22 February 2019

আজ ২২শে ফেব্রুয়ারি, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের ১৩৪তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই।

যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ছিলেন ভারতীয় রাজনৈতিক মনীষী, বাংলার মুকুটহীন সম্রাট, সর্বভারতীয় কংগ্রেস দলীয় সভাপতি, কলকাতা  কর্পোরেশনের পাঁচবারের নির্বাচিত মেয়র। আজ ২২শে ফেব্রুয়ারি, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের ১৩৪তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই। আসুন আমরা জেনে নি ওঁনার সংগ্রামী জীবনের কিছু কথা।

যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ১৮৮৫ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের প্রাচীন জনপদ বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলার বরমা গ্রামে সেন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত ছিলেন আইনজীবী। কলকাতায় বাবার কাছে থাকার সময় তিনি ব্রাহ্ম বয়েস স্কুল, সুবার্বান স্কুল এবং হেয়ার স্কুলে পড়াশুনা করেন। হেয়ার স্কুল থেকেই তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

পড়াশুনার পাশাপাশি ছোট থেকেই তিনি খেলাধূলায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। ক্রিকেট, টেনিস,হকি সব খেলাতেই বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়ে ছিলেন। তাঁর খেলাধুলায় আগ্রহ দেখে কলকাতার লোকেরা তাঁর নাম দিয়েছিলেন ক্রীড়ামোদী মেয়র।

যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত  বিলেতে যান উচ্চশিক্ষার্থে এবং ১৯০৯ সালে ব্যারিস্টারি পাশ করেন। কেমব্রিজের ডাউনিং কলেজে বি-এ পড়ার সময় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের আলাপ ও প্রেম নেলী গ্রে-র সঙ্গে। প্রথম দিকে বিয়েতে কোনো পক্ষেরই মত না থাকায় বিয়ে মুলতুবি রেখেছিলেন যতীন্দ্রনাথ। পরে মত বদলে ১৯০৯ সালের ১লা আগস্ট যতীন্দ্রমোহন নেলী গ্রেকে বিয়ে করেই কলকাতায় ফেরেন। এদিকে বাবা যাত্রামোহন এক ব্যারিস্টার বন্ধুর রূপসী কন্যার সঙ্গে ছেলের বিবাহ দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। তিনি যখন শুনতে পেলেন যে, তার ছেলে এক বিদেশিনিকে বিয়ে করে দেশে ফিরছেন তখন তিনি নিজে চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে এসে নব-দম্পতিকে সস্নেহে তাদেরকে রহমতগঞ্জের বাড়িতে মহাসমারোহে নিয়ে যান। বাঙ্গালী বধূর সাজে নেলী গ্রেকে যতীন্দ্রমোহনের মা পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিয়েছিল।

দেশে ফিরে এসে যতীন্দ্রমোহন চট্টগ্রাম জেলা আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। এক বছর পর তিনি  কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় যোগ দেন। এ সময় কিছুদিন তিনি কলকাতা রিপন ল’ কলেজে (সুরেন্দ্র নাথ কলেজ) অধ্যাপনা করেন। ধীরে ধীরে কলকাতা হাইকোর্টে তার সুনাম বৃদ্ধি পেতে থাকে।

আইন পেশা ছেড়ে যতীন্দ্রমোহন কোলকাতা ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে আসেন এবং সেখানে  জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার করেন। ১৯১১ সালে তিনি চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হয়ে ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত দলীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। সে সময় পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ সৈন্যদের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সারাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। চট্টগ্রামেও আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করেন।

যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে বার্মা অয়েল কোম্পানির শ্রমিক ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেন। এরপরে আরম্ভ হয়েছিল আসামের শত সহস্র চা-বাগান কুলিদের আন্দোলন। এই কুলিদের উপর অমানুষিক নিপীড়ন, নির্যাতনের প্রতিবাদে শুরু হয় আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ধর্মঘট। ধর্মঘটের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে গান্ধীজী সমর্থন করলেন ধর্মঘটকে। যতীন্দ্রমোহনের বিস্ময়কর সংগঠন প্রতিভা এবং সুষ্ঠু নেতৃত্ব অভিনন্দিত করলেন।

যতীন্দ্রমোহন স্বীকৃতি পেলেন সমগ্র ভারত শ্রমিক আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে। প্রিয়শিষ্যের কৃতিত্বে গর্বিত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। আন্তরিক ভালোবাসা জ্ঞাপন করলেন যতীন্দ্রমোহনকে। বিপুল গৌরবে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানের সর্বভারতীয় নেতার পদে অধিষ্ঠিত হলেন যতীন্দ্রমোহন। শ্রমিক আন্দোলনের স্থপতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার নেতাকে সংবর্ধনা জানালেন, যতীন্দ্রমোহনের অভিনন্দন সভায় সুন্দর ভাষণ দিলেন প্রবীণ নেতা প্রসন্ন কুমার সেন। যতীন্দ্রমোহনের ত্যাগ, সাহস ও জনসেবার উজ্জ্বল ছবি তুলে ধরলেন শ্রোতৃবর্গের সম্মুখে। আবেগে, উচ্ছ্বাসে, কৃতজ্ঞচিত্তে প্রস্তাব করলেন, যতীন্দ্রমোহনকে “দেশপ্রিয়” আখ্যায় ভূষিত করা হোক। সানন্দে প্রস্তাব সমর্থন করলেন বর্ষীয়ান নেতারা।  উৎসাহে, উদ্দীপনায়, উল্লাসে, সভা উদ্বেলিত। সহস্র কণ্ঠের বন্দেমাতরম, আল্লাহু আকবার, দেশপ্রিয় জয় ধ্বনিতে প্রস্তাব সংবর্ধিত হল। চট্টগ্রামের মানুষ তাকে ‘মুকুটহীন রাজা’ নামে আখ্যায়িত করে।

কলকাতার মেয়র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন এর আকস্মিক মৃত্যুতে বাংলার যুব সমাজের নেতা কে হবেন এই নিয়ে  প্রাদেশিক কংগ্রেসে প্রশ্ন তোলেন মহাত্মাজী। প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদের অভিমত ছিল, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ছাড়া এই মুহুর্তে আর কাউকে বাংলার নেতা হিসাবে স্বীকার করা সম্ভব নয়। তার ফলস্বরূপ দেশবন্ধুর সিংহাসন যতীন্দ্রমোহনকে দেওয়া হল। যতীন্দ্রমোহন পরপর পাঁচবার কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।

যতীন্দ্রমোহন ১৯৩২ সালে কিছুদিনের জন্য তার স্ত্রী কে নিয়ে লন্ডন যান এবং  লন্ডন থেকে ফেরার পথে জাহাজ বোম্বে বন্দরে ভিড়তেই ২০শে জানুয়ারি  পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহাত্মক কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে কিছুদিন কলকাতায় বন্দী থাকার পর ১৯৩৩ সালের ৫ জুন যতীন্দ্রমোহনকে বন্দী অবস্থায় রাঁচীতে পাঠানো হয়। সেখানে সুচিকিৎসার কোনো সরকারি সুব্যবস্থা ছিল না। পাড়া প্রতিবেশীবিহীন প্রায় নির্জন অঞ্চল ‘কাঁকে রোড’ এর ‘নগেন্দ্র লজ’ রাঁচিতে দেশপ্রিয়’র অন্তরীন-আবাস। যতীন্দ্রমোহন ১৯৩৩ সালের ২২শে জুলাই রাঁচিতেই বন্দী অবস্থায় পরলোকগমন করেন।

দেশপ্রিয়ের মৃত্যুর পর রাঁচি মিউনিসিপ্যালিটি, দেশপ্রিয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে রাঁচির কাঁকে রোড-এর নতুন নামকরণ করেছিলেন “দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন রোড”।

যতীন্দ্রমোহনের স্মরণে দক্ষিণ কলকাতায় স্থাপিত হয়েছে ‘দেশপ্রিয় পার্ক’। জন্মস্থান চট্টগ্রামের বরমা গ্রামে বাড়ির সামনে স্থাপিত হয়েছে যাত্রামোহন সেনগুপ্ত, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও নেলী সেনগুপ্তর আবক্ষ মূর্তি।


প্রিয় পাঠক–পাঠিকা ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন। যে কোনো বিষয়ে জানা- অজানা তথ্য আমাদের সাথে আপনিও শেয়ার করতে পারেন।১০০০ শব্দের মধ্যে গুছিয়ে লিখে ছবি সহ মেইল করুন  wonderlandcity.net@gmail.com ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

No comments:

Post a Comment