্যে দিয়েও এসেছেন। মহেন্দ্রলাল আপত্তি করেননি। তার মতন বড় ডাক্তাররা সাধারণত এরকম হলে আর কোনও দায়িত্ব নিতে চান না, কিন্তু মহেন্দ্রলালের অহংবোধ এক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেনি। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, দেখুন না চেষ্টা করে, যদি কিছু ফল হয় তা ভালো কথা!

মহেন্দ্রলাল ১৮৬৮ সালে "ক্যালকাটা জার্নাল অব মেডিসিন" নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং ১৮৭০ সালে “ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অব সায়েন্স” প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতার ২১০ নং বৌবাজার স্ট্রীটে এর দপ্তর স্থাপিত হয়।যেখানে অনেক বিজ্ঞানী গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি হয়ে ওঠে বাঙালী বিজ্ঞানীদের মিলনমেলা। পদার্থবিজ্ঞানে ভারতের প্রথম নোবেল বিজয়ী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন এই প্রতিষ্ঠানেই তার নোবেল বিজয়ী গবেষণাটি সম্পন্ন করেছিলেন। ১৯০৭ সালে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

সেকালের অনেক মনীষীর মতো তাঁর সমাজ মনস্কতার দিকটাও উল্লেখযোগ্য। বাল্য বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম মেয়েদের বিবাহের ন্যুনতম বয়স ১৬ বছর ধার্য করার প্রস্তাব দেন। এটি পরে আইনি স্বীকৃতিও পায়। কুষ্ঠ রোগীদের জন্য স্ত্রী রাজকুমারীর নামে বৈদ্যনাথ ধামে একটি কুষ্ঠাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি জীবনের সমস্ত সঞ্চয় "সায়েন্স এস্যোসিয়েশন" এর কাজে দান করে যান।

১৯০৪ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী এই কিংবদন্তী মানবের জীবানাবসান ঘটে। আজ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের ১১৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

1 comment: